বাংলায় হ্যালোইন

বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে অনুপ্রাণিত করে আসছে। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। এ ধারায় নতুন যুক্ত হয়েছে ‘হ্যালোইন’ উদযাপন।

ইরা ডি. কস্তাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2014, 06:40 AM
Updated : 31 Oct 2014, 07:05 AM

বিদেশি উৎসব আমাদের দেশে ভালোমতো মিশে যাওয়ার অন্যতম একটি উদাহরণ হতে পারে ভ্যালেন্টাইন ডে। বাংলাদেশে একসময়ের জনপ্রিয় একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকের লেখনির প্রভাবে 'প্রেম দিবস' এখন বাংলাদেশিদের মাতিয়ে তুলে।

গত কয়েক বছর এরকমই একটি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ছড়াচ্ছে। যার নাম হ্যালোইন। বাংলাদেশে যা ভূতুড়ে দিবস হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

অনেকেই এটা খ্রিষ্টান ধর্মের উৎসব হিসেবে জানলেও পৃথিবীতে হ্যালোইন উৎসবের জন্ম প্রায় মধ্যযুগে।

দি হ্যালোইন ডটঅর্গ থেকে জানা যায়, রোমানদের বিস্তারের আগে প্রাচীন ব্রিটেনে কেল্ট জাতি বসতি স্থাপন করে। প্রায় দুই হাজার বছর আগের এই উপজাতি ফসলি মৌসুম শেষে পহেলা নভেম্বর 'সাহ-উইন' উৎসব পালন করতো। কারণ এর পরই আসবে শীত মৌসুম।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে এই সাজ করেছেন মেইকআপ আর্টিস্ট ফারজান মিতু।

আর শীত মানেই ঠান্ডা, অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে বিষণ্ন পরিবেশ।

তারা আরও মনে করতো 'সাহ-ইউন'য়ের আগের দিন (৩১ অক্টোবর) মৃতরা ভূত হয়ে মর্তে চলে আসে। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য কেল্টরা নানান রকম খাদ্য ও ওয়াইন উপঢৌকন হিসেবে দরজার বাইরে রেখে দিত। আর এইসব 'ভূত'য়ের 'আছর' থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন রকম মুখোশ, পশুর খুলি ও চামড়া দিয়ে ভূতুরে সাজসজ্জায় নিজেদের সজ্জিত করত।

৪৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে কেল্টিক এলাকা রোমানরা দখল করে নেওয়ার পর তাদের দুটি উৎসব 'সাহ-উইন'য়ের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। একটি হচ্ছে ‘ফেরালিয়া’- মৃতদের স্মরণের দিন এবং অন্যটি ‘পোমোনা’ এক দেবীকে স্মরণের দিন, যার প্রতীক হচ্ছে আপেল।

আর এখান থেকেই হ্যালোইনের সময় বালতির পানিতে ভাসানো আপেল মুখ দিয়ে তোলার আয়োজন প্রতিষ্ঠিত হয়। যা ‘ববিং ফর অ্যাপলস’ নামে পরিচিত।

অষ্টম শতকে খ্রিস্টান চার্চ 'সাহ-উইন' উৎসবকে ‘অল সেইন্ট’স ডে’ হিসেবে রূপান্তর করে। যা ‘অল হালোস’ বা ‘সাধুদের দিবস’ নামে পরিচিত।

আর হ্যালোইনে ‘ট্রিক অর ট্রিট’য়ের জন্য দায়ী মধ্য যুগের ব্রিটেনের অধিবাসীরা। তাদের ‘সৌলিং’ ও ‘গাইজিং’ প্রথাই বর্তমানে ট্রিক অর ট্রিট হিসেবে প্রচলিত।

তাদের মতে ২ নভেম্বর হচ্ছে ‘অল সৌলস ডে’ বা ‘সকল আত্মার দিবস’। এই দিনে দরিদ্রের জন্য পিঠা বানানো হত। যার নাম ‘সৌল কেক’। দরিদ্ররা যে পরিবারের কেক খেত, সেই পরিবারের মৃত মানুষের আত্মার জন্য প্রার্থণা করতো। এটাই সৌলিং।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে এই সাজ করেছেন মেইকআপ আর্টিস্ট ফারজান মিতু।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে মেইকআপ আর্টিস্ট জোবাইদা আশিকের সাজ।

আর ‘গাইজং’ হচ্ছে মধ্যযুগে বাচ্চারা হ্যালোইনের সময় নানান রকম পোশাক পরে খাবার, ওয়াইন ও টাকার বিনিময়ে গান, কবিতা বা কৌতুক শোনানোর জন্য প্রস্তাব করতো।

উনিশ শতকের দিকে ব্রিটেনের আইরিশ ও স্কটিশরা আমেরিকাতে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। কালক্রমে তাদের সেই সৌলিং ও গাইজিং সংস্কৃতি ট্রিক অর ট্রিট হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ১৯৫০ সালে দিকে পারিবারিক ভাবে হ্যালোইন পালন করা শুরু হয়। আর তখন থেকেই  আমেরিকান ছেলেমেয়েরা নানান রকম উদ্ভট পোশাক পরে চকলেট ক্যান্ডি যোগাড় করা শুরু করে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম একটি ছুটির দিন হচ্ছে হ্যালোইন। আর এই দিন ঘিরে কোটি কোটি ডলার ব্যবসা হয়।

বিদেশি এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রায় দু’তিন বছর ধরে প্রবেশ করলেও সেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। তবে এ বছর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে বেশ কয়েকটি স্থানেই নানান ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

ফেইসবুক পেইজ ‘এনভি কসমেটিকস’ হ্যালোইন মেইকআপ কনটেস্টের আয়োজন করেছে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়ার প্রধান কারণ সম্পর্কে জানিয়েছেন পেইজটির অ্যাডমিন ফারজান মিতু।

তিনি বলেন, “আমি বেশ কিছু বছর বিদেশে ছিলাম। আর সেখানে হ্যালোইন পালন করা হয় অনেক বড় করে। যদিও বিদেশি সংস্কৃতি। তবে আমি মনে করি এটির মূল উদ্দেশ্য আনন্দ। আর তাই আনন্দের খোরাক হিসেবে আমি এই আয়োজন করেছি।”

অ্যানিমেশন মুভি ‘কর্পস ব্রাইড’ থেকে এই হ্যালোইন সাজ করেছেন মেইকআপ আর্টিস্ট আবেশ মাহাজাবিন।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে মেইকআপ আর্টিস্ট আবেশ মাহাজাবিনের সাজ।

“হ্যালোইনের মেইকআপের মধ্যে এক ধরনের সৃজনশীলতার বিষয় রয়েছে। অনেক ভালো মেইকআপ শিল্পীও নিখুঁতভাবে হ্যালোইন মেইকআপ করতে পারবেন না। কারণ এটি ভিন্ন একটি বিষয়। আর আমাদের দেশেও যে এই ধরনের মেইকআপ শিল্পী আছেন তাদের জন্যেই নিজের পেইজে এই আয়োজন করেছি।” বললেন মিতু।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তবে আমি বলতে চাই কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঘিরে নয় বরং শুধুমাত্র আনন্দের উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন।”

বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তা পেলেও দেশীয় সংস্কৃতির কোনো অংশ নয় এই হ্যালোইন উৎসব। তবে প্রায় অনেক নামীদামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই এই উৎসবটি পালন করা হয়।

এই ব্যাপারে স্কলাস্টিকা স্কুলের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আফরোজা খালেদ বলেন, “আমি বত্রিশ বছর স্কলাস্টিকায় ছিলাম। এই ধরনের কোনো উৎসব আমরা কখনও আয়োজন করিনি।”

আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এই হ্যালোইন কতটা যেতে পারে?

বর্তমানে উত্তরায় জাহান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দায়িত্বে থাকা এই শিক্ষক বলেন, “হ্যালোইনের চাইতে আমাদের দেশীয় ধারার কোনো উৎসব যদি স্কুলগুলো পালন করে তবে ছেলেমেয়েরা দেশ সম্পর্কে বেশি জানতে পারবে।”

তার কথায়, “যেমন ধরা যাক স্কুলে একটা বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। যেখানে শিশুরা দোকান দিবে। তারাই টিকিটের ব্যবস্থা করবে। নানান রকম বিকিকিনির মাধ্যমে কেনাকাটার উপর একটা ধারনা পাবে। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান বিষয়টা জরুরি।”

হ্যালোইন এই দেশে প্রচলনের ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করে আফরোজা আরও বলেন, “আমি মনে করি হ্যালোইন নয়, বরং ছেলেমেয়েরা যাতে সুন্দর মন নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত।”

আমাদের দেশের প্রচলিত কোনো উৎসব না হওয়ার কারণে হ্যালোইনের সাজ পোশাক কিনতেও বেশ বেগ পেতে হয়।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে মেইকআপ আর্টিস্ট সিরি ফারহানার সাজ।

৩১ অক্টোবর হ্যালোইন উপলক্ষ্যে মেইকআপ আর্টিস্ট তামান্না ইসলামের সাজ।

তাই স্কুলের চাপে পড়ে যেসব শিশুদের এই ধরনের আয়োজনে সম্পৃক্ত হতে হয়, তাদের অভিভাবকরা নিজেদের স্বামর্থ অনুযায়ী দেশের বাইরে থেকে কিছু জিনিস, মেইকআপ সামগ্রী ও পোশাক আনিয়ে থাকেন।

আর যারা পারেন না তাদের নিজের হাতেই ব্যবস্থা করে নিতে হয়।

একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কাশফিয়া ফিরোজ জানান, গেলো বছর ছেলের স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য পোশাক খুঁজতে গিয়ে অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে তাকে। শেষ পর্যন্ত গুলশানের আর্চিজ গ্যালারিতে পেয়েছিলেন হ্যালোইনের পোশাক।

তিনি বলেন, “একটু খোঁজ নিলে সাধারণত গুলশান, বনানীর বিভিন্ন গিফট শপেই পাওয়া যেতে পারে হ্যালোইনের পোশাক।”

শুধু পোশাক নয় হ্যালোইনে মেইকআপ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে পোশাকের মতো মেইকআপও আমাদের দেশে খুব একটা সহজলভ্য নয়। এক্ষেত্রে অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা করেন।

এই ব্যাপারে ফারজান মিতু ধারনা দিতে গিয়ে বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাদা ফাউন্ডেশন, ফেইস পেইন্ট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাছাড়া আরও অনেক ধরনের বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা হয়।”

মিতু জানান, মুখের বিভিন্ন আকার দেওয়ার জন্য যে উপাদান প্রয়োজন তার বদলে আটা বা ময়দা দিয়ে ডো ব্যবহার করে থাকেন অনেকে। তাছাড়া পেন্সিল, কাগজ বা কার্ডবোর্ডের তৈরি বিভিন্ন ‘প্রপস’ও ব্যবহার করে থাকেন অনেকে।

পরিশেষে শিক্ষক আফরোজা খালেদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, নিউ মিডিয়ার যুগে নতুন সংস্কৃতির ধারা আমাদের সঙ্গে মিলবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে সেই ধারায় যেন হাবুডুবু খেয়ে আমাদের সংস্কৃতির খেই না হারিয়ে ফেলি।