‘প্রিজম’-এ ভরসা পাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী

ভিডিও নিউজ সার্ভিস প্রিজম উদ্বোধন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি আশা প্রকাশ করছেন, এর মধ্য দিয়ে শিশুরা নিজেরা তৈরি হয়ে দেশকেও এগিয়ে নেবে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2016, 12:04 PM
Updated : 10 April 2016, 12:04 PM

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রিজমে পরিবেশিত খবরের মাধ্যমে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি হবে বলেও ভরসা পাচ্ছেন তিনি।   

বাংলাদেশের শিশুদের খবর শিশুদের মাধ্যমেই নীতি-নির্ধারকদের সামনে মেলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে রোববার যাত্রা শুরু করেছে ‘প্রিজম’।

ইউনিসেফের সহায়তায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই ওয়েবসাইটটি রোববার উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ব্ক্তব্যের শুরুতেই এই উদ্যোগের ভূয়শী প্রশংসা করে তিনি বলেন, “আমি রিয়েলি এক্সাইটেড; আজকের প্রোগ্রামটি খুব দারুণ

“বাংলাদেশে প্রথম যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে ভিডিও নিউজ সার্ভিস প্রিজম; তা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুযোগ। শিশুরা যখন নিজেরাই নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে পারবে, তখন লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।”

সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশার জন্য শিশুরা শৈশবেই প্রস্তুত হলে তা বাংলাদেশকে লক্ষ্যপূরণেও এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।

“সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। আর শিশু বয়সেই যদি তারা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে, তবে আমরা মনে করব, তারা দেশকে এগিয়ে নেবে; তারা দিতে পারবে অনেক কিছু।”

গত এক বছরে বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা ছিল তুমুল আলোচিত। নির্যাতনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে কয়েকটি। 

এসব ঘটনা প্রতিরোধে প্রিজমের ভূমিকা প্রত্যাশা করে মেহের আফরোজ বলেন, “তারা (শিশুরা) নিজেদের সমস্যার কথাও অনেক সময় বুঝতে-জানতে পারে না।

“এখন প্রিজমের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা জানতে পারবে, বুঝতে পারবে; পাশাপাশি অভিভাবকদের বলতে পারবে সমস্যার কথা।”

প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি

শিশু সংবাদকর্মীরা অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণে

এর মধ্য দিয়ে মানবিক গুণাবলি নিয়ে শিশুদের সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার পাঠও হয়ে যাবে বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।

“যখন বুঝবে লেখাপড়া করতে হবে, বড়দের সম্মান করতে হবে। তখন তারা মানবিক গুণাবলি নিয়ে বড় হতে পারবে। নিজেরাই নিজেদের চিনতে করতে পারবে, তারা যখন নেতৃত্ব দিতে আসতে পারবে, তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি পাবে, তখন আমরা এগিয়ে যেতে পারব।”

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশই ১৮ বছরের নিচে এবং তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা ৩২ শতাংশের উপরে- এই তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, “এ সংখ্যাটি আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে সম্পদ।

“তবে শুধু মুখে সম্পদ বললে হবে না। তাদের যদি আমরা কাজে লাগাতে না পারি, অনেক অনেক সুযোগ না দিয়ে যেতে পারি; তাহলে তা অ্যাসেট না হয়ে বার্ডেনে পরিণত হবে।”

# শিশুদের খবর নিয়ে শিশুদের দ্বারা পরিচালিত বিশেষায়িত ওয়েবসাইট ‘হ্যালো’র পর ‘প্রিজম’-এ হাত দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

# সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বাছাই করা শিশুদের গত বছর থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্রডকাস্ট সংবাদকর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিশুরা নিজরাই সংবাদের বিষয়বস্তু ঠিক করে, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা কেবল সহযোগিতা করেন শিশুদের ধারণাকে প্রকাশ করতে।  

# প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা ও বান্দরবানের ১০৫ জন শিশু প্রিজমের সঙ্গে কাজ করছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই উদ্যোগে অচিরেই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার শিশুরা সম্পৃক্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মেহের আফরোজ।

উচ্ছ্বসিত শিশু সংবাদকর্মীরা

প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন শিশু সংবাদকর্মীদের

শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে ‘শিশুদের জন্য এবং শিশুদের নিয়ে’ এ ধরনের উদ্যোগ এ্টাই প্রথম বলে অনুষ্ঠানে জানানো হলে প্রতিমন্ত্রী তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

রাজধানীর গুলশানের বে’স গ্যালারিয়ার রেডিয়াস সেন্টারের এই অনুষ্ঠানে প্রিজমের শিশু সংবাদকর্মী এ এ প্রু মারমা তার অনুভূতির কথা তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, ইউনিসেফের বাংলাদেশ মিশনের উপ-প্রধান ড. লিয়না কুপেনসও বক্তব্য রাখেন।

‘পক্ষপাত নয়, ভারসাম্য রেখো’

শিশু সাংবাদিকদের প্রতি নির্দেশনামূলক বক্তব্যে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী। 

তিনি বলেন, “যেখানেই সংবাদ, যেখানেই অনিয়ম, যেখানেই কিছুর উদ্ভাবন, যেখানেই কেউ ভালো কিছু করার চেষ্টা করেন; সেখানেই আমাদের ছোট্ট বন্ধুরাও থাকবে। খারাপ খবর তো বড় খবরই, তবে তোমাদের প্রচেষ্টা থাকবে ভালো খবরও দেওয়ার।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী

শিশুদের সাংবাদিকতায় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিন দশক ধরে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করে আসা তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

“দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। কারও প্রতি পক্ষপাত করা যাবে না। ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সন্দেহভাজন যে কারোরও সুবিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে; আর জনগণেরও জানার অধিকার রয়েছে কী হচ্ছে- এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই কাজ করতে হবে তোমাদের।”

সংবাদে কারও নাম ব্যবহার করার আগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত কি না, তা যাচাই করার পরামর্শ দেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।

সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলোও শিশু সংবাদকর্মীদের মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে সাংবাদিক হওয়া কঠিন কাজ। রাজনৈতিকভাবে সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে মেরুকরণই এখানে প্রধান সমস্যা। পাশাপাশি রয়েছে দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল গণতন্ত্র ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান এবং বিচার বিভাগও তেমন শক্তিশালী হয়নি।”

চরমপন্থা প্রসারের পাশাপাশি ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতির কারণে এখনকার সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি বেড়ে গেছে মনে করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী। এর মধ্য দিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখান তিনি।

“এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। যেমনটি বরাবরই বলে থাকি- দুর্বল চিত্তের জন্য সাংবাদিকতা নয়।”

‘নতুন ইতিহাসের সূচনা

প্রিজমের উদ্যোগকে ‘নতুন ইতিহাসের সূচনা’ হিসেবে অভিহিত করেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ লিয়ানা কুপেনস।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের শিশুদের জন্য এটি নতুন একটি ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। ইউনিসেফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে যৌথভাবে শিশুদের একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে ব্রডকাস্ট মিডিয়ায় তারা নিজেদের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাতে পারবে।”

লিয়না কুপেনস

কুপেনস মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে শিশুরা তাদের সমাধানে যেমন ভূমিকা রাখতে পারবে, তেমনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারবে এ উদ্যোগ।

“ভিডিও নিউজ সার্ভিস প্রিজমের মাধ্যমে দেশের অবহেলিত অংশের কথা আমরা দেখতে পারব, শুনতে পারব। বাংলাদেশে শিশু অধিকার সুরক্ষার বিষয়টিও এ উদ্যোগে গতি পাবে।”

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের অনলাইন নিউজ পোর্টাল হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রশংসাও করেন ইউনিসেফের এই নারী কর্মকর্তা।

“ইতোমধ্যে তারা মূল ধারা গণমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তাদের কথা টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রচার পাচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, এএফপি, এপি’র উদাহরণ টেনে কুপেনস বলেন, “জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেসব রাজধানী ও বড় শহরে ঘটে তারা সে বিষয়গুলোর কনসেট্রেড করে; সেখানে ‘বিগ মিডিয়া’ যেসব বিষয় অহেলা করে সেখানে পৌঁছানোর সুযোগ এসেছে প্রিজমের।”

বাংলাদেশের সব সংবাদ মাধ্যমকে প্রিজমের সংবাদ ব্যবহারের অনুরোধ করেন তিনি।

‘বলতে চাই অন্য শিশুদের কথাও’

বান্দরবানের শিশু সাংবাদিক এ এ প্রু মারমা অনুষ্ঠানে নিজের অনুভূতি তুলে ধরেন এভাবে।

অনুভূতি জানাচ্ছেন এ এ প্রু মারমা

“ভিডিও সংবাদের মাধ্যমে বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি চলমান বিভিন্ন বিষয়ের কথা তুলে ধরতে চাই আমি। বলতে চাই আমার ভুবনের কথা। বলতে চাই অন্য শিশুদের কথাও। আমি আমার নিজের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার কথা জানাতে চাই।”

এই বক্তব্যে উপস্থিত অতিথিসহ সবার করতালি পান প্রু মারমা।

প্রিজমের যাত্রা শুরুর সঙ্গী হয়েছিলেন কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার বড়ুয়া ও আনজীর লিটন।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর, জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি মো. শফিকুর রহমান, কলামনিস্ট আফসান চৌধুরী, সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান, দেশটিভির সম্পাদক সুকান্ত গুপ্ত অলকও উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানস্থলে কাছে পেয়েই শিশু সাংবাদিকরা ভিডিও-অডিও নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে হাজির হন।

প্রিজমের যাত্রা শুরু

অতিথিদের সঙ্গে প্রিজমের সংবাদকর্মীরা

গাজীপুরের শিশু সাংবাদিক সুমন ভিডিওবার্তা নেন প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকেও।

উচ্চ মাধ্যমিকের এ শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রিজমে কাজ করে খুব ভালো লাগছে। অনেক কিছু শিখছি। আমরা সবার কথা তুলে ধরতে চাই, ভূমিকা রাখতে চাই সিদ্ধান্ত গ্রহণেও। ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা বড় হতে কাজ লাগবে।”

ঢাকার শিশু সাংবাদিক ইভান সাক্ষাৎকার নেন ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া ও আনজীর লিটনের।

ইভান বলেন, “সুযোগ পেয়েই আমাদের বন্ধুদের জন্য শ্রদ্ধেয়জনদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। তাদের শৈশবের কথা জানতে চেয়েছি। শিশুদের মনোবিকাশে এ সাক্ষাৎকার ভূমিকা রাখবে, নতুন জীবন গড়তে পথ দেখাবে।”