মাধবকুণ্ডু ইকোপার্ক

জলপ্রপাত আর চা বাগানের রূপ উপভোগ করতে চাইলে যেতে হবে বর্ষায়।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2015, 12:00 PM
Updated : 3 May 2015, 10:05 AM

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলিতে অবস্থিত মাধবকুণ্ডু ইকোপার্ক।  মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখার আট নম্বর দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের গৌরনগর মৌজার পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে দুটি ঝরনাকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই উদ্যান সিলেট সদর থেকে ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হল মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত, পরিকুণ্ডু জলপ্রপাত, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের মন্দির এবং কিছু চা বাগান। পাহাড়ের ঢালে ঢালে নানান গাছগাছালিতে ঢাকা মাধকুণ্ডু ইকোপার্কের সৌন্দর্যও অতুলনীয়। 

এই ইকোপার্কের প্রধান আকর্ষণ মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত। পাথারিয়া পাহাড়ের উপর থেকে অবিরাম বয়ে চলে গঙ্গামারা ছড়া। এই ছড়ার পানি মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে। প্রায় ২৭০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া এই জলপ্রপাত সারা বছরই একটি মূল ধারায় বহমান থাকে। তবে বর্ষার শুরুতে পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ধারার তৈরি হয়। ভরা বর্ষায় দুটি ধারাই মিশে পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। জলপ্রপাতের ধারাটি যেখানে পড়ে সে জায়গায় বেশ গভীর একটি গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখান থেকে মাধবের ছড়া হয়ে পশ্চিমে বয়ে চলা পানির ঠাঁই হয় হাকালুকি হাওরে।

মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাতের নামকরণ নিয়ে নানান কাহিনী প্রচলিত আছে লোকমুখে। কথিত আছে রাজা গঙ্গাধ্বজ পাথারিয়া পাহাড়ে বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে সেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি ওই সন্ন্যাসীর পদবন্দনা করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশসহ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশ তিথিতে এ কুণ্ডে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মধাব নামে দৈববাণী হয়। এ থেকেই মাধবকুণ্ডু নামের উৎপত্তি বলে প্রচলিত আছে।

আবার কারও কারও মতে, মহাদেব বা শিবের পূর্বনাম মাধব এবং এর নামানুসারে তার আবির্ভাব স্থানের নাম মাধবকুণ্ডু। এ কুণ্ডুর পাশেই আছে শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের শিবমন্দির। যে পাহাড় থেকে মাধবকুণ্ডু ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে। এর রয়েছে দুটি অংশ। উপরের অংশের নাম গঙ্গামারা ছড়া আর নিচের অংশের নাম মাধবছড়া।

মাধবকুণ্ডু ইকো পার্কের প্রধান ফটক ফেলে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ হাঁটার পরে জলপ্রপাতে এসেই রাস্তা শেষ হয়েছে। জলপ্রপাতের কাছেই আছে একটি খাসিয়া পুঞ্জি। খাসিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছোট্ট এই গ্রাম ছবির মতো সুন্দর।   

মাধবকুণ্ডু ঝরনার কিছুটা আগে শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের মন্দিরের বিপরীত দিকে একটি ছোট ঝিরি পথ চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। সামান্য সামনে গিয়ে এটি শেষ হয়েছে পরীকুণ্ডু জলপ্রপাতে। সবুজে ঢাকা একটি খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবাহিত হওয়া এই ঝরনার সৌন্দর্য মাধবকুণ্ডুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবে এটি কেবল বর্ষাকালেই প্রাণ ফিরে পায়।

ঝিরি পথ পেড়িয়ে পরীকুণ্ডু যাওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য। এ কুণ্ডুতে পানির প্রবাহ থাকলে ঝিরিপথের পাথরগুলোতে শ্যাওলা জমে। তাই এপথে চলতে হবে সাবধানে।

কখন যাবেন

মাধবকুণ্ডু ইকোপার্কে সারা বছরই ভ্রমণে যাওয়া যায়। তবে ভালোভাবে জলপ্রপাত দেখতে চাইলে জুন থেকে অগাস্টের মধ্যে যেতে হবে।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে মাধবকুণ্ডু ট্রেনে যাওয়া সহজ।  এপথে এলে কুলাউড়া স্টেশনে নেমে সেখান থেকে মাধবকুণ্ডু যেতে হবে।

কুলাউড়া রেলস্টেশন থেকে মাধবকুণ্ডুর দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ০৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস।

ভাড়া: সুলভ ১৩০, শোভন ২১৫, শোভন চেয়ার ২৫৫ টাকা, প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৩৪০, প্রথম শ্রেণি বার্থ ৫১০, স্নিগ্ধা ৪৮৯, এসি সিট ৫৮৭ এবং এসি বার্থ ৮৮০ টাকা।

এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া সুলভ ১৫৫, শোভন ২৫৫, শোভন চেয়ার ৩০৫, প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৪১০, প্রথম শ্রেণি বার্থ ৬১০, স্নিগ্ধা ৫৮৭, এসি সিট ৭০২ এবং এসি বার্থ ১০৫৩ টাকা।

ঢাকা থেকে সড়ক পথে মৌলভীবাজার সদর ও সিলেট সদর থেকেও বাসে মাধবকুণ্ডু যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

এ ভ্রমণে থাকতে পারেন কুলাউড়া উপজেলা সদর কিংবা মৌলভীবাজার সদরে। এছাড়া শ্রীমঙ্গল, সিলেট থেকেও দিনে দিনে ঘুরে আসা যায় মাধবকুণ্ডু থেকে।

মৌলভীবাজার শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শ্রীমঙ্গল রোডে হোটেল সোনাগাঁও (০৮৬১-৬৪৬০৭)। শহরের কুসুমবাগে হোটেল শেরাটন প্লাজা (০৮৬১-৫২০২০)। সাইফুর রহমান রোডে হোটেল হেলাল (০৮৬১-৫২৫৩৫)। এসব হোটেলে প্রতিদিন ৩শ’ থেকে দেড় হাজার টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

মাধবকুণ্ডু ইকোপার্কে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাঁচ টাকা। বিদেশী পর্যটক এক মার্কিন ডলার সমমূল্যের টাকা।

এছাড়া বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দর্শনার্থী ৩০ থেকে ১শ’ জনের দলের জন্য ১শ’ টাকা, ১০১ থেকে ২শ’ জনের দলের জন্য ২শ’ টাকা।

মাধবকুণ্ডু ঝরনার নিচে গোসলে নামা বিপজ্জনক। জায়গাটি বেশ গভীর বলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকে মনে করেন এই জায়গায় চোরাবালিও আছে। এছাড়া মাধবকুণ্ডু জলপ্রপাত বেশ খাড়া। তাই পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠাও বিপদ ডেকে আনতে পারে। 

ছবি: লেখক।