রঙিন কাগজের ফুলে মোড়ানো বর্ণিল নাচঘর। চারপাশে উৎসুক দর্শনার্থী। এসব মঞ্চে রাতভর চলে গীত আর নৃত্য। বর্ণিল পোশাকে সারা রাত নেচে গেয়ে পার করেন মণিপুরি নারীরা। শিশুরা তাদের চোখ ধাঁধানো রাখাল নৃত্য নিয়ে মেতে থাকে উৎসবে।
বাংলা পঞ্জিকায় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় এ উৎসব। মণিপুরি সম্প্রদায়ের এ উৎসব মূলত নৃত্য আর গীতের। এবারের রাসলীলা উৎসবের শুরু ৬ নভেম্বর থেকে।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা কমলগঞ্জ। এ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে পালিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় রাসলীলা উৎসব। মহারাসলীলা সেবা সংঘের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিরা মাধবপুরের জোড়ামণ্ডপে এই উৎসবের আয়োজন করেন। আর আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মণ্ডপে এই উৎসবের আয়োজন করেন মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের রাস উৎসব উদযাপন কমিটি।
মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র বেষ্ণব ধর্মের আচরণীয় শ্রীমদ্ভগবতের রাস পঞ্চাধ্যায় পঠন সেবায় ব্রতী হন। তবে ভগবৎকৃত রাসলীলা, গোপী, সখী ও মঞ্জুরীসহ বিরাজমান দৃশ্য চাক্ষুষ দর্শনে অপারগ হয়ে নিজে শ্রীগোবিন্দ জিউর চরণে প্রাণপাত শয়নে গেলেন।
তন্দ্রাবস্থায় তিনি দেখতে পান, শ্রীকৃষ্ণ শীরাধা ও গোপীসহ দিব্য রাসলীলা করছেন। এরপরে মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র কয়েকজন কুমারী মেয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো রাসলীলা করালেন। এতে নিজ কন্যা কুমারী বিশ্বাবতীকে শ্রীরাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে রাসলীলা করেন।
মহারাসলীলা উপলক্ষে কমলগঞ্জের দুটি জায়গাতেই বসে বড় ধরনের গ্রামীণ মেলা। মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়াও জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ মিলিত হন এ আনন্দ উৎসবে।
সারা রাতের রাস নৃত্যে মণিপুরি তরুণীরা অংশ নেন। আর দিনের বেলায় রাখাল নৃত্যে অংশ নেন মণিপুরি শিশুরা। এই উপলক্ষে এখানকার মণ্ডপগুলো সাদা কাগজের চোখ ধাঁধানো নকশায় সাজানো হয়। এরই মাঝে মণিপুরি তরুণী আর শিশু নৃত্যশিল্পীরা রং-বেরঙের পোশাকে নৃত্যাভিনয় রাতভর মুগ্ধ করে রাখেন ভক্ত আর দর্শনার্থীদের। এছাড়া এ উৎসবে মণিপুরি শিশুদের রাখাল নৃত্যও মনোমুগ্ধকর।
এছাড়া কমলগঞ্জের ভানুগাছ মোড় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের পাশেই রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রায় ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে এ উদ্যানে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরিসৃপ, বিশ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি।
প্রধান সড়ক ফেলে কিছুদূর চলার পরেই ঢাকা-সিলেট রেল লাইন। এর পরেই জঙ্গলের শুরু। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অন্যতম আকর্ষণ হল উল্লুক, চশমা বানর, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর ইত্যাদি। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি ট্রেকিং পথ। একটি তিন ঘন্টার, একটি এক ঘন্টার এবং অন্যটি আধ ঘন্টার পথ। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়া পল্লীও আছে।
কীভাবে যাবেন
প্রথমে ঢাকা থেকে রেল কিংবা সড়ক পথে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে আবার বাস কিংবা অটো রিকশায় চড়ে আসতে হবে কমলগঞ্জ কিংবা আদমপুর। কমলগঞ্জের মণ্ডপগুলো শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ থানার সামনে এসে ভানুগাছ-পত্রখোলা সড়কে। এ পথে প্রায় চার কিলোমিটার সামনে গেলেই রাসলীলার মণ্ডপগুলোর দেখা মিলবে।
ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া সাড়ে ৩শ' থেকে ৪শ' টাকা। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা। পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি ভানুগাছ স্টেশনে থামে। কমলগঞ্জের রেল স্টেশনটিই ভানুগাছে। এ দুটি ট্রেনে আসলে ভানুগাছ নেমে সরাসরি চলে যেতে পারেন রাস লীলার মণ্ডপে।
কোথায় থাকবেন
কমলগঞ্জে থাকার তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে শ্রীমঙ্গলে। তবে কমলগঞ্জের কাছাকাছি থাকার জন্য নতুন একটি জায়গা হল সুইজ ভ্যালি রিসোর্ট।
শমশেরনগর বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত এই রিসোর্টে আছে বেশ কয়েকটি আধুনিক কটেজ। প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য জায়গাটি উৎকৃষ্ট। এ রিসোর্টের কটেজগুলোতে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় নানারকম কক্ষ আছে।
এছাড়া ভালো মানের খাবারও মিলবে এ রিসোর্টে। যোগাযোগ: সুইস ভ্যালী রিসোর্ট, শমশেরনগর, মৌলভীবাজার। ফোন ০১৭৮৬৪৯৩৭০০।