ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনের চোখের সামনেই বাংলার আকাশ শত্রুমুক্ত হয়েছিল

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Dec 2016, 06:00 PM
Updated : 26 Dec 2016, 06:00 PM

বীর বিক্রম ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একজন বৈমানিক। ১৯৬৮ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েই তাকে প্রশিক্ষণের জন্য করাচিতে যেতে হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে বসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তখন পিআইএতে ৩০০ জন পাইলটের মধ্যে বাঙালি পাইলট ছিলেন মাত্র ৩০ জন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা পেশ করেছেন এবং সেখান থেকেই ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদের উপলব্ধি হয়েছিল, বাঙালি বৈমানিকদের নিয়ে আলাদা একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। তিনি এবং তার সহকর্মীরা ‘ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট এসোসিয়েশন’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধাচরণের কারণে সেটা তৎক্ষণাৎ সম্ভব হয়নি। পরে আদালতের আশ্রয় নিয়ে তারা সেটি গঠন করতে পেরেছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট এসোসিয়েশনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর। ২৫ শে মার্চের পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাপ্টেন আলমগীরসহ আরও তিনজন বাঙালি বৈমানিককে হত্যা করে।

৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ যুদ্ধ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আর ২৫ শে মার্চের গণহত্যার সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে যাওয়ার পর মা, বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের ঢাকার বিক্রম্পুরের রায়পাড়া গ্রামে রেখে এসেছিলেন। এরপর ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন তার এক ভগ্নিপতিকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর, কুষ্টিয়া হয়ে ভারতের পথে পাড়ি জমালেন। ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী নাপাম বোমার মাধ্যমে পুরো চুয়াডাঙা শহরটিকে ভস্মীভূত করে দেয়। ওই সময়ে ভারতীয় কিছু সাংবাদিকদের সাথে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন কলকাতায় পাড়ি জমান। তখন বিডিআরের কর্মকর্তা কর্নেল ওসমান তাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন। সিলেটের একটা পাওয়ার ইন্সটেরেশন উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল তার কাঁধে। এজন্য তাকে আগরতলা যেতে হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে সেই অপারেশনটা আর পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে নি। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনের যোগাযোগ হলো মেজর খালেদ মোশারফের সাথে। এসময়ে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিনের সাথে আরও ছিলেন বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার এবং বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন খালেক। ভারতের যোতপুরের মহারাজা তাদের একটা ড্যাকোটা প্লেন দিয়েছিলেন। আর ভারতীয় বিমানবাহিনী একটা অর্টার প্লেন আর একটা ফ্রেঞ্চ হেলিকাপ্টার দিলেন তাদের। এগুলো কোনোটাই যুদ্ধ বিমান ছিল না। সবই ছিল সাধারণ বিমান। এগুলো সমর সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল। এ সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি রায় বিমানবাহিনী গঠনের জন্য তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছিলেন। ২৮ সেপ্টেম্বর এয়ার চিফ মার্শাল পি সি রায় এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, বীর উত্তম ভারতের দিমাপুরে বিমানবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তখন সেখানে ছিলেন ৯ জন পাইলট। তার মধ্যে ৬ জনই ছিল বেসামরিক পাইলট। আর তিনজন ছিলেন বিমানবাহিনীর। তারা হলেন এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ফ্লাইট লে. শামসুল আলম এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম।

শুরু হলো সামরিক প্রশিক্ষণ। তারা ২০০-২৫০ ফিটের উপরে প্লেন উড্ডয়ন করতে পারতেন না। কারণ বাংলাদেশের আকাশে এর চেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়লে, পাকিস্তানি রাডারে ধরা পড়বে প্লেন। সেই সময়ে একটু মেঘ হলে নাগাল্যান্ডে আর কিছু দেখা যেত না। তাই ওই সময়ে প্রশিক্ষণটা খুব বিপদজনক ছিল। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হলো। ৩ নভেম্বরে হেলিকাপ্টার নিয়ে ঢাকায় এবং অর্টার দিয়ে চট্রগ্রামে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো। এই দুই শহরে আক্রমণের মূল কেন্দ্রস্থল ছিল এভিয়েশন ফুয়েল ডিপো, সেখান থেকে বিমানের তেল সরবারহ করা হতো। কিন্তু হঠাৎ করে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে এই আক্রমণ ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পরিচালনা করা হয়েছিল।

ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং তার সহযোদ্ধারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করেছিলেন। তাদের আক্রমণের পর ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিমানবন্দরগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। ৫ ডিসেম্বর বাংলার আকাশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় হেলিকাপ্টার দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ৫০ টি আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল, যার ১২ টিতে অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তার কোনো মৃত্যু ভয় ছিল না। কারণ নিরীহ মানুষকে রক্ষা আর দেশ মা-কে বাঁচানোই ছিল তার মূল লক্ষ্য।

ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের পরম সৌভাগ্য আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এখন নতুন প্রজন্মের শক্ত করে দেশের হাল ধরতে হবে, এগিয়ে যেতে সমৃদ্ধির পথে।”

Also Read: ‘বিমানবাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার’

Also Read: ‘আবুল হাশেমের চোখের সামনেই মারা যান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’

Also Read: ‘শরীরে গুলি লাগার পরেও আব্দুল শহীদ যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন’

Also Read: ভুল বুঝে আক্কু চৌধুরীকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়েছিলেন

Also Read: ‘অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল - হিট এ্যান্ড রান’

Also Read: চোখে যখন প্রতিশোধের আগুন

Also Read: কবরস্থানের গর্তে দিনরাত লুকিয়ে প্রাণ বাঁচান মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ

Also Read: হাত-মুখে গুলি লাগার পরেও লড়াই চালিয়ে যান ফরিদ মিয়া

Also Read: বাঘা হান্নানের অ‌্যাম্বুশে ধরাশায়ী পাকিস্তানি মিলিশিয়া

Also Read: যুদ্ধের স্মৃতি এখনও আলোড়িত করে শফিকুলকে

Also Read: মুক্তির আহ্বান