‘সংবাদ মাধ্যমকে একে অন্যের দোষ-ত্রুটি ধরতে হবে’

নিজেদের বিকাশের স্বার্থেই সংবাদ মাধ্যমকে একে অন্যের দোষ-ত্রুটি ধরতে হবে বলে মনে করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2016, 06:31 PM
Updated : 13 April 2016, 08:28 PM

বুধবার গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে এক গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এই মত জানান তিনি।

সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদককে এই সম্মাননা দেয় অনলাইন সংবাদপত্র ‘বিবার্তা’।

এছাড়া নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আরও চার ব্যক্তিকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তারা হলেন- বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধ), চলচ্চিত্র অভিনেতা মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক (সংস্কৃতি), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (এটুআই প্রকল্পের প্রধান) কবির বিন আনোয়ার (তথ্যপ্রযুক্তি) ও ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা (খেলা)।

সম্মাননা নেওয়ার পর দেওয়া বক্তব্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে সব গণমাধ্যমের বিকশিত হওয়ার কথা বলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

“আমরা সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা চাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাই। যারা এই প্রতিযোগিতায় থাকবে, তাতে তারা সবাই বিকশিত হবে, উপকৃত হবে- এটা যেন হয়। কখনও কখনও আমাদের কোলাবোরেশন থাকবে। কখন কোলাবোরেশন থাকবে? যখন আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা নিয়ে আক্রমণ হবে, কিন্তু সব সময় সবক্ষেত্রে কোলাবোরেশন থাকবে না।”

একে অন্যের এক দোষ-ত্রুটি তুলে ধরাকে সংবাদ মাধ্যমগুলোর ‘অন্যতম প্রধান কাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সাংবাদিক সংস্থার নীতিমালা উদ্ধৃত করেন বিবিসিতে কাজ করে আসা এই সাংবাদিক।

“সোসাইটি অফ প্রফেশনাল জার্নালিস্ট’ নামে সানফ্রান্সিসকোভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত সব সাংবাদিকরা মিলে এক নীতিমালা তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে অন্য গণমাধ্যম, সংবাদ মাধ্যমের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরা।”

এই চর্চার ক্ষেত্রে বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন,  “আমরা যখন সেই কাজটি করতে যাই, তখন আমাদেরকে বলা হয়- কাক কাকের মাংস খায় না। তখন আমাদের বলা হয়- আমরা ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাজগুলো করছি। ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকবার কারণই নেই- এমন ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাজগুলো করা হচ্ছে।”

সম্মাননাপ্রাপ্তদের সঙ্গে বিবার্তার সবাই

বক্তব্যের শুরুতে সংবাদ মাধ্যম হিসেবে ‘বিবার্তা২৪.নেট’ এর সাফল্য কামনা করেন বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।

“আমি সব সময় একটা কথা বলি, প্রতিদ্বন্দ্বী থাকতে হবে। আপনি প্রিমিয়ার লিগ স্ট্যান্ডার্ডে কোনো ফুটবল লিগ বাংলাদেশে চালু করতে পারবেন না, যদি না অন্তত ২০টি দল থাকে। আমরা সব সময়ই বলি- আমাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়োজন, আমাদের ভালো প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন।”

‘চাই দায়িত্বশীলতা’

সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্বশীল হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “একথা বললে অনেকে মনে করেন, আমি সরকারি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি। আমি কখনোই সরকারি নিয়ন্ত্রণের কথা বলি না।

“রেগুলেশন এবং কনট্রোল-দুটা দুই শব্দ। আমাদের সবাইকে রেগুলেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আইন সবার মানতে হবে।”

দর্শকসারিতে থাকা গণমাধ্যমকর্মী, গণমাধ্যমে বিনিয়োগকারী, গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক, সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা যদি নিজেদেরকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করি, সেটি ঠিক হবে না।

“আমরা কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নই, আমরা গাড়ির সামনে প্রেস লাগিয়ে যা ইচ্ছা, তাই করতে পারি না। কোনো মন্ত্রী, জেনারেল, সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট যখন ট্রাফিক আইন ভাঙেন, আমরা তখন সেটির ছবি ছাপিয়ে দিচ্ছি; একজন সম্পাদক বা সাংবাদিক যদি সেই কাজটি করেন, সেটিও যেন ছাপি।”

টিভি বা মুদ্রিত সংবাদপত্রের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এখন ইন্টারনেটে খবর পড়ছে- এই তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। আমার হাতে ক্ষমতা আছে বলেই আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না।”

কাউকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই সম্পাদক বলেন, “তা না হলে শুধু তার ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, পারিবারিক সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে, সন্তান-সন্ততির মানসিক ক্ষতি হতে পারে। সমাজে সেই ব্যক্তির দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি হতে পারে।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী

তদারকির উপর গুরুত্ব দিলেও বাংলাদেশে তদারককারী সংস্থার দুর্বলতার বিষয়টিও তুলে ধরেন তৌফিক খালিদী।

“আমাদের দেশে রেগুলেটরি কালচারটা অত্যন্ত দুর্বল। আমরা অনেকেই জিনিসগুলো বুঝি না বা শিখি না। রেগুলেটর মানেই বোঝা হয়, তারা ডাণ্ডা ঘোরাবে, ছড়ি ঘোরাবে।”

বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন হলেও সেই স্বাধীনতার দায়িত্বশীল ব্যবহারের পরামর্শও দেন তৌফিক খালিদী।

“গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা যেন এমন কিছু না করি, যাতে সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, একটা মওকা পেয়ে যান যেন একটা বিধি-নিষেধ আরোপ করা সম্ভব হয়। সেই সুযোগ যেন আমরা না দিই।”

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে এখাতে পুঁজি লগ্নির বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন তিনি।

“যে পুঁজিটা আসবে, সেটা স্বচ্ছ হতে হবে। যারা এই গণমাধ্যম পরিচালনা করবেন, তাদের আলমারিতে কঙ্কাল থাকলে সমস্যা হবে। গণমাধ্যমের মালিকানায় সমস্যা আছে, গণমাধ্যম পরিচালনায় যারা রয়েছেন, তাদের সমস্যা আছে। স্বাধীনতায় সমস্যা নেই।”

বাংলাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ সাংবাদিক না থাকা নিয়ে হতাশাও ফুটে উঠে তিন দশক ধরে সাংবাদিকতা পেশায় থাকা তৌফিক খালিদীর কণ্ঠে।

“মাঝে মাঝে যেটা বলি বা বলার চেষ্টা করি বা টের পাই বা যেটা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে কষ্টও পাই- আমাদের দেশে যথেষ্ট সংখ্যক সৎ, শিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মী নেই।”

সংবাদকর্মীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুণগত মানের ব্যবধানও বাড়ছে বলে পর্যবেক্ষণ তার।

“এই ব্যবধানটা বাড়ছে বলে আমার মনে হয়। সেটা নিয়ে এই পেশায় আমরা যারা আছি, তাদের একটা দুঃশ্চিন্তা আছে। অনেকগুলো সংবাদপত্র যখন হয়, টেলিভিশন, রেডিও যখন হয়, শত শত ইন্টারনেট নিউজ পাবলিশার যখন হয়, তখন গুণগত মান নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। আমরা সেটা দেখছি।”

‘সবাইকে বাঁচাতে চাই’

অনুষ্ঠানে রমা চৌধুরী বলেন, ‍“আমি আমার বাংলাদেশকে, বাংলা মাকে, বাঙালিদের খুব বেশি ভালোবাসি। তাদের জন্য কিছু করতে পারিনি। আমি যে বলেছি, ১৬০ বছর বাঁচবো, সত্যিই আমি বাঁচতে চাই। কেন জানেন? এই দেশটাকে গড়বার জন্যে।এই দেশটাকে নিয়ে সবাই সুখী হওয়ার জন্যে।

“আমি নিজে বাঁচতে চাই না শুধু, সবাইকে বাঁচাতে চাই। সবাইকে সুন্দর, সুখী জীবন দিতে চাই। এই ‍মুক্তি সংগ্রাম আমাকে সর্বহারা করেছে, ওই জন্য আমি দুঃখ করি না; আমার যেটুকু আছে, সেটুকুই যথেষ্ট। তাই আমি চাই, কেউ যদি আমাকে আদর করে একটা তৃণ দেয়, তাহলেও আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব। মৃত্যুর পর সোনার মন্দির আমি চাই না।”

সম্মাননা নিচ্ছেন রমা চৌধুরী

অভিনেতা ফারুক বলেন, “এই দেশ এত সহজে কিন্তু স্বাধীন হয়নি। অনেকে বলে থাকি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ হলেন কী করে-এই প্রশ্ন কি কাউকে কেউ করেছেন? কারণ এই বাঙালি হাজার বছর ধরে স্বাধীনতা চেয়েছিল, কেউ করতে পারেনি। একজন করেছেন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।”

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, ওই স্টেজের নিচে আমি আগেরদিন ঘুমিয়েছিলাম। আমি সেই লোক, আমি সেই দুলু। আট বছর বয়সে এই মহান নেতার সান্নিধ্য পেয়েছি।”

সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা থাকার কথা জানিয়ে কবির বিন আনোয়ার বলেন, “আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলাম। মায়ের ইচ্ছায় পড়া শেষ না করেই সিভিল সার্ভিসে যোগ দেই।

“আমাদের একটা জিনিসের অভাব ঘটেছে। সেটা হচ্ছে সাহসের। আমরা নানান রকম টাকা-পয়সা, পদ-পদবি ইত্যাদিতে আমরা আপস করে ফেলি।”

অনুষ্ঠানে বিবার্তা২৪.নেটের চেয়ারম্যান মজিব উদ্দিন আহমেদ, সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসিও বক্তব্য রাখেন।