আহ! বেল্লা ইতালিয়া

বেলা ইতালিয়া নামে পরিচিতি পেলেও ইতালিয়ান উচ্চারণে বেল্লা ইতালিয়া। বাংলাদেশে খাঁটি ইতালীয় খাবারের স্বাদ নিতে এই রেস্তোরাঁয় ঢুঁ দিলে অন্তত ঠকতে হবে না।

মিথুন বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2014, 02:42 PM
Updated : 21 Oct 2014, 03:19 PM

গুলশান অ্যাভনিউয়ের ৭৬ নাম্বার বাড়ি আসলে একটি মার্কেট। এর দ্বিতীয় তলায় উঠলে ছোট একটি ‘সাইন’ চোখে পড়বে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লে এমন কিছু চোখে পড়বে না যাতে শিহরণ জেগে উঠতে পারে।

সত্যি বলতে, সোজা তাকালে চোখে পড়বে অত্যন্ত সাদামাটা গোছের একটি সফট ড্রিংকস কেবিনেট। চার দেয়ালে দেখা যাবে কিছু পোস্টার যেগুলোর বিষয় প্রধানত রোম শহর। পিকাসোর একটি পেইন্টিং যেমন আছে তেমনি আছে ‘বাইসাইকেল থিফ’ সিনেমার একটি স্থিরদৃশ্য।

টেবিল সাজানো হয়েছে মেরুন-হালকা বেগুনি চেক নকশা দিয়ে। সেটিও যে বিশেষ কিছু তাও বোধ হয় তর্কের বিষয়। তবে মৃদুমন্দ ইতালীয় ভাষার গান সবসময়ই পাওয়া যাবে এখানে!  

‘বেল্লা ইতালিয়া’ রেস্তোরাঁর ভেতরে এমনই ছিমছাম পরিবেশ। ‘বেল্লা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সুন্দর। আর ইতালিয়া অর্থ তো বোধহয় অনুমান করতেই পারছেন।

তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে এই বেল্লা ইতালিয়ার বৈশিষ্ট কী বা কোথায়?

সেটি বুঝবেন যখন খাবার এসে পড়বে টেবিলে। পিৎজা দেখবেন খুবি পাতলা! টপিংসও হালকা গোছের মনে হতে পারে অনেকের কাছেই! কামড় দিলেই বোঝা যাবে এর স্বাদ! এই যে ভিন্নতা তার কারণ, এই হল খাঁটি ইতালীয় খাবারের নমুনা। যা বাংলাদেশে খুবই কম রেস্তোরাঁয় মেলে। যা একেবারে বাজি ধরে বলা যায়।  

কথা হল কর্ণধার বজলুর রহমান তপনের সঙ্গে। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আর হাসিখুশি মানুষ। আড্ডায় যে আগ্রহ আছে তা কিছুক্ষণ কথা বললেই টের পাবেন যে কেউই।

জানালেন, তার জীবনের বিচিত্র সংগ্রামের কাহিনি। একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক হিসেবে যেমন কাজ করেছেন তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে ক্রেইন অপারেটর আবার রোমের কয়েকটি স্বনামধন্য রেস্তোরাঁর কাজ করতে গিয়ে শিখেছেন ইতালিয়ান খাবারের কিছু বিশেষ খুঁটিনাটি, ঘরানা ও দর্শন।

কথার ফাঁকে বলেন, “ইতালিতে একজন শেফ বিশেষ সম্মানের অধিকারী।”

আর তাই ওই দেশীয় রান্না শিখেছেন মন লাগিয়ে, করেছেন পড়াশোনা। প্রতিনিয়ত বিখ্যাত শেফদের সঙ্গে নিয়ে বের করে আনতে চেয়েছেন তাদের ‘হাঁড়ির খবর’। এমনকি নিউ ইয়র্কে ২-৩টি নামকরা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় কাজ করেছেন যেখানে ইতালীয় ঘরানা মেনে চলা হয়।      

রহমান আরও জানান— এক প্রখ্যাত পিৎজা শেফ তাকে বলেছিলেন, ‘রহমান, মাস্টার হতে চাইলে তোমাকে এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পিৎজা বানানো শিখতে হবে।’ আর এই কাজটিও করেছেন তিনি।

রহমান যোগ করেন, “ইতালীয় ঘরানার পিৎজা থিন ক্রাস্ট হয় আর টপিংয়েও দেখা যায় না বিশেষ বাহুল্য।”

আরও বলেন, “ইতালিতে আঞ্চলিকতার প্রভাব, জাত্যভিমান বা বংশের অহংকার খাবারেও টের পাওয়া যায়। যেমন নাপোলি অঞ্চলের ইতালিয়ানরা নিজেদের ইতালিয়ান ভাবার আগে নাপোলির মনে করে! আর তাই খাবারের বিষয়ে রোমানদের মাতব্বরি তারা মানবেন কেন!”

পাঠক মনে আছে তো মারাদোনা কোন দলে খেলতেন?

রহমান ২০০০ সালে ইতালি থেকে ফিরে চিন্তা করলেন এমন একটি রেস্তোরাঁ খুলতে চান বাংলাদেশে যেখানে সবাই এসে একেবারে খাঁটি ইতালীয় খাবার খেতে পারেন। ইতালিতে যেভাবে নিজে বানিয়েছেন ওই দেশীয় খাবার ঠিক সেভাবেই বানাবেন আমাদের জন্য এই মন্ত্রই ছিল মনে সবসময়। কোন ‘কম্প্রোমাইজ’ তিনি করতে চাননি।

এই ধারা বজায় রাখতে গিয়ে বেশিরভাগ উপকরণ আনতে হচ্ছে বিদেশ থেকেই। রহমান আরও জানান, ইতালির অবস্থান আফ্রিকা থেকে খুব বেশি দূরে না আবার ভূমধ্যসাগরও গা লাগোয়া। অনেকেই মনে করেন ইতালিয়ানরা হচ্ছে সৌভাগ্যবান যে এই আবহাওয়ায় শাকসবজি থেকে শুরু করে দুগ্ধজাতপণ্যতে একধরনের স্বাদের বিশ্বেষত্ব থাকে। আর খাবারে ব্যবহৃত অলিভ অয়েলের গুণাগুণ নিয়েও তো ‘গবেষণা’ কম হয়নি!

আর তাই উপকরণ সংগ্রহ করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। বাংলাদেশ থেকে কম দূরে নয় ইতালি। তাই চাইলেই তো আর বিশেষ জাতের ইতালীয় তাজা টমেটো নিয়ে আসা যায় না। মোৎজারেল্লা বা পারমেজানো (ইংরেজিতে পারমেজান) চিজের বৈশ্বিক মূল্যও একেবারে কম না।

তারপরও রহমান তার রেস্তোরাঁয় যে মূল্য তালিকা রেখেছেন তাকে আর যাই হোক ‘অত্যধিক’ বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।

নিজেই বলেন, "কোনও ভাবেই আমি দাম বাড়ানোর পক্ষপাতি নই।"

আরও জানান একবারে উপায় না থাকলেই দাম বাড়ান তিনি।

সঙ্গত কারণেই এমন কোনও মাংস এখানে ব্যবহার করা হয়না যা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যে ব্যবহার কম। বেল্লা ইতালিয়াতে ‘সবজি ও চিজ’য়ের পিৎজা যেমন পাবেন (মার্গেরিতা পিৎজা) আবার শুধু চার ধরনের চিজের পিৎজাও মিলবে (কোয়াত্রো ফরমাজ্জি পিৎজা)। মাশরুম, বিফ, চিকেন সসেজ, চিংড়ি, আনকোভি, পালংশাক, ব্ল্যাক অলিভ, বেগুন ইত্যাদি বহু টপিংসয়ের পিৎজাই এখানে পাওয়া যায়।

তো কথা উঠতে পারে কেমন হয় এই খাঁটি ইতালীয় পিৎজা স্বাদ? সেটা নাহয় পাঠকের উপরই ছেড়ে দেওয়া যাক।  

রহমান একটু হেসে বলেন, "আমার পিৎজা বানানো হয় গ্যাস ওভেনে তবে স্বাদে মনে হবে কাঠের আগুনে পোড়ানো।"

কীভাবে এটি সম্ভব? তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, "সেটা গোপন!"    

রহমান তার রেস্তোরাঁয় পিৎজার অনুসঙ্গ হিসেবে শুধুমাত্র চিলি ফ্লেইকস রাখেন। রহমানের ভাষায় ‘এটি ইতালিয়ান ঘরানায় জায়েজ!’

পিৎজার দাম ৫২০ থেকে ৭২০ টাকা। সাইজ সব এক।

স্প্যাগেত্তি সম্বন্ধে রহমান বলেন, "ইতালিতে বেশিরভাগ মানুষের পছন্দই হল একটু শক্ত খাওয়া। যেটিকে ওরা বলে ‘আল দেন্তে’, যেটি ইতালির বাইরে অনেকেরই অজানা।"

অর্থাৎ যেটা খেতে গেলে দাঁতে কাটতে একটু কচকচ করবে। 

ছবি বেল্লা ইতালিয়ার ফেইস বুক থেকে।

ছবি বেল্লা ইতালিয়ার ফেইস বুক থেকে।

তবে এই ক্ষেত্রে রহমানকে একটিু সমঝোতার পথে হাঁটতে হয়েছে। অন্যান্য অনেক রেস্তোরাঁয় যতটা নরম হয় তার থেকে অল্প শক্ত রাখা হয় স্প্যাগেত্তি। তবে কেউ যদি খাঁটি স্প্যাগেত্তি খেতে চায় তাহলে খাবার সরবরাহকারীকে বলতে হবে ‘আল দেন্তে’ দিতে! পেনে, ফেতুচিনে, রাভিয়লির পাশাপাশি লাজানিয়াও মিলবে! 

পাস্তার দাম ৪৫০ থেকে ৫৭০ টাকা।

এছাড়া সাইড ডিশ হিসেবে মাশরুম উইথ গার্লিক বেশ লাগবে। ব্রুশকেত্তা পোমোদোরোর— টোস্টের উপরে টমেটোর স্বাদের সঙ্গে অলিভ অয়েল আর হালকা হার্বসের গন্ধ বেশ মানানসই। 

এই ধরনের সাইড ডিশের মূল্য ১২০ থেকে ৩৮০ টাকা।

মিঠাই হিসাবে তিরামিসু নিলে নিজ দায়িত্বে খেতে হবে! একেবারে ‘সিনফুল’ কাণ্ড ঘটে যাবে মুখের ভেতর। তিরামিসুর দাম ৩৫০ টাকা।

আর একটি কথা বেল্লা ইতালিয়ার খাবারের মূল্য ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জ সংযুক্ত। আলাদা করে কিছু যোগ কেরতে হবে না।

অন্য শাখা: ১০/এ সাত মসজিদ রোড, ধানমণ্ডি।