জার্মানিতে নিরামিষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে

গত কয়েক দশক আগেও চিত্রটা ছিল ভিন্ন রকম৷ স্বচ্ছল পরিবারগুলোতে খাদ্যতালিকায় মাছ-মাংসের আধিক্য লক্ষ করা যেত৷ মনে করা হত শাকসবজি তো বটেই এমনকি মাছও গরিবের খাবার৷

রায়হানা বেগম, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2015, 01:41 PM
Updated : 21 April 2015, 10:53 AM

তবে যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন মানসিকতা ও জ্ঞানেরও প্রসার ঘটেছে৷ বেশি মাংস খাওয়া যে ভালো নয় সেটা বুঝতে পারছেন অনেকেই৷ সেই সঙ্গে পশু পাখির প্রতি মায়া মমতাও বৃদ্ধে পাচ্ছে৷

জার্মানির প্রায় সব রেস্তোঁরায় নিরামিষ খাবার পাওয়া যায় এখন৷ আগে নিরামিষ খাবার চাইলে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাতেন ওয়েটার৷ আর এখন ফাস্ট ফুডের রেস্তোঁরাগুলোও পিছিয়ে নেই৷ সেখানেও স্যালাদ, ভেজিবার্গার ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে৷

মাংস খাওয়া কমানোর পেছনে নানান কারণ রয়েছে৷ বিভিন্ন মিডিয়ায় পুরানো বা পচামাংস বিক্রির খবর উঠে আসে মাঝে মধ্যে৷ এজন্য অনেক জার্মান মাংস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷ এছাড়া বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে জানা যায় উচ্চরক্তচাপ, বহুমূত্র ও হৃদরোগের মতো অসুখও দেখা দেয় বেশি রেডমিট খেলে৷

পশু পাখির প্রতি মায়া মমতা থেকেও অনেকে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন৷ প্রাণী হত্যা করার আগে স্বল্প পরিসরের খাঁচায় আটকে রাখা হয়৷ ঠাঁসাঠাঁসি করে থাকায় রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হতে হয় তাদের৷ এসব কারণেও অনেকে মাংস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷

নিরামিষাশী হওয়ার আরেকটি কারণ হল পরিবেশ সংরক্ষণ৷ নিরামিষের তুলনায় মাংস উৎপাদনে খরচ হয় অনেক বেশি৷ দূষিত হয় পরিবেশ৷ তাই এই দৃষ্টিকোণ থেকেও শাকসবজির দিকে ঝোঁকেন অনেকে৷

প্রায় ৪২ মিলিয়ন জার্মান মাঝে মাঝে মাংস খাওয়া বাদ দেন৷ রান্না করেন শাক-সবজি ও তরকারি৷ শাক-সবজির ব্যাপারে যে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা বোঝা যায় নিরামিষসংক্রান্ত ইন্টারনেট ফোরাম, ব্লগ ও রান্নার বইয়ের ছড়াছড়ি দেখে৷ চারিদিকে গড়ে উঠছে নিরামিষাশীদের সংগঠন৷ তারা ‘ভেজিটেরিয়ান ডে’ অর্থাৎ সপ্তাহে অন্তত একদিন বিভিন্ন রেস্তোঁরা, স্কুল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনে শুধু নিরামিষ খাবার পরিবেশন করার প্রস্তাব দিচ্ছেন৷

সবুজ দল প্রস্তাবটি লুফে নিলেও বিরুদ্ধবাদীদের কন্ঠও এব্যাপারে সোচ্চার৷ তারা খাবারের ওপর খবরদারি করাটা পছন্দ করেন না৷ এক্ষেত্রে জার্মানদের মধ্যে দুই ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠছে৷ একদল আদর্শ ও প্রাণীর প্রতি মায়া মমতা থেকে মাছ-মাংস বর্জন করেন এবং অন্যদেরও ‘পথে’ আনতে চান৷ আরেক দল খাবারের ব্যাপারে অন্যের নাক গলানো পছন্দ করেন না৷ তবে জার্মানির অধিকাংশ মানুষ মোটামুটি একমত যে বেশি মাংস খাওয়া ভালো নয়৷ নিরামিষ স্বাস্থ্য, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য মঙ্গলজনক৷

জার্মানির ছয় মিলিয়ন বা ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষ পুরাপুরি নিরামিষভোজী৷ মাছ মাংস কিছুই খান না৷ অনেকে তো এক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে৷ মাছ-মাংস দূরে থাক, প্রাণীজাত কোনো খাদ্যদ্রব্য যেমন দুধ, পনির, মাখন, ডিম ইত্যদিও ছুঁয়ে দেখেন না৷ যাদের বলা হয় ভেগান৷ ভেজিটেরিয়ানরা হলেন নিরামিষাশী৷ আর ভেগানরা উদ্ভিদভোজী।

রান্না-বান্নায় প্রাণীজাত তেল কিংবা দুধও ব্যবহার করেন না তারা৷ এদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়৷ ছয় লাখের মতো হবে জার্মানিতে৷ অবশ্য পুরোপুরি আমিষবর্জিত খাবার খেলে ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয় বলে মনে করেন চিকিত্সকরা৷

জার্মানির বিশ্ববিদ্যালগুলোও পিছিয়ে নেই এক্ষেত্রে৷ অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে৷ তাই খাবারদাবারে এসেছে আন্তর্জাতিক ছোঁয়া৷ মুসলমানদের জন্য রয়েছে শুয়োরের মাংস বর্জিত খাবার৷ কয়েক দশক আগেও মসলা বলতে বোঝাতো লবণ, গোলমরিচ কিংবা পেঁয়াজ৷ আর এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার খাবারের স্বাদও পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা৷ ‘মাদ্রাস কারি’, ‘থাই ভেজিটেবল’, ‘ফানেন গিরস’ ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন৷

বিশেষ করে স্যালাদ বারের বর্ণবৈচিত্র্য চোখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যান্টিনগুলিতে৷ সেখানে শুধু কাঁচাটমেটো, শমা ও গাজরের সমারোহই নয়, থাকে রান্না করা নানানরকম তরিতরকারি ও মুখোরোচক ভেগান ডিশ৷ মাংসের অভাব অনায়াসে ভুলিয়ে দেয় এইসব খাবার৷