কালটিয়ায় বাঘা হান্নানের অ‌্যাম্বুশে ধরাশায়ী পাকিস্তানি মিলিশিয়া

একাত্তরে কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান মোল্লাকে অনেকেই চেনেন বাঘা হান্নান নামে। পারিবারিকভাবে রাজনীতি সম্পৃক্ত হান্নান বেড়ে ওঠেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পরিবেশে।দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাই একাত্তরে সুসজ্জিত আর্মির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে যেতে প্রেরণা যোগায় এই কিশোরকে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2016, 06:09 PM
Updated : 17 Dec 2016, 06:37 PM

১৮-১৯ বছর বয়সে সীমানা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন হান্নান। প্রশিক্ষণে হয়ে ওঠেন পরিণত যোদ্ধা- জীবন দেওয়ার প্রত্যয়ে প্রস্তুত এক উদ্দীপ্ত গেরিলা। প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ফিরে আসেন কিশোরগঞ্জে নিজের এলাকায়।

স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেন দুর্বার গেরিলা বাহিনী। এরপর বিন্নাটির কুট্র্রাগড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সম্রাটকে নিয়ে কিশোরগঞ্জের মাটিতে প্রথম গেরিলা আক্রমণ, শহরের প্রাণকেন্দ্র রথখোলায় ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া, হোসেনপুর চরপুমদী বাজারে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালিবকে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে পাঁচ হাজারেরও বেশি বুলেটসহ অনেকগুলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল দখল হয় হান্নানের নেতত্বে।

দেশকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে উদ্দীপ্ত হান্নান এরপর চৌদ্দশত এলাকায় পাক বাহিনীর চলাচলের রাস্তায় পুঁতে রাখেন ট‌্যাঙ্কবিধ্বসী মাইন। তবে সফল হয়নি তার এই প্রচেষ্টা-পাকিস্তানি মিলিটারিদের গাড়ি আসার আগেই চলে আসে পাটবাহী গরুর গাড়ি, মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায় সবই। 

১৯৭১ সালের অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকের ঘটনা-বাঘা হান্নান মোল্লার কাছে খবর আসে পাকুন্দিয়ায় পাক হানাদারদের আক্রমণের কথা। খবর নিয়ে নিশ্চিত হন ট্রাকে করে পাক মিলিশিয়া ও তাদের এদেশীয় দোসর মুজাহিদ, রাজাকারদের শহরে ফেরার পরিকল্পনা।

তৎক্ষণাৎ রণ পরিকল্পনা, অ‌্যাম্বুশ (অতর্কিত হামলা) করবেন। শহরের কয়েক মাইল আগে কালটিয়া বাজার ও বিন্নাটির মাঝখানে বেছে নেন সুবিধাজনক জায়গা। নিজের কাঁধেই নেন আক্রমণের ভার। সঙ্গে তখন মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম মোস্তফা চাঁন মিয়া, মাহতাবউদ্দিন ও শামসুল হুদা আঙ্গুর।

এরপর অপেক্ষার পালা। নিঃশ্বাস বন্ধ নীরবতা। দূরে দেখা যাচ্ছে ট্রাক। এগিয়ে আসছে কাছে, আরও কাছে। হৃদস্পন্দন বাড়ছে। ভুল করা যাবে না। আরও কাছে আসতে দিতে হবে। নার্ভ শক্ত। হাত কাঁপলে চলবে না।

এক সময় গর্জে উঠে সাব মেশিন গান, পরিকল্পনা মতো প্রথম লক্ষ‌্য ট্রাকের চালক আর চাকা। যে যার মতো ভেদ করেন অব্যর্থ নিশানা। রাস্তার ডান পাশে ধান ক্ষেতের উপর উল্টে পড়ে ট্রাক।

হতাহতদের ফেলে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি শুরু হয় মিলিশিয়াদের। তখন বিজয়ের উল্লাস বাঘা হান্নান মোল্লা ও তার বাহিনীর, সফল কালটিয়া অপারেশন।

এ সময় পালাতে থাকা মিলিশিয়াদের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেন মুক্তিযোদ্ধা মুর্শিদ আলী ও গোলাম হোসেন। সহযোদ্ধার এই প্রস্থান আরও দুরন্ত করে তোলে শত্রু খতমের তাড়া। একের পর এক অভিযানে ঘাতকমুক্ত হয় বাংলার মাটি।

কালটিয়ার মতো অনেকবারই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়করা।