জ্বর যখন টাইফয়েড

এই ব্যাকটেরিয়াজনিত পানিবাহিত রোগ থেকে হতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানী। আমাদের দেশে গরমের দিনে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে।

মামুনুর রশীদ শিশিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2015, 10:33 AM
Updated : 2 June 2015, 10:36 AM

টাইফয়েড সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন ফাস্ট কেয়ার হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

কারণ

টাইফয়েড একটি মারাত্মক পানিবাহিত রোগ। দুই ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে। ‘সালমোনেলা টাইফি’ এবং ‘সালমোনেলা প্যারাটাইফি’। সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে হয় টাইফয়েড জ্বর বা ‘এন্টারিক ফিভার’ আর সালমোনেলা প্যারাটাইফির সংক্রমণে হয় প্যারা টাইফয়েড জ্বর।”

সালমোনেলা টাইফি শরীরের বৃহদান্ত্রে আক্রমণ করে। দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়াও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদাসীনতার কারণেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তবে শরীরে সালমোনেলা টাইফি থাকলেই যে টাইফয়েড বা এন্টারিক ফিভার হবে তা নয়। এই ব্যাকটেরিয়া শরীরের পিত্তথলিতে জমা থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই কেবল আক্রমণ করে।

লক্ষণ

টাইফয়েডের প্রধান উপসর্গ হল দীর্ঘমেয়াদি জ্বর।

ডা. কামরুল হাসান বলেন, “২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পরপর বাড়ে টাইফয়েড জ্বর। জ্বরের এই আচরণকে ডাক্তরি ভাষায় বলা হয় ‘স্টেপ ল্যাডার প্যাটার্ন’। জ্বরের সঙ্গে মাথা ব্যথা, হাত-পায়ে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, কাশি, পেট ব্যথা ইত্যাদিও থাকতে পারে।”

জ্বর পাঁচ দিনের বেশি স্থায়ী হলেই টাইফয়েড সন্দেহ করা হয়। সাধারণত জ্বর হলে ধমনি স্পন্দন বেড়ে যায়। তবে টাইফয়েড জ্বরের আরেকটি বিশেষ লক্ষণ হল জ্বর বাড়লে ধমনি স্পন্দন কমে যায়।

ডা. কামরুল জানান, ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় ‘রিলেটিভ ব্লাডিগারি’। রোগের তীব্রতা বেশি হলে বিভিন্ন স্নায়বিক সমস্যাও হতে পারে।

ডায়বেটিসের উপর প্রভাব

ডায়বেটিস হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই অন্যান্য সব রোগে মতোই ডায়বেটিস রোগীদের টাইফয়েড হলেও রোগের তীব্রতা বেশি হয়। এছাড়া অন্য কোনো জটিলতা নেই।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

টাইফয়েডের কারণে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। সালমোনেলা টাইফি জীবাণু যেহেতু পিত্তথলিতে জমা থাকে, তাই পিত্তথলিতে প্রদাহ হতে পারে। একে ‘কোলিসিস’ বলা হয়।

বৃহদান্ত্রে এই জীবাণুর আক্রমণের কারণে বৃহদান্ত্রে ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। এক বলা হয় ‘পারপোলেশন’। সেখান থেকে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণও হতে পারে। আবার হাড়ে আক্রমণ করলে আথ্রাইটিস হতে পারে।

মস্তিষ্কে সংক্রমণের কারণে মেনিনজাইটিস হতে পারে। বমি বা পাতলা পায়খানার কারণে শরীরে লবণের তারতম্য হয়, যা যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

প্রতিরোধ

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই টাইফয়েড থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র। যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন তাদের প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় খেতে হয়। ভ্রমণে বিশুদ্ধ পানি পান এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সবসময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তাই টাইফয়েডের ঝুঁকি বেশি থাকে তাদের। বাইরের খাবার খাওয়া এবং পানি পান করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। খাওয়া আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত।

টাইফয়েডের টিকা সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন, “সম্প্রতি টাইফয়েডের টিকা বের হয়েছে, তবে তা পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত করে না।”

তিনি জানান, টিকা হিসেবে দুটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। অনেকসময় বাড়তি সাবধানতা হিসেবে মুখে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হতে পারে। টিকা নেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় বা নিয়ম নেই, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী টিকা নিতে হবে।

তবে যেসব অঞ্চলে টাইফয়েড হওয়ার ঝুঁকি আছে সেসব অঞ্চলে যাওয়ার আগে টিকা নেওয়া জরুরি। টিকা নিতে যেতে পারেন রাজধানীর মহাখালিতে অবস্থিতি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ(আইসিডিডিআরবি)তে। তবে অন্যান্য ভালোমানের হাসপাতালগুলোতেও টিকা নিতে পারবেন।

রোগ সনাক্তকরণ

টাইফয়েড হয়েছে এরকম সন্দেহ হওয়ার সাতদিন পর ‘ব্লাড কালচার’ করার মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করা হয়। পরীক্ষা করতে সাধারণত তিন দিন সময় লাগে।

চিকিৎসা

টাইফয়েডের মূল চিকিৎসা হল ১৪ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স। রোগ সনাক্ত করার সময় যে ব্লাড কালচার করা হয় সে সময় রোগীকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে তা ঠিক করা হয়।

রোগীর শরীর থেকে সংগৃহীত রক্তে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দেখা হয় ওই নির্দিষ্ট রোগীর জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হবে। তবে অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে।