রাজধানীতে কফি’র রেস্তোরাঁ

কে বলে ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই!’

মিথুন বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2015, 01:17 PM
Updated : 21 Jan 2015, 09:57 AM

একসময় মাথা কুটে মরলেও রাজধানীতে ভালো মানের কফির রেস্তোরাঁ খুজে পাওয়া ‍দুষ্কর ছিল। ‘টাকা দিলে ঢাকা শহরে বাঘের দুধও মিলে’— তবে বিশ্বমানের সঙ্গে তাল রেখে কফি মিলতো কমই।

সেই দিন কি আর আছে। মানুষের রুচি আর চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে ঢাকা শহরের নানান জায়গায় গড়ে উঠেছে কফির দোকান।

কফির প্রতি ঢাকাবাসির ক্রমশ বাড়তি কৌতুহল বা আকর্ষণও বহু উদ্যেক্তাকে নতুন নতুন কফি শপ শুরু করার ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়েছে।

আমাদের প্রাণের এই ‘জাদুর শহরে’ কয়েকটি মান সম্পন্ন কফি শপ নিয়ে এই প্রতিবেদন। স্বাদ ও গন্ধে মাতোয়ারা হতে যারা কফির খোঁজ করেন, এসব রেস্তোরাঁ তাদেরকে হতাশ করবে না!

বারিস্তা

বাড়ি এসই (এফ), ১ গুলশান অ্যাভনিউ। সময়: সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা।

ইতালিয়ান লাভাৎজ্জা ব্র্যান্ডের বিন দিয়ে কফি প্রস্তুত করা হয় এখানে। এসপ্রেসো, কাপুচিনো, লাটে, মোকাসহ আরও নানান রকমের কফি পাওয়া যায়। ছিমছাম বসার ব্যবস্থা। দেয়ালের রংয়ের সঙ্গে আলোর ব্যবহার বেশ মানানসই। ছাত্র বা পেশাজীবি সবাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন বলা যায়। গুলশান আউটলেটের আসন ব্যবস্থা ৩০ জন।

শাখা আছে ধানমণ্ডি , উত্তরা, কারওয়ান বাজারেও।

ব্রোনিয়া ক্যাফে অ্যান্ড গ্যালারি

৬৮ গুলশান অ্যাভিনিউ।

কফির আর চিত্রকর্ম— একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা প্রথম ক্যাফে হতে পারে এটি। দেয়াল জুড়েই আছে অনেক চিত্রকর্ম।

জানা গেল এক চিত্রশিল্পী এখানে প্রায়ই অতিথিদের জন্য ‘পোট্রেইট’ করেন।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিনস দিয়ে বানানো হয় এখানকার কফি। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে স্টারবাকসের কয়েকটি রোস্টিং। ক্যাপুচিনোর কাপের গন্ধের সঙ্গে কফি আর্টও মন্দ মিলবে না এখানে।  

গ্রিল্ড চিকেন স্যান্ডউইচ। চিকেনের ওপরনিচে চিজ থাকায় স্বাদটি জিভে মৃদু ধাক্কা দেবে বেশ চটজলদি!  

বৃহস্পতি ও শুক্রবার ক্যাফের পাশের একটি কক্ষে একেবারেই বিনা খরচায় সিনেমা দেখার বন্দোবস্তও রয়েছে। এর মধ্যে একদিন আবার বরাদ্দ রাখা হয় শিশুদের নিয়ে সিনেমার জন্য।  

খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা অবধি। ৫২ জন বসতে পারবেন ক্যাফেতে, আর সিনেমা দেখার অংশে আছে ৪২টি চেয়ার।

বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা

বাড়ি ৯, রোড ১৮ সেক্টর ৩।

কাচঘেরা সামনের অংশের পেছনের দেয়ালে ঝোলানো কফির মগ আর ঝুলে থাকা ল্যাম্প শেইডের হলদে বাতি বেশ চোখে পড়বে বাইরে থেকে।

কফি কাউন্টারটি বেশ পরিপাটি। টেবিলের ছোট একটি অংশের ডিজাইনে ‘আসল’ কফি বিনস রাখা হয়েছে।

জানা যায়, শুধুমাত্র ব্রাজিলে উৎপাদিত কফি ব্যবহৃত হয় এই ক্যাফেতে। এরা বিশেষভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে কফি রোস্টিং করেন আর তা ব্যবহার করে ফেলা হয় তিন সপ্তাহের মধ্যে।

তাদের কথায়, এই সময়ের মধ্যে রোস্টেড বিনস থেকে কফি বানালে তার স্বাদ থাকে অটুট। এরপর থেকেই নাকি স্বাদে ভাটা পড়তে থাকে ধীরে ধীরে।   

এসপ্রেসো ১২৫ টাকা, ক্যাপুচ্চিনো ১৯৫ আর মোকা ২১৫ টাকা পড়বে। খাবারের মধ্যে স্মোকড চিকেন স্যান্ডউইচ পড়বে ৩১৫ টাকা। 

এই কফিশপের উপরে আছে এদের নিজস্ব পানিশোধনাগার, যাতে ঘণ্টায় প্রায় ৬০ লিটার শুদ্ধ পানীয়জল পাওয়া যায়।  

এখানে সব মিলিয়ে বসতে পারবেন ৬০ জন। খোলা থাকে সকাল ১১টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।

আর কফির ‘মাতাল’ গন্ধে ডুবে যাওয়ার সময় যদি মন চায়, কাফকা অথবা মার্কেজ অথবা ফ্রয়েড-- চিন্তা নেই তাও আছে।

কিভা হান

বাড়ি ১/এ, রোড -২৩, গুলশান-১। সময় : সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা।

প্রচলিত ইতিহাস মতে পৃথিবীর প্রাচীনতম কফি শপের নাম থেকে এই নাম এসেছে। যে দোকানের শুরু হয়েছিল ১৪৭৫ সালে। এমনটাই জানান কিভা হান কফি শপের কর্ণধার সামিত বিন সালাম।

২০০৭ থেকে স্বপ্ন দেখেছেন কফি ‘পাগল’ এই তরুণ উদ্যোক্তা। কিভা হানের শুরু হয়েছে ২০১৩ সালের শেষের দিকে।  

কফির প্রতি ভালোবাসা তার আগেই ছিল। আর কফিশপ খোলার আগে নিজেই কফি বানানোর বিদ্যা রপ্ত করতে গিয়েছেন সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে।  

পড়াশুনার একটি অংশ ছিল স্থাপত্যবিদ্যা। এই জ্ঞ্যান ও চিন্তাভাবনা কিভা হানে ঢেলেছেন যেন অকাতরে।

মিশ্র ধরনের পেইটিং যেমন আছে তেমনি আছে পোস্টমডার্ন ঘরানায় সাজানো চেয়ার টেবিল।

মাঝে মাঝেই এখানে খাবার ও কফির উপর থাকে বিভিন্ন রকমের প্রোমোশনাল মূল্য ছাড়।

ব্রুজ অ্যান্ড বাইটস

১১২ গুলশান অ্যাভিনিউ।

এখানে কফি বানাতে ব্যবহার করা হয় ইলি কফি বিনস। বাংলাদেশে ইলি কফির যারা বিপণন করেন তারাই খুলেছেন এই ক্যাফে।

অন্দরসজ্জায় আধুনিকতার ছাপ আছে। যে পেয়ালাতে কফি দেওয়া হয় সেগুলোও ইলি প্রতিষ্ঠানেরই করা। এখানে আছে ‘এসপ্রেসো তিরামিসু’। আর এদের দাবি এই খাবার, ‘ঢাকার কোথাও পাবেন না’।

হট ও কোল্ড মিলে ১৬টি ভিন্ন স্বাদের কফি আছে। ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, ১৬০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০ টাকা পড়বে প্রতি কাপ কফির দাম।

বসার ব্যবস্থা আছে প্রায় ৪০ জনের। এক দিকে সোফায় যেমন বসতে পারবেন আবার শপের বারান্দায় পাতা টুলে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে দেখতে পারেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড গো বাই’।

নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স

খ-৪৭-১ (দ্বিতীয় তলা), প্রগতি সরনি, নতুন বাজার -গুলশান ঢাকা-১২১২।

সময়: শনি থেকে বৃহস্পতি সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা। শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১০টা। 

নর্থ এন্ডের প্রথম বৈশিষ্ট হচ্ছে, কফির ‘মাতাল’ করা ঘ্রাণ টের পাবেন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়। দরজা খুললেই মনে হবে ‘হারিয়ে’ গেছেন কফির রাজ্যে!

চোখে পড়বে কাউন্টারের পেছনে থরে থরে সাজানো আমদানী করা কফির বস্তা। ব্রাজিল, কোস্টা রিকা, ইথিওপিয়া, গুয়াতেমালা, ইন্দোনেশিয়া এমন কি পার্বত্য চট্টগ্রামের কফি।

পুরো রেস্তোরাঁ জুড়েই চোখে পড়ে কফির আবহ।

রিক বলেন, “এই যে কফির জন্য ব্যবহৃত চটের ব্যাগ থেকে পর্দার আইটেম। কফি খাওয়ার জায়গা থেকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখা বস্তা ভর্তি কফিবিন, রোস্টিং মেশিন। এসবই এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে পুরো ক্যাফেতে কফির পরিবেশ তৈরি হয়।”

আর এই কফিবিন রোস্টিং প্রতি সকালে নিজেই করেন কর্ণধার রিক হাবার্ড।

তার মতে, “কফি রোস্টিং আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে।”

রিক হাবার্ড নিজেকে দোকানের মালিক মনে করার চেয়ে বরং নিজেকে কফিপ্রেমিক মনে করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

তার প্রমান এই কথায় -“দেখুন, কফি হচ্ছে একটা এক্সপেরিয়েন্স, একটা ভালো সময় কাটানো।”

হোটেল লেইক শোরেও তাদের শাখা আছে।

গ্লোরিয়া জিন'স কফিজ

বাড়ি ৩৫, গুলশান অ্যাভনিউ ঢাকা-১২১২। সময়: সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা।

এই কফিশপে ঢুকতেই চোখে পড়ে বেশ আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। ছোট টেবিলের পাশাপাশি বড় টেবিলও রয়েছে। যেখানে বন্ধুরা অথবা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে কফির স্বাদে ‘হারিয়ে’ যেতে পারেন!

তবে কফির কদর যারা করেন, তাদের কাছে যে ব্যাপার ভালো লাগবে তা হল চার দেয়ালে আটকে থাকা কফির মোহনীয় ‌সুঘ্রাণ।

ক্যাফের পেছনের অংশে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে কফির স্বাদ উপভোগ করার ব্যবস্থা রয়েছে। সবুজ পরিবেশ আর বিশ্বখ্যাত বোস সাউন্ডসিস্টেমে সংগীত উপভোগ করতে পারবেন। ভেতর ও বাইরে মিলিয়ে ১৫০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে।

বিগ ব্রেকফাস্ট মিলবে সকালে। আর সারাদিন-রাত জুড়ে কফি আর হালকা স্ন্যাকসের পাশাপাশি পাস্তা, সালাদ এমনকি বার্গারও।

এসপ্রেসো ১৮০ টাকা, ক্যাপুচিনো আর লাত্তে ১৭৪ টাকা। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ হল 'লা মার্জোকো'র কফি মেশিন। এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা কফি তৈরির মেশিন হিসেবে পরিচিতি বলে জানান গ্লোরিয়া জিন’সের ব্যবস্থাপক মোরশেদ এলাহী।

পাস্তা ৪৯৫ টাকা থেকে ৭৯৮ টাকা পর্যন্ত।

সম্প্রতি শাখা হয়েছে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে।

কফি রিপাবলিক

৫৪/এ গুলশান অ্যাভনিউ। সময়: সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা।

নিজস্ব কারখানায় রোস্ট করা কফিবিন ব্যবহার করেন বলে দাবি এদের। ১১টি ভিন্ন ধরনের বিন মিশিয়ে ব্লেন্ডিং করা হয়। হাত-পা ছড়িয়ে কফি পান সঙ্গে আড্ডা— সময় বেশ আয়েশে কাটনো যায় এখানে। যারা খেতে যাবেন তাদের জন্য একটি গিটার রাখা আছে। চাইলে বাজিয়ে সময় কাটাতে পারেন।

জর্জেস ক্যাফে

ঠিকানা: বাড়ি ২, রোড ১০ উত্তরা ১ নম্বর সেক্টর।

প্রথমেই বাইরে থেকে চোখে পড়বে ক্যাফেতে ঢোকার মুখে কলাগাছ!

ভেতরে ‘বিষাদময়’ কালো রংয়ের ব্যবহার বেশি! এখানে কফি মিলবে হরেক পদের। মেনুতে দেখা গেল ‘হট অ্যান্ড কোল্ড’দুই ধরনেরই কফি আছে।

এসপ্রেসো ১৩০ টাকা আর মাক্কিয়াতো ১৫০ টাকা। আর আমেরিকানো পড়বে ১৬০ টাকা!

কফির পাশাপাশি খাবারদাবারের রকম রয়েছে অনেক। হট ডগ, বার-বি-কিউ চিকেন, গিরো চিকেনরোল-সহ অনেক কিছুই মিলবে। আরও আছে বার্গার। সসি ডিলাইট বার্গার অন্যতম জনপ্রিয় এই কফি শপে, দাম ৩৫০ টাকা তবে চিজসহ পড়বে ৪শ’ টাকা।

এখানকার হট ডগের বৈশিষ্ট হল ব্যবহৃত সস ও অনুষঙ্গ, রেলিশ, বারবিকিউ ওনিয়ন, কিমচি বা জাওয়ারক্রাউট। যা দিয়ে ঢাকার খুব বেশি জায়গায় হট ডগ কেউ বানায় না, দাম ১২০ টাকা।

এখানে বসার ব্যবস্থা আছে ৩৮ জনের। বারবিকিউ চিকেন স্যান্ডউইচ বেশ মজার এটা স্বীকার করতেই হবে। বাঁধাকপির পিকল, মেয়োনেইজ আর বারবিকিউ সসের সঙ্গে মুরগি, মুখরোচক না হয়ে যায় কোথায়? এই স্বাদের জন্য গুনতে হবে ২শ’ টাকা।

ব্রাউনি ১২০ টাকা আর কাপকেকও আছে বেশ কয়েক রকম।

সব মিলিয়ে কফি বা কিছু স্ন্যাকসের সঙ্গে বেশ খানিকটা সময় কাটানোর জন্য এই জায়গা বেশ।