‘বিমানবাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধা ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Dec 2016, 07:57 PM
Updated : 25 Dec 2016, 07:57 PM

বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি জানতেন না ঢাকায় কী ঘটতে চলেছে। সন্ধ্যার পর জিন্দাবাহার লেনের ক্যাপ্টেন আলমগীরের গাড়িতে তিনি সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তারা দেখেছিলেন সারা শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে যে এমন গনহত্যা হতে পারে তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না। রাতে তারা গিয়েছিলেন এলিফ্যান্ট রোডে ক্যাপ্টেন সিকান্দারের বড়িতে। সেখান থেকে বের হতে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছিল। রাস্তায় বেড়িয়ে দেখলেন বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বক্সিবাজারের বাসায় পৌছালেন পৌনে বারোটার দিকে। বাসায় গিয়ে যখন কেবল খেতে বসেছেন, তখনই গোলাগুলি শুরু হলো। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাবির সব হলগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করল, আর বস্তিগুলোতে আগুন দিল। সকালে উঠে দেখলেন অসংখ্য মানুষ দৌড়াচ্ছে। তখনও কারফিউ চলছিল। কিন্তু মানুষ তা উপেক্ষা করে প্রাণ ভয়ে ছুটছিল। সাহসে ভর দিয়ে ক্যাপ্টেন সাত্তার ইকবাল হল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানে দেখলেন বেশ কিছু ডেড বডি। এরপর তিনি ২৮ তারিখে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতে যাবেন। কিন্তু যাওয়াটা সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত মে মাসের প্রথমদিকে আগরতলা পৌছালেন তিনি। সেখানে ক্যাপ্টেন সাত্তারসহ পিআইএর তিনজন পাইলট ছিলেন। তিনি বাদে অন্য দুজন হলেন ক্যাপ্টেন খালেক এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন। এই তিন পাইলট রওয়ানা দিলেন দিল্লির দিকে। দিল্লিতে তারা মাস দেড়েক অবস্থান করেন। জুন মাসের শেষদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল বুঝতে পারলেন এই যুদ্ধে বিমানবাহিনী একটা মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তখন ক্যাপ্টেন সাত্তারসহ তিনজন পাইলটকে ড্যাকোটা প্লেন চালোনোর অনুমতি দেওয়া হল।

তারা দিমাপুরে পৌছালেন সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখের দিকে। এর দুই তিনদিনের মধ্যেই তাদের ট্রেনিং শুরু হলো। একটা ড্যাকোটা প্লেন, একটা অর্টার সিঙ্গেল ইঞ্জিন এবং একটা হেলিকাপ্টার ছিল তাদের সম্বল। প্রথমদিকে ড্যাকোটা প্লেনে চারজন পাইলট ছিলেন। তারা হলেন ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন সাত্তার এবং ক্যাপ্টেন মুকিত। অর্টারে ছিলেন ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ এবং ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম।

পাহাড়ের গিরিপথ দিয়ে ২০০ ফিটের নিচের উচ্চতা দিয়ে পুরনো দিনের ড্যাকোটা প্লেন চালানোর দায়িত্ব পড়েছিল ক্যাপ্টেন সাত্তার এবং অন্য পাইলটদের। বিষয়টা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কারণ একটা ইঞ্জিন নষ্ট হলেই সব শেষ হয়ে যেত।

আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তখন ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন, তিনি বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন সেদিন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল এবং এয়ার মার্শাল দেওয়ান। ২ নভেম্বর ক্যাপ্টেন সাত্তারসহ অন্য পাইলটরা দিমাপুর থেকে কৈলাশহর আসার পরিকল্পনা করেন। এরপর রাত তিনটার দিকে তাদের ঢাকা আক্রমন শুরু করার কথা ছিল। তারা যখন কৈলাশহর যেতে প্রস্তুত, তখন তাদের কাছে একটা টেলেক্স পৌঁছে যায়। সেখানে নির্দেশ ছিল যে, তাদের ব্যারাকপুর যেতে হবে এবং আগের মিশন বাতিল হয়েছে। নির্দেশ মেনে তারা ব্যারাকপুর পৌছে যান।

ব্যারাকপুর যাওয়ার পর তাদের ৭/৮ বার প্লেন চালনা করতে হয়েছিল। এর মধ্যে জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে ৪/৫ বার উড্ডয়ন করতে হয়েছিল পাইলটদের। জেনারেল ওসমানী আকাশপথে বালুরঘাট, গো হাটি, কুম্বিগ্রাম, শিলচরসহ বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন সাত্তারসহ অন্য পাইলটরা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে নিয়েও দুইবার প্লেন চালনা করেছিলেন। এছাড়া বিমানযোগে তারা কলকাতার দমদম থেকে বালুরঘাটে ভারতীয় বাহিনীর কাছে অস্ত্র পৌছেও দিতেন। এরপর এই অস্ত্র চলে যেত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। শুধু এই একবারই নয়, আরও অনেকবার ক্যাপ্টেন সাত্তার এবং তার সহযোদ্ধারা বিভিন্ন ঘাটিতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবারহ করেছিলেন।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এজন্য যদি মৃত্যুও আসে, সেটা হবে গৌরবের মৃত্যু।’