শিশুদের উপযোগী কনটেন্ট তৈরির চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে নিয়ে একজন মন্ত্রীও বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে বেশ কিছু কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও করবে।
শিশু সাংবাদিকতার ওয়েবসাইট ‘হ্যালো’র আয়োজনে বৃহস্পতিবার এক গোলটেবিল আলোচনায় একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, “শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান করা সব থেকে কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা আমরা কেউ করতে চাই না। কঠিন যেহেতু, সেহেতু একটু ব্যয়সাধ্য।”
তবে দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু যেহেতু দর্শক, সেহেতু ‘মানসম্পন্ন’ অনুষ্ঠান বানাতে পারলে বাজেটের অভাব হবে না বলে মত দেন তিনি।
‘গণমাধ্যমে শিশু’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রবল জনপ্রিয়তার এই সময়ে শিশুদের ইন্টারনেটের বাইরে রাখা যাবে না। ফেইসবুকের ‘আক্রমণে’ যাতে পাঠ্যবই হারিয়ে না যায়, সেজন্য তৈরি করতে হবে পর্যাপ্ত কনটেন্ট।
“কনটেন্ট ডেপেলপ করতে পারলে শিশু ও অভিভাবকরা তা পড়ে। আমি মনে করি এখানে আমাদের বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ যে, কনটেন্ট ডেপেলপ করতে হবে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সঞ্চালনায় এ গোলটেবিল বৈঠকে একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুরুল আহসান বুলবুল, ইউনিসেফের কমিউনিকেশন্স স্পেশালিস্ট শাকিল ফয়জুল্লাহ এবং হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সমন্বয়ক নাহার মাওলা ও শিশু সাংবাদিক পৃথা প্রণোদনা আলোচনায় অংশ নেন।
সূচনা বক্তব্যে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “শিশু পরিস্থিতি উন্নয়নে মূল ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই, এটা মোটামুটি স্বীকৃত। সেটা তারা নিচ্ছে বলে দাবি করা হয় বা মনে করা হয়। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত কি না? যথাযথ কি না? এইসব নজরদারিমূলক প্রশ্ন তোলার কথা গণমাধ্যমের।
“কিন্তু যে সব জায়গা থেকে এসব প্রশ্ন উঠতে দেখি আমরা, কিছু বেসরকারি সংস্থা, তাদের অর্থায়ন নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। তাহলে গণমাধ্যম কি তার কাজ সঠিকভাবে করছে না?”
এ আয়োজনে হ্যালোর সঙ্গে থাকা ইউনিসেফের শাকিল ফয়জুল্লাহ তাদের ২০১৪ সালের জরিপের তথ্য দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শিশুদের নিয়ে খবর থাকে মোট খবরের ৩ শতাংশের মত। আর শিশুদের অধিকার নিয়ে খবর হয় মাত্র এক শতাংশ।
তবে এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “আমাদের গণমাধ্যমে শিশু সংক্রান্ত খবর, শিশুদের খবর, শিশুদের নিয়ে খবর- সবগুলো যদি এক করেন, তাহলে শিশুদের জন্য একটা বড় স্পেস আমাদের গণমাধ্যমে আছে।”
শিশুদের সংখ্যার বিচারে সময় ভাগ করে দেওয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিশু বা শিশু অধিকারের বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট ও অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আসরের সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাতায় আলাদা করে শিশুদের জন্য লেখার বিষয় তুলে ধরেন।
মোজাম্মেল বাবু বলেন, “গণমাধ্যম তার কাজে চিলড্রেন পারস্পেক্টিভ আনতে পারে। নিউজ চ্যানেলে এভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কিডজ নামে আলাদা পাতা করতে পারে, কিন্তু মূলধারার টেলিভিশনে শিশুদের আলাদা সেগমেন্ট রাখা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।”
শিশুদের তৈরি খবরও অনেক সময় বড় পরিসরে প্রকাশ হতে পারে মন্তব্য করে বুলবুল বলেন, “শিশুদের পাঠানো খবর যে কেবল ওদের সেকশনের খবর হবে, তা কিন্তু নয়। এডিটরিয়াল ডিসিশনের কারণে আমরা যদি তাদেরকে একটা ভাগে ফেলে দিই, তাহলে অনেক বড় খবর আমরা বাদ দিয়ে দেব।”
এক্ষেত্রে হ্যালোর সাংবাদিকদের করা প্রতিবেদনের কারণে বিভিন্ন সময়ে নানা সামাজিক ও নীতিগত পরিবর্তন আসার উদাহরণ টানেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।
তিনি বলেন, “একটি স্কুলের মাঠ দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না, একটি শিশুর প্রতিবেদনের পর সেটা হয়েছে। একটি স্কুলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদেরকে প্রতিদিন অনুপস্থিতির জন্য ১০০ টাকা করে জরিমানা করা হত, সেটা পরে বাতিল হয়ে গেছে।”
সাংবাদিকতা করতে গিয়ে একজন শিশু হিসেবে যেসব বাধার মুখে পড়তে হয় সে কথাও আলোচনায় তুলে ধরেন পৃথা।
“একজন বড় সাংবাদিক প্রশ্ন করলে যেভাবে উত্তর দেয়, আমরা যখন প্রশ্ন করি, তখন উল্টো প্রশ্ন আসে। আসলে আমরা শিশু সাংবাদিক কি না, পরিচয়পত্র কোথায়, এমন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।… আবার বলা হয় আমরা নাকি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। যদি অবহেলাই করা হয়, তাহলে আমরা কীভাবে আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হব?”
হ্যালোর সমন্বয়ক নাহার মাওলা বলেন, “যেসব বাচ্চার কণ্ঠস্বর আমাদের কাছে আসছে না, প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে মানুষের কথা আসতে পারছে না, তাদের কথা আমাদের শিশু সাংবাদিকরা তুলে আনছে। আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, এখন তারা সব অঞ্চলের খবর তুলে আনছে। হ্যালো বিনোদন পাতা নয়, হ্যালো শিশুদের কণ্ঠস্বর।”
শিশুদের নিয়ে প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে, তাদের গণমাধ্যমের সামনে আনার ক্ষেত্রে যতটা সংবেদনশীল হওয়া উচিৎ, সংবাদমাধ্যমগুলো তা পারছে কি না প্রশ্নও আলোচনায় আসে।
মোজাম্মেল বাবু বলেন, “গণমাধ্যমে শিশুদের দুটো ভাগ করে ফেলতে হবে। শিশু দর্শকদের জন্য গণমাধ্যম কী করতে পারে এটা একটা দিক। শিশুদের জন্য পৃথক গণমাধ্যমও হতে পারে।
“আরেকটা দিক হল, জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু, সেহেতু সকল কিছুতে শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। গণমাধ্যমে শিশুকে কীভাবে দেখাব, বহু কিছু বিবেচনা করতে হবে।”
আগামী নির্বাচনে দলগুলোর ইশতেহারে শিশুদের জন্য আলাদা অধ্যায় রাখার প্রয়োজন বা সুযোগ আছে কি না- সে কথাও আসে আলোচনায়।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “শিশুদের জন্য একটি দলের দৃষ্টিভঙ্গি কী- সেটা ইশতেহারে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।”
গণমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে জনস্বার্থের বিষয় প্রচারে বাধ্যবাধকতা আছে। সেটা সরকার সেভাব করছে কি-না এমন প্রশ্ন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের কাছে রাখেন সঞ্চালক।
জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “শিশুদেরকে শিশু হিসাবে দেখতে চাই না। অবহেলা হোক সেটাও চাই না। ভবিষ্যত হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। এক্ষেত্রে সরকারের অনেক কিছু করার আছে। করতে না পারলে ভবিষ্যত নিয়ে প্রত্যাশা করাটাও ঠিক হবে না। যতটুকু করব, ঠিক ততটুকু প্রত্যাশা করব।
শিশু আইন করাসহ শিশুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা করার ওপর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অবশ্যই আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে।”
শিশুদের সংগ্রহ করা খবর নিয়ে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত ওয়েবসাইট হ্যালোর যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। সংবাদ সংগ্রহ থেকে পরিবেশন পর্যন্ত এর সব কাজেই যুক্ত রয়েছে শিশু ও কিশোর সাংবাদিকরা।
এ পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি শিশু-কিশোর হ্যালোর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছে বলে এর নির্বাহী সম্পাদক মুজতবা হাকিম প্লেটো জানান।
সংবাদভিত্তিক এই ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রশিক্ষিত শিশু সাংবাদিকরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের তত্ত্বাবধানে মূলধারার গণমাধ্যমেও ভূমিকা রাখছে।