রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ

বন্যপ্রাণীর এই অভয়ারণ্যে নানারকম বন্যপ্রাণী আর পাখি। তাদের বিচরণ দেখতে হলে যেতে পারেন ভ্রমণে।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2015, 10:09 AM
Updated : 15 May 2015, 10:13 AM

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পাহাড়ি বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা। সুন্দরবনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক এই বন ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত।

প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমি বিস্তার লাভ করতে শুরু করে ১৯৪০ সালের দিকে। তবে রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮২ সালে। ১৯৯৬ সালে এ বনের সম্প্রসারণ করা হয়। বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের চারটি বিটের (কালেঙ্গা, রেমা, ছনবাড়ী আর রশিদপুর) মধ্যে রেমা, কালেঙ্গা আর ছনবাড়ী বিস্তীর্ণ জঙ্গল নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গঠিত। রয়েছে বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা। এখানকার পাহাড়গুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬৭ মিটার।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মও আছে।

রেমা-কালেঙ্গার বনে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালীর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালীর একমাত্র বসবাস এ বনেই। তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতী’র দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এছাড়াও আছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। বনের ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি।

রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্যান। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙ্গা, ঈগল, চিল ইত্যাদি।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা ও তিন ঘন্টার তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। অভয়ারণ্যের ভেতরে আছে সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের মাথাটি বনের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথা ভেদ করে আকাশে উঁকি মেরেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তাই দেখা যায় বনের ভেতরের দূর-দূরান্তের দৃশ্যাবলী। টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।  

বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনধারাও দেখা যেতে পারে এখানে। রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরেই আছে চারটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের কয়েকটি পাড়া আছে এ বনের ভেতরেই। এছাড়াও সাঁওতাল,  তেলুগু ও উড়ং আদিবাসীরও বসবাস আছে।

রেমা-কালেঙ্গার জঙ্গলে লাল বুক টিয়া। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

রেমা-কালেঙ্গা বনের ভেতরে বিজিবি ক্যাম্প ফেলে কিছুদূর সামনে এগুলেই পাওয়া যাবে মুক্তিযদ্ধে শহীদ নায়েক আব্দুল মান্নান বীর উত্তমের কবর। তিন নম্বর সেক্টরের এই যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পাক হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে এখানেই শহীদ হন। তাঁর কবরের পাশের বিশাল সেগুন গাছের শরীরে এখনও দেখা মেলে পাক হানাদারদের সেদিনের গুলির চিহ্ন।

কীভাবে যাবেন

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে দুভাবে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে অটোরিকশা চেপে যেতে হবে কালেঙ্গা। বাসে সায়েস্তাগঞ্জের ভাড়া আড়াইশ থেকে ৩শ’ টাকা।

শায়েস্তাগঞ্জে থামে সিলটগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টা মিনিটে ছাড়ে এই ট্রেন। ভাড়া ১২০ থেকে ৬৭৩ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গার বেবি টেক্সি ভাড়া ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা।

কালেঙ্গা যাওয়ার অন্য পথটি হল— ঢাকা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে জিপে চড়ে কালেঙ্গা। শ্রীমঙ্গল থেকে গেলে  জঙ্গলের ভেতরের দীর্ঘ পথটি চলতে ভালো লাগবে সবার।

রেমা-কালেঙ্গার জঙ্গলে রঙ্গিলা চ্যাগা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন ইত্যাদি বাস শ্রীমঙ্গল যায়। ভাড়া সাড়ে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা।

ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। আর বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস।

শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস।

শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪০ থেকে ৯৪৩ টাকা।

শ্রীমঙ্গল থেকে কালেঙ্গার জিপ ভাড়া দুই থেকে তিন হাজার টাকা। বর্ষা মৌসুমে দুটি পথই বেশ কর্দমাক্ত থাকে বলে চলতে অসুবিধা হতে পারে।

কোথায় থাকবেন

রেমা-কালেঙ্গার জঙ্গলে বড় কাঠ বিড়ালী। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন।

কালেঙ্গায় থাকার জন্য আছে বন বিভাগের বিশ্রামাগার। সেখানে অবস্থান করতে হলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে। তবে এই জায়গায় থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হল নিসর্গ তরফ হিল কটেজ (০১৭৩১৯৭৭৮০৭)। এর পরিচালক আব্দুর রহমান লাশু। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমের প্রধান প্রবেশ পথের পাশে অবস্থিত এ কটেজের তিনটি কক্ষে আট জন থাকা যায়। বড় দুটি কক্ষের ভাড়া এক হাজার টাকা আর ছোটটির ভাড়া ৭শ’ টাকা। প্রতিবেলা খাবারের খরচ জনপ্রতি ২শ’ টাকা। আর সকালের নাস্তা ৬০ টাকা।  

প্রয়োজনীয় তথ্য

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে ভ্রমণে অবশ্যই সঙ্গে গাইড নেওয়া উচিত। ইকো গাইড আব্দুর রহিম (০১৭৪১১৪৪১৭৪) এখানকার দক্ষ গাইডদের একজন। আগে থেকে যোগাযোগ করলে সায়েস্তাগঞ্জ কিংবা শ্রীমঙ্গল থেকেই পর্যটকদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন তিনি।