লাইফ ইজ হিয়ার

“আমার ছবির পাহাড় কিংবা বনভূমি আর চোখে দেখা পাহাড় ও বনভূমির মতো অত সবুজ না। কারণ আমি দেখতে পাই আমার পাহাড়গুলো কাঁদছে। আমি শুনতে পাই আমার বনভূমি কাঁদছে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের এই কান্না।”

শরীফ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2014, 11:29 AM
Updated : 19 Nov 2014, 11:43 AM

নিজের সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে আলাপচারিতায়, শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার অভিব্যক্তি এমনই সাধা-সিধে কিন্তু কঠোর। ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো, তার না বলা কথার মতোই ততটা জোরালো। শ্রুতির সঙ্গে তাই দৃশ্যকাব্যের অমিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

রাজধানীর গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে শনিবার শুরু হয়েছে কনক চাঁপা চাকমার একক চিত্র প্রদর্শনী ‘লাইফ ইজ হিয়ার’। প্রদর্শনীতে অতিথিদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটানোর ফাঁকেই কথা হল শিল্পীর সঙ্গে।

কনক চাঁপার শেষ কাজে দেখা গিয়েছিলো মুরংদের জীবন। এবার তার কাজ পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক আদিবাসী গোষ্ঠী চাকমাদের নিয়ে।

রাঙামাটিতে জন্ম নেওয়া শিল্পী কনক চাঁপা নিজেও চাকমা জনগোষ্ঠিই একজন। চাকমাদের বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার অদ্ভুত মিশেল, ক্যানভাসে উঠে আসা তার কাজগুলো। পাহাড়ের যে জীবন শিল্পীকে আজও নেশার মতো টানে তার ছবিই সবসময় এঁকে গেছেন তিনি।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং আরও শক্তিশালী ও পরিণত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশরও বেশি দলগত প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়া কনক চাঁপার এটি সতেরোতম একক প্রদর্শনী। শিল্পকর্মের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাঠ কয়লা, মিশ্র মাধ্যম আর তেল রং। গাঢ় রংয়ের ব্যবহারে অনন্য কনক চাঁপা, রং জুড়ে দিয়েছেন চাকমাদের জীবনে।

প্রদর্শনী দেখতে আসা চারুকলার ছাত্রী লুম্বিনী দেওয়ানয়ের ভাষায়, “চাকমাদের জীবনকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করায় বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন শিল্পী। ছবিতে অমায়িক সৌন্দর্য যেমন আছে, তেমনি জায়গা পেয়েছে রুঢ় বাস্তবতা। পূজা-পার্বণ আর উৎসবের পাশাপাশি আছে লড়াই-সংগ্রামের ছবি। তবে সব ছবিতেই রংয়ের ব্যবহার শিল্পীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।”

মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা নানান গল্প বলতেই ছবি আঁকেন শিল্পী কনক চাঁপা। আর এই গল্পগুলোই বিভিন্ন রকম চরিত্রের রূপ নিয়ে জায়গা করে নেয় তার ক্যানভাসে।

রাঙামাটিতে জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর কাজে তাই দেখতে পাওয়া যায় পরিচিত, অপরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে।

সবসময়ই বলে এসেছেন, যে জীবন ফিরে পেতে চান, তার ছবিই আঁকেন তিনি। সেজন্যই ক্যানভাসের মুখগুলো অনেক সময়ই মনে হয়, চোখের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কিন্তু এ আসলে বজ্র কঠিন বাস্তবতা।

বরাবরই কনক চাঁপার কাজে ‘ফিগ্যারাটিভ’ চরিত্র প্রাধান্য পায়। ক্যানভাসে পাহাড়ি নারীর এমন উপস্থিতির ল্যাবণ্যতা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি অনুভব করা যায় চরিত্রের শক্তিমত্তা। মাতৃতান্ত্রিক চাকমা পরিবারগুলোতে এমনিতেও নারীর উপস্থিতি, অনেক জোরালো। যেখানে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে লড়াই।

প্রকৃতির এত কাছে থেকেও তাদের সংগ্রাম মানুষের সঙ্গেই। বরং অনেকাংশেই ভূমি মাতাকে বাঁচাবারও। তাই একেকজন নারী এখানে জন্মের পর থেকেই একেকজন মা, একেকজন বিপ্লবী।

প্রায় দু’বছর পর নিজের ছবি নিয়ে হাজির হয়েছেন কনক চাঁপা। এই সময়ের মাঝে তুলির আঁচড় তোলা ৮০টি কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে এই আয়োজনে। শিল্পীর স্বপ্ন এক সময় ঠিকই নিজের শিকড়ে ফিরে যাবেন। শহুরে জীবনটা, জীবিকার তাগিদে গড়ে তোলা হলেও, আকাঙ্ক্ষায় দেখতে পান পুরানো রাঙামাটিকে। কল্পনা করেন এক সময়ে গাঁটছাড়া বাঁধবেন পাহাড় আর বনভূমির মাঝে। যেখানে থাকবে না কোন শোষণ কিংবা অধিকার বঞ্চিতের কান্না। আর শিল্পী কনক চাঁপা ক্যানভাসে আঁকবেন শুধুই, মায়াবী সৌন্দর্যের মহাকাব্য।     

১৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আয়োজন চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকবে প্রদর্শনী।

বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জের ঠিকানাঃ ৬০ গুলশান অ্যাভনিউ, গুলশান ১, ঢাকা ১২১২।

ছবিঃ ফায়হাম ইবনে শরীফ।