বাংলাদেশের উত্তরের এই জেলায় নানান দর্শনীয় স্থানের জন্য সমৃদ্ধ। আমের এই মৌসুমে বেড়িয়ে আসতে পারেন জেলা শহর রাজশাহী থেকে।
এ ভ্রমণের শুরু করুন রাজশাহী শহর থেকে। সকালের নাস্তা সেরে একটু ঘুরে দেখতে পারেন পুরনো এ শহর। বাইপাস সড়ক ধরে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করলে নওদাপাড়া এলাকার চৌরাস্তায় আছে আমের ভাস্কর্য। বিশাল ঝুড়ির মধ্যে রাখা আম চত্ত্বরের তিনটি পাকা আম যেন আমের শহরেই স্বাগত জানাচ্ছে।
পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ শহরের উত্থান। আগে এ জেলার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। ১৮২৫ সালে সেটি নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। রেশম উৎপাদন কেন্দ্র এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী শহর হওয়ায় ইংরেজ বণিকদের সহজেই নজর কাড়ে রাজশাহী। পর্যায়ক্রমে ওলন্দাজ, ফরাসি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এ শহরে। ওলন্দাজ রেশম কারখানার ভবনটি ছিল বড়কুঠি নামে পরিচিত।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয় সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদর দফতর বসেছিল বড়কুঠিতে। উনিশ শতকের শেষ দিকে বড়কুঠি ব্রিটিশদের নিকট থেকে মেদিনীপুর জমিদার কিনে নেয়। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর একে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের গুদামঘর করা হয়।
১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড় কুঠি হয় উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়। শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলো হলো শাহেববাজর, রানীবাজার, রেশম পট্টি, ঘোড়ামারা, হাতেমখানা, দরগাপাড়া, কুমারপাড়া, বোয়ালিয়া ইত্যাদি।
১৮৭৬ সালে রাজশাহী পৌরসভা ও ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় রাজশাহী শহর।
শহর ঘুরে চলে যেতে পারেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে। এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্তিক গুরুত্ব সম্পর্কে সাম্যক ধারণা মিলবে এখান থেকে। রাজশাহী সদর হাসপাতালের সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামাপ্রসাদ চন্দ্র পুমখ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৬ সালে মূল জাদুঘর ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। ১৯৬৪ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের দায়িত্ব বর্তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আটটি গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, প্রায় এক হাজার পোড়ামাটির ফলক ছাড়াও হাজারও নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, নভেম্বর থেকে মার্চ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। শুক্রবার খোলা থাকে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর দেখে চলে যান শাহ মখদুমের (র) সমাধি সৌধে। রাজশাহী সরকারী কলেজের কাছে দরগা পাড়ায় শায়িত আছেন দরবেশ শাহ মখদুম (র)। ১২৮৭ সালে তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আসেন। ১৩১৩ সালে চিরকুমার এ দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। আলীকুলী বেগ নামে তার এক অনুসারী ১৬৩৫ সালে তার সমাধির উপরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট সৌধ নির্মাণ করেন। প্রতিবছর আরবী মাসের ২৭ রজব এখানে উরস অনুষ্ঠিত হয়। আর ১০ মহররম এখান থেকে বের হয় তাজিয়া মিছিল।
দুপুর পর্যন্ত এ এলাকাগুলো বেড়াতে পারেন। দুপুরের খাবার শেষে বেড়াতে আসুন বিসিক শিল্প এলাকায়। শহরের এ শিল্প এলাকায় আছে বেশ কিছু রেশম শিল্প। এখানকার সফুরা রেশম কারখানায় দর্শনার্থীদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই। পোকা থেকে রেশম তৈরির বিভিন্ন পর্যায় দেখতে পাবেন এখানে। তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে রেশমের কাপড়ও কিনতে পারবেন।
সফুরা দেখে চলে যেতে পারেন মুক্তি যুদ্ধের স্থাপনা স্মৃতি অম্লানে। শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায় এটির অবস্থান। স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদের এ নকশায় ১৯৯১ সালের ২৬ শে মার্চ এর উদ্বোধন হয়। সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে ২৪টি করে ধাপ। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তন ও স্বাধীনতার ফসল।
প্রতিটি স্তম্ভে ১০টি করে মোট ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে। বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে। সৌধের চূড়ায় আছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আছে সুবর্ণজয়ন্তী টাওয়ার, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি ইত্যাদি। সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে দেখে নিতে পারেন এসবকিছুই।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে রাজশাহী যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে দেশ ট্রাভেলস ও গ্রীন লাইন পরিবহনের এসি বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা।
এছাড়া ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যমলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, বাবলু এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা।
ঢাকার কমলাপুর থেকে রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস। ভাড়া শোভন চেয়ার সাড়ে ৩শ’ টাকা, স্নিগ্ধা ৬০৪ টাকা, এসি সিট ৭২৫ টাকা, এসি বার্থ ১ হাজার ৮১ টাকা।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ (সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ হাজার ৩শ’ টাকা)। ইউনাইটেড এয়ারের (সর্বনিম্ন ভাড়া ৪ হাজার ২৫০ টাকা) বিমান চলাচল করে রাজশাহীতে।
কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। শহরের চিড়িয়াখানার পাশে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল (০৭২১-৭৭৫২৩৭)। ঢাকার পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় (০২-৮৮৩৩২২৯, ৮৮৩৪৬০০) থেকেও এ হোটেলের বুকিং দেয়া যায়। এ হোটেলের এসি একক কক্ষ ১ হাজার ৯শ’ টাকা। এসি দ্বৈত কক্ষ ২ হাজার ৬শ’ টাকা। সুইট ৪ হাজার ৬শ’ টাকা।
রাজশাহী শহরের অন্যান্য হোটেল হল গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭৬১৮৮)। শিরোইলে হোটেল হকস্ ইন্ (০৭২১-৮১০৪২০)। সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭১১০০)। বিন্দুর মোড়ে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৮১১৪৭০)। মালোপাড়ায় হোটেল শুকরান (০৭২১-৭৭১৮১৭) ইত্যাদি। এসব হোটেলে ৫শ’ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় কক্ষ আছে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
এই সময়ে রাজশাহীতে প্রচণ্ড গরম। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও বেশি হয়। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে বলে গরমও বেশি অনুভূত হয়। তবে মাঝে মধ্যে বৃষ্টি গরম থেকে স্বস্তি দেবে। এ ভ্রমণে তাই হালকা সুতির কাপড় পরা ভালো। সঙ্গে ছাতা, রোদ টুপি, রোদ চশমা ইত্যাদি নিতে ভুলবেন না।