কবরস্থানের গর্তে দিনরাত লুকিয়ে প্রাণ বাঁচান মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ

১৯৭০ সালে বি কম পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটা পেয়ে বসেছিল মো. খোরশেদ আলমের। ঢাকায় এসে মার্চের সেই উত্তাল সময়টা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ভীষণভাবে, মনের কোণে নতুন উদয় হয়েছিল নতুন স্বপ্ন-স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2016, 07:01 PM
Updated : 20 Dec 2016, 03:26 PM

১৯৭০ সালে বি কম পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছাটা পেয়ে বসেছিল মো. খোরশেদ আলমের। ঢাকায় এসে মার্চের সেই উত্তাল সময়টা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ভীষণভাবে, মনের কোণে নতুন উদয় হয়েছিল নতুন স্বপ্ন-স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন নিপীড়ন তখনও পুরোদমে চলছে। ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এবং তরুণ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। ঢাকার অবস্থা ছিল থমথমে। সবার মধ‌্যে আশঙ্কা-কিছু একটা ঘটবে। এই থমথমে অবস্থায় খোরশেদ আলম ২৫ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। পরদিন তিনি জানতে পারলেন পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ঢাকা শহরে রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, গ্রেপ্তার করেছে বঙ্গবন্ধুকে।

এই ভয়ঙ্কর সময়ে খোরশেদ আলম হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। ভৈরব, আশুগঞ্জের মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন, সংগ্রহ করেছিলেন যুদ্ধাস্ত্র, রাইফেল। এপ্রিলের ৬ তারিখে তিনি পেয়ে হেঁটে কসবায় পৌঁছান। সেখানে পাক বাহিনীর টহল অনেক বেশি ছিল, যার দরুন তিনি আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন।

নিজের গ্রামে কয়েকদিন অবস্থান করে মঈনপুরে আবুল কালাম (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), আক্কেল আলী, তালতলার শাহ আলম ও তাজুল ইসলামের সাথে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তারপর কোনাবন বর্ডার দিয়ে ভারতের নরসিংঘর ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক জনাব আব্বাস, এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের সাথে আলোচনা করে ট্রেনিংয়ের জন্য লোহার বন ট্রেনিং সেন্টারে চলে যান।

সেখানে ভারতীয় মাসিমপুর হেডকোয়ার্টারে ৫৭ নম্বর রেজিমেন্টের অধীনে কর্নেল ভাসিকের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নেন। গেরিলা ট্রেনিং শেষে ভারতীয় কমান্ডার ইনচার্জ কর্নেল ভাসিকের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ঋষি ও ক্যাপ্টেন হনুমান সিংয়ের অধীনে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল আর্মি হেডকোয়ার্টার মাসিমপুরে ১৫ দিন ইনটেলিজেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন।

এরপর সরাসরি ওই কর্মকর্তাদের কমান্ডে আখাউড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন খোরশেদ আলম। বাংলাদেশের ভিতরে চারগাছ, খাবেরা, সৈয়দাবাদ, আখাউড়া রণাঙ্গনে পুরোদমে কাজ শুরু করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য, পাকবাহিনীর অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে সহযোগিতা করেন।

এই সময়ে ভারতীয় ক্যাপ্টেন ঋষি খোরশেদ আলমকে নতুন নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী গোপিনাথপুর রণাঙ্গন দিয়ে তিনলাকপুর ব্রিজে পৌঁছান তিনি।

এরপর চারগাছ গিয়ে সেখানকার পাকবাহিনীর অবস্থানসহ ম্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু পাকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় খোরশেদ আলমের অভিপ্রায় টের পায়। তখন খোরশেদ আলমকে ধরতে এগিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনারা। ভাগ্যের জোরে সৈয়দাবাদে ভূঁইয়া বাড়িতে আশ্রয় পান তিনি। কালন ভূঁইয়া কবরস্থানে একটি গর্তে সারাদিন সারারাত লুকিয়ে ছিলেন খোরশেদ আলম।

পাকবাহিনী তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। কিন্তু তার হদিস পায়নি। ভূঁইয়া বাড়ির অনেক সদস্যের উপর নির্যাতন করেছিল পাকবাহিনী, কিন্তু কেউ তার ব্যাপারে মুখ খোলেনি। তাই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন খোরশেদ আলম।

এমন হাজার খোরশেদ আলমের দৃঢ় সংকল্পে আমরা পেয়েছি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।