আমের মৌসুমে শিবগঞ্জ

পথের দুপাশে সারিবন্দী আম গাছ। ডালে ডালে ঝুলে আছে কাঁচাপাকা আম। কোনো কোনো গাছ আমের ভারে মাটি ছুঁইছুঁই ডাল। বাগান জুড়ে চাষীদের ব্যস্ততার কমতি নেই। কেউ বাগান পাহারায়, কেউ আম পাড়ায় ব্যস্ত, কেউ আবার সেগুলো বাজারে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করছেন। এ সময়ে আমের হাটগুলোও সরগরম।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2015, 12:17 PM
Updated : 3 July 2015, 12:22 PM

রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের সর্বত্রই এখন এই চিত্র।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমের চাষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। আর এ জেলার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আমের চাষ হয় শিবগঞ্জে। জেলার সবচেয়ে বড় দুটি আমের হাটও বসে এই অঞ্চলে। আম ছাড়াও শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে আছে প্রাচীন গৌড়ের নানান ঐতিহাসিক স্থাপনা। আমের এই মৌসুমে তাই ঘুরে আসুন শিবগঞ্জ থেকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকেই আমবাগানের শুরু। শহর ছেড়ে মহানন্দা সেতু পার হয়ে ওপারের পিচঢালা পথ গিয়ে শেষ হয়েছে সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে। আম বাগান দেখার জন্য দীর্ঘ এই সড়কেই দুই পাশই উপযুক্ত জায়গা। এ পথের দুই ধারে শুধুই আম বাগান। আর বাগানের বেশিরভাগই বেশ পুরানো, গাছগুলোও বড় বড়। বেশিরভাগ বাগানেই এখনও আমে ভরপুর। পছন্দ মতো যে কোনো বাগানেই ঢুকে পড়তে পারেন। তবে আগে অনুমতি নিয়ে নিন।

এ পথে চলতে চলতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার গেলে সড়কের উপরেই পড়বে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাজারে চলে আমের বিকিকিনি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পাইকারী ক্রেতা এ বাজারে আসেন আম কিনতে। সাইকেল কিংবা রিকশা ভ্যানে বোঝাই করে আম নিয়ে গভীর রাত থেকেই এ বাজারে জড়ো হতে থাকেন আমচাষীরা।

কানসাটে আমের হাট। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

আমের মৌসুমে সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে হাট বসে। তবে সবচেয়ে বড় সমাগম হয় সড়ক থেকে একটু ভেতরে, মাদ্রাসা মাঠে। বিশাল খোলা মাঠে এখানে আম চাষীরা সমবেত হন সাইকেল আর রিকশা ভ্যান বোঝাই করে আম নিয়ে। প্রতিদিন সকালে এ আমের বাজারের বিস্তৃতি সড়কের উপরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে হয়।

কানসাট বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাগলা নদী। এক সময়ের প্রমত্তা নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর উপরে সেতু পেড়িয়ে ওপারে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে আরেকটি বড় আমের বাজার বসে। নাম চামা বাজার। এ পথের দুপাশেও বড় বড় আমের বাগান।

সোনা মসজিদ

আম বাগান আর বাজার দেখে সোজা চলে যেতে পারেন সোনা মসজিদ স্থল বন্দরের দিকে। কানসাট আম বাজার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে সড়কের পূর্ব পাশে দেখা যাবে সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোটসোনা মসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়।

প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক  মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায়নি। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।

মসজিদের পূর্বপাশের সমাধিক্ষেত্রের ভেতরে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি আছে। এখানে কারা সমাহিত রয়েছেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে সমাধি দুটিতে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে  জনশ্রুতি আছে।

তাহখানা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

তাহখানা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পূর্বকোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে। যার একটিতে সমাহিত আছেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।

সোনা মসজিদের পশ্চিম পাশে বিশাল একটি দিঘির পাড়ে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সর্ব দক্ষিণেরটি হল তাহখানা। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। ভবনটির লাগোয়া পূর্ব দিকে আছে দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল। এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহশুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তার বসবাসের জন্য। আবার কারও কারও মতে শাহশুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।

তাহ্‌খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ। এর পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চারপাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদের পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদের নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগ দখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।

মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গা জুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনি। মাঝখানে মূল সৌধটির চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশ কিছু কবর। দিল্লীর করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহশুজা তখন বাংলার সুবাদার। শাহশুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।    

দরসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ

সোনা মসজিদ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

দরসবাড়ি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

তাহখানা থেকে সামনে সোনামসজিদ স্থল বন্দরের আগে সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ। চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙিনার চারপাশ ঘিরে ছিল তিন মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। দরসবাড়ি মাদ্রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় এই মসজিদ।

মসজিদের ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট সম্বলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের স্তম্ভগুলি। কারুকার্য খচিত মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের মিহরাবগুলো এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

দরসবাড়ি থেকে সামান্য উত্তরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। এখানে ছোট সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতের প্রবেশ পথটিও একটি প্রাচীন স্থাপনা। এর নাম কোতওয়াল দরজা। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়াল এর অনুকরণে এর নামকরণ।

এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশ পথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলি দিয়ে শত্রুর ওপরে গুলি কিংবা তীর ছোড়া হত বলে ধারণা করা হয়। কোতোয়ালি দরওয়াজাটি সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।

সোনামসজিদ স্থল বন্দর থেকে পূর্ব দিকের সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আম বাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই মসজিদ। ইটের তৈরি মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট। বারান্দা থেকে মূল প্রার্থণা কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। খনিয়াদিঘি মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যিক রীতির বিচারে ঐতিহাসিকগণ এটিকে পরবর্তী ইলিয়াস ইলিয়ামশাহী আমলে ১৪৮০ সালের দিকে নির্মিত বলে মনে করেন। মসজিদের পূর্ব দিকেই রয়েছে রয়েছে প্রাচীন আমলের খনিয়াদিঘি। এ কারণেই এরকম নামকরণ। তবে এ মসজিদের অন্য একটি নাম হল রাজবিবি মসজিদ।

কানসাটের আমের বাগান। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে আম বাগানের ভেতরে অবস্থিত আরেকটি প্রাচীন স্থাপনা ধুনিচক মসজিদ। ইটের তৈরি এ মসজিদ আয়তকার। মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই। তবে নির্মাণশৈলী বিবেচনায় এ মসজিদও পনের শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।    

কীভাবে যাবেন

রাজধানী থেকে সরাসরি বাসে যেতে পারেন কানসাট। এছাড়া বাসে জেলাশহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছে সেখান থেকে উপরের জায়গাগুলোতে যাওয়া যায়।

ঢাকার গাবতলী থেকে সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যায় দেশ ট্রাভেলসের এসিবাস। ভাড়া ১ হাজার ১শ’ টাকা। এছাড়া দেশ ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহনের নন এসি বাস যায় সরসরি কানসাট বাজার, ভাড়া ৫৬০ টাকা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাওয়ার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৪৫ থেকে ৬৫ টাকা। তবে জায়গাগুলোতে ভ্রমণের জন্য জেলা শহর থেকে অটো রিকশা ভাড়া নেওয়া ভালো।

শহর থেকে সারা দিনের জন্য একটি মাহেন্দ্রা অটো রিকশার ভাড়া ১ হাজার ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা।   

কোথায় থাকবেন

শিবগঞ্জ কিংবা কানসাটে থাকার ভালো ব্যবস্থা সেই। সারাদিন ঘুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে এসে থাকতে হবে। এ শহরে সাধারণ মানের হোটেল হল শান্তির মোড়ে হোটেল আল নাহিদ, আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী, লাখেরাজপাড়ায় হোটেল রাজ, একই এলাকায় হোটেল রংধনু। এসব হোটেলে ২শ’ থেকে ২ হাজার টাকায় কক্ষ আছে।