দেশে যখন ১০ বছর ধরে ছয় বা এরও বেশি শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ঘটছে তখন সন্তানের জন্য ফল কিনতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন, আদৌ ফরমালিন আছে কি নেই! আর নিজের অবস্থাও তো একই! সাধ্য থাকার পরও প্রাকৃতিকভাবে খাঁটি খাবার কেনা যাচ্ছে না।
এটাও ঠিক ফরমালিন আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
এমন অবস্থায় ঢাকার কিছু জায়গায় ছোট পরিসরে ‘অর্গানিক’ খাদ্য বিক্রি শুরু হয়েছে।
জার্মান বুচার
জার্মান বুচারের কামরুল হাসান জানান, সাভারে ওআইএসসিএ একটি জাপানি এনজিও পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। যেখানে শেখানো হয় বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদের কৌশল। তাদেরই তত্ত্বাবধানে নিয়ে এসে বিক্রি করা হয় উৎপাদিত সবজি।
ওআইএসসিএর শিক্ষক মোহসিন আলম জানান, তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৬ মাস ধরে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। এর বাইরে হাঁস-মুরগি ও মাছ পালনের বিষয়েও শিক্ষিত হওয়ার উপায় আছে।
আলম বলেন, “গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, খৈল, ঝিনুকের গুঁড়া ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের জৈব সার। আর এই জৈব সারই কেবলমাত্র ব্যবহার করা হয় চাষাবাদের সময়। কোন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না।’’
এই জৈবসার দিয়ে চাষ করলে কি ফলন কম হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে আলমের উত্তর, “দেখুন প্রথম এক থেকে দুই বছর ফলন কিছুটা কম হবে এতে সন্দেহ নেই। তবে চার থেকে পাঁচ বছর পর রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করা জমির তুলনায় ফলন বেশি হবে।”
এক মঙ্গলবার জার্মান বুচারে গিয়ে দেখা গেল সকাল ৯টা থেকেই রীতিমতো লাইন দিয়েছেন ক্রেতারা। ক্রেতার থেকে বাস্কেটের সংখ্যা বেশি থাকার কারণ বের করতে গিয়ে বোঝা গেল তারা মূলত ঢাকায় বসবাসরত বিদেশি নাগরিক। আর এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে না থেকে বাস্কেট রেখে গেছেন!
তিনি আরও জানান ইতালির মতো দেশ থেকে আসার কারণে হয়ত হতাশার পরিমাণ একটু বেশিই। কারণ সাধারণত ইতালিয়নরা মনে করে তাদের দেশে উৎপাদিত খাদ্য পৃথিবীর অন্যতম সেরা।
দোকানের ভেতর তাকে সাজিয়ে রাখা বাজিল, মুলাশাক, বাঁধাকপি, পালংশাক, ঢেঁড়শ, লাউ, ব্রকলি, অ্যাসপারাগাস ইত্যাদি মিলছে। আরও দেখা গেল সাভারে ওআইএসসিএ’র খামারের অর্গানিক মুরগির মাংস ও ডিম বিক্রি হচ্ছে।
ফার্মারস মার্কেট
এখানেও প্রধানত মিলছে সবজি। অন্যতম কর্ণধার মিশা আলি জানান, অর্গানিক সবজির বাইরেও এখানে ভৈরব ফিশ অ্যান্ড কোম্পানির ফরমালিন ফ্রি মাছ পাওয়া যায় একই সময়ে।
এখানকার সবজি আসে গ্রিনথাম লিমিটেডের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানের স্যাজলি ওমর জানান, তারই এক আত্মীয়ের প্রায় ১০০ একর জমি আছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা অঞ্চলে।
ওই আত্মীয় আবার কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করা। তিনি বেশকিছু পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করছেন। তার জমির আশপাশের অনেক কৃষকও নাকি উৎসাহিত হয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
এখন তাদের বেশিরভাগ পণ্যই আসছে ওই কৃষিখামার থেকে। এর বাইরেও গ্রিনথাম গাজিপুর এবং নওগাঁতে দুটি খামারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন এই শর্তে, যেভাবে গাইডলাইন দেওয়া হবে সেভাবেই হতে হবে চাষবাষ।
কেন অর্গানিক খাবার উৎপাদনের চিন্তা এল?
ওমর বলেন, “প্রথমেই চিন্তিত ছিলাম নিজের বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের কী খাওয়াব? আর বন্ধু অথবা আত্মীয়স্বজনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এরপরই যোগাযোগ মুক্তাগাছায়। এই খামারের কৃষিবিদ তখন একান্তই পড়াশোনা সম্পর্কিত ও পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করতেন।”
“তার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে এই কার্যক্রম শুরু করা।” বললেন ওমর।
তিনি আরও বলেন, “খাদ্যপণ্য বিক্রি করব এবং তা হতে হবে অর্গানিক— এই ক্ষেত্রে বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।”
এখানকার খাদ্য পণ্যের তালিকা বেশ বড়! মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, সিম, মুলা, গাঁজর, পেঁপে, লেটুস, মরিচ, লেবু, কাঁচা-টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ধনেপাতা, জলপাই ইত্যাদি মিলছে।
‘অর্গানিক’?
বাংলাদেশে কোনো সরকারি গাইড লাইন এখনও তৈরি হয়নি। এ ব্যাপারে কৃষিবিদ ফয়জুল সিদ্দিকী জানান, সরকারি বিবেচনায় বিষয়টি আছে তবে পরিপূর্ণ গাইডলাইন এখনও তৈরি হয়নি।
সিদ্দিকী আরও জানান, অর্গানিক খাদ্য চাষের বিষয়ে পুরো বিষয়টি সম্বন্ধে অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। আবার যেটুকু ধারণা আছে তা অনেক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ নয়।
তার জানামতে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ‘অজ্ঞতা’ নিয়েই নাকি কাজ শুরু করেছেন!
তবে তিনি এসব উদ্যোগ প্রশংসা করে বলেন, “এই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যকে ভালো না বলে উপায় নেই। প্রথম যে কোনো ধরনের কাজেই কিছু ভুলত্রুটি থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। অন্তত শুরুটা তো হয়েছে।”
তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, “তবে মুশকিল হবে তখনই যখন কয়েক বছর পরে বহু কৃষক, ফার্ম বা প্রতিষ্ঠান ‘না জানার’ কারণে পুরো প্রাকৃতিক উপায়ের প্রক্রিয়া না মেনেও সব খাদ্যকেই অর্গানিক বলে বিক্রি করার চেষ্টা করবে।
সিদ্দিকী জানান, যে জমিতে সর্বশেষ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাষাবাদ করা হয়েছে সেই জমি ন্যূনতম তিনবছর পতিত অবস্থায় ফেলে রাখলে বা পুনরায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ছাড়া চাষ করলেই কেবল তাকে ক্লাসিক অর্থে অর্গানিক খাদ্য বলা যেতে পারে।
তিন বছরের প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা দেন সিদ্দিকী। সাধারণত চাষাবাদে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত রাসায়নিক সারের রেজিডিউ (অবশিষ্টাংশ) তিন বছরে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
গ্রিনথামের ওমর আবার এই বিষয়ে জানান, কৃষিবিদ আত্মীয়ের পরামর্শ নেওয়ার পরও তিনি নিজেই অর্গানিক খাদ্যবিষয়ে পড়াশোনা করছেন প্রতিনিয়ত। জানার ও বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার নেই।
আর ওআইএসসিএ’র মোহসিন আলম জানালেন, তারা এই অর্গানিক চাষাবাদের শিক্ষাই দিচ্ছেন। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে দুটি প্রথম সারির দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্র নেওয়া হয়।
‘প্রাণের টানে ছুটেছে মন মাটির পানে’
সুখের বিষয় যে কিছু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিষযুক্ত খাবার থেকে মুক্তি চাইছেন আর প্রকৃতিতে ফিরে যেতে চাইছেন।
প্রথমদিকের অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগে কিছু ভুল থাকতেই পারে। তবে উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হয়। উদ্যোক্তারা কাজ করবেন এমনভাবে যাতে আমাদের মধ্যে প্রাকৃতিক অথবা নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বা বিশ্বাস তারা ফিরিয়ে আনতে পারেন।
ছবি: তানজিল আহমেদ জনি।
* প্রিয় পাঠক, অর্গানিক খাবার বিক্রি হয় বা তৈরি হয় এমন কোনো তথ্য আপনাদের জানা থাকলে আমাদের ফেইসবুক পেইজে ইনবক্সে জানান।
লাইফস্টাইলের ফেইসবুক পেইজ: lifestyle.bdnews24.com