পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন আমাদের সুন্দরবন। বসন্তকালে এ বনের গাছপালায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। এসব ফুল থেকে মধু এনে মৌমাছিরা তাই গাছে গাছে চাক বাধে।
সুন্দরবনের নানান প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মধু অন্যতম একটি। আর প্রাকৃতিক এ উৎস কেন্দ্র করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী এলাকা বন সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে একদল পেশাজীবীর বসবাস। ‘মৌয়াল’ নামে পরিচিত এরাই বাঘের ডেরায় ঘুরে ঘুরে চাক কেটে মধু নিয়ে ফেরেন।
সুন্দরী, খলিশা, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল নানান পদের গাছপালায় ভরপুর সুন্দরবন। বসন্তে এসব গাছপালায় ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়িয়ে বেড়ায় বনের আকাশে বাতাসে। মৌমাছিরা এসময় ফুল থেকে মধু নিয়ে চাকে জমায়। বিশাল বিশাল সেসব চাক। কয়েক সের মধু জমে একেকটি চাকে।
সুন্দরবনের ভেতরে মধু সংগ্রহ করতে অনুমতি লাগে। বাংলাদেশ বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভিতরে ঢুকে এসব মধু সংগ্রহের অনুমতি দেয়। একেকবারে ১৫ দিনের জন্য অনুমতি পান মৌয়ালরা।
১ এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নৌকা নিয়ে ছুটতে হয় বনের উদ্দেশ্যে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভা হয়। মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার প্রার্থনা জানান প্রভুর কাছে।
প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস এই কাপড় বিপদ আপদ বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের।
মুসলমানরা করেন মিলাদ আর হিন্দুরা বন বিবির পূজা। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছুড়ে মৌয়ালদের বৈঠা চালানোর অনুমিত দেন। প্রাণপনে বৈঠা বেয়ে ছুটে চলেন বনের দিকে।
মুসলিম মৌয়ালরা বলেন
মা বোনের নামে সবাই আল্লাহ আল্লাহ বলো/ বাবা গাজি সাহেবের নামে আল্লাহ আল্লাহ বলো/এক লাখ আশি হাজার পীরের নামে সবাই আল্লাহ আল্লাহ বলো...
আর হিন্দুরা বলেন...
বাবা রায় ঠাকুরের নামে হরি হরি বলো/ মা গঙ্গা দেবীর নামে হরি হরি বলো/ ছত্রিশ কোটি দেব দেবীর নামে সবাই হরি হরি বলো..
মধু সংগ্রহের একেকটি যাত্রা হয় সাধারণত ১৫ দিনের জন্য। তাই রান্নার সরঞ্জাম, টাল, ডাল, মাছ ধরার জাল, মধু রাখার ড্রাম নৌকায় বোঝাই করে নেন তারা। শুরুতে নৌকাটি খোলা থাকলেও বনে ঢোকার আগে গোলপাতা কেটে ছাউনি দিয়ে নেন মৌয়ালরা। প্রথা অনুযায়ী মৌয়ালরা বেজোড় সংখ্যায় জঙ্গলে প্রবেশ করেন।
সাধারণত সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটানোর ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছে গাছের ডালে ডালে। সবাই খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক।
‘পোকা’ অর্থাৎ মৌমাছির গতিবিধি দেখে জঙ্গলে ঢুকে পড়েন মৌয়ালরা। খালি পোকা মানে যে মৌমাছির পেটে মধু নেই। আর বোঝাই পোকা মানে যে মৌমাছির পেট মধুতে ভরপুর। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলে চাকের পানে। আর এই ঝাঁক দেখেই চাকের খোঁজ পান মৌয়ালরা।
তবে চাক ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার।
দা হাতে মৌয়াল সবার আগে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে দলেকে নিয়ে সামনে চলেন। বহরদারের অনুমতি মিললে জ্বালানো কারু নিয়ে গাছে চড়ে একজন। চাকে ধোয়া দিয়ে পোকা তাড়িয়ে দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন অরেকজন।
চাক কাটা শেষে নৌকায় ফেরেন মৌয়ালরা। নৌকায় পাহাড়ায় থাকা একজন সিঙ্গায় আুওয়াজ তুলে নিজের অবস্থান জানান দেন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ। মৌসুমের প্রথম কাটা চাকের মধু সবাই মিলে পরখ করেন। কিছু অংশ মেখে দেন নৌকার গলুইয়ে।
কীভাবে যাবেন
ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ দেখতে যাওয়া কষ্টসাধ্য। তাই এ ভ্রমণে অভিজ্ঞ কোন ভ্রমণ সংস্থার সহায়তা নিতে পারেন। প্রতিবছর মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করে থাকে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেড। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের এ মধু সংগ্রহ অভিযান স্বচক্ষে দেখা যাবে এ ভ্রমণে।
ঢাকা থেকে ৩০ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করে আবার ৪ এপ্রিল সকালে ঢাকায় পৌঁছে দেবে তারা। চাররাত তিনদিনের এ ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ হবে ১৩ হাজার ৫শ’ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১৭ হাজার ৫শ’ টাকা।
ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে খুলনা। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা।
ভ্রমণ মূল্যে অন্তর্ভুক্ত ঢাকা-খুলনা-ঢাকা বাসে যাতায়াত, লঞ্চের দ্বৈত কেবিনে থাকা, খাবার, সুন্দরবনে প্রবেশ মূল্য, গাইড ও অস্ত্রসহ নিরাপত্তা কর্মী। যোগাযোগ: বাড়ি ৪৫, রোড ২৭, ব্লক এ, বনানি, ঢাকা।
ফোন: ০২-৯৮৫৭৪২৪, ০১৭৭৫১০৫৩৫১।