টাঙ্গাইল বয়ন শিল্পের কাব্যকথা

বাংলার তাঁত শিল্পের ইতিহাসটা নেহায়েত নতুন কিছু নয়। ধারণা করা হয় সপ্তম শতাব্দি থেকেই অবিভক্ত বাংলায়, বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশে কোনও এক ধরনের তাঁতের বিকাশ ঘটে। এরপর থেকেই উর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু এই শিল্পের।

শরীফ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2014, 01:50 PM
Updated : 2 Oct 2014, 01:50 PM

তবে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা করেনি এই সুক্ষ শিল্প তা নয়। ইংরেজদের শাসন আমলেই বেশ বড়সড় চেষ্ঠা চলেছে এই অঞ্চলের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করবার। তবে সব উতরে এগিয়ে চলেছেন এদেশের বয়ন শিল্পীরা। আর এই যাত্রায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন তাদের একটা বড় অংশই হলেন টাঙ্গাইলনিবাসী।

এবার সেই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পকেই আরও বড় পরিসরে তুলে ধরতে উদ্যোগ নিয়েছে 'ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ' ও 'বেঙ্গল লাউঞ্জ'। এজন্য, রাজধানী গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিলের আয়োজনে শুরু হয়েছে 'অ্যান অড টু টাঙ্গাইল উইভস' বা 'টাঙ্গাইল বয়ন শিল্পের কাব্যকথা' শীর্ষক প্রদর্শনী।

"বড় বড় আন্তর্জাতিক উৎসব-আয়োজনে দেখি বিভিন্ন দেশের শিল্পী কিংবা প্রতিনিধিরা সেই দেশের সংস্কৃতিকে নানানভাবে তুলে ধরার চেষ্ঠা করেন। আমাদের দেশের কেউ কদাচিৎ এসব আয়োজনে সুযোগ পেলেও, দেশের মানুষকে কিংবা নিজের ঐতিহ্য তুলে ধরবার চেষ্ঠা করেছেন বলে মনে পড়ছে না।" বিশাল এই আয়োজনের মাঝে ডিজাইনার বিপ্লব সাহার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েই শুনতে হলো এমন অভিমানী কথা।

জানালেন টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদার কারণে প্রচুর ভারতীয় ক্রেতাদের অনেকেই, শুল্ক ছাড়া নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, এই বিশেষ ধরনের শাড়ি পাচার করছেন। তারপরও আমাদের দেশের মানুষই যেন কিছুটা উদাসীন এই শিল্পের প্রতি।

"সাংস্কৃতিক নানা রূপের বিবর্তনের ধারায় বড় ভূমিকা রাখে 'মিথ'। যেমন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, টাঙ্গাইলের সেই 'সারি সারি' শাড়ির গ্রামে ঘুরতে গিয়ে এক কারিগরের মুখে শুনেছিলাম, ডিজাইনে জ্যামিতিক গড়নের ব্যবহার পোক্ত করতে নিজেই নাকি খাতা-কলমে জ্যামিতির চর্চা করতেন ছোটকালে। এমনকি ভবঘুরের মতো ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, শুধুই শাড়িতে ব্যবহৃত 'ফর্মের' ব্যবহার বুঝতে।" বললেন বিপ্লব সাহা।

সেসব দিন অবশ্য পাল্টেছে। সারা দুনিয়ার ফ্যাশন সম্পর্কে জানতে, দূর পাশ্চাত্য থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে এসেছেন অনেক ডিজাইনাররা। তাদের লক্ষ্য, এবার এই টাঙ্গাইলের তাঁতকেই তুলে ধরবেন বিশ্ব মানচিত্রে।

 

তবে ডিজাইনার নওশিন খায়েরের কথায় জানা গেলো, শুধু তাঁত নয় বরং দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকশিল্প নিয়েই কাজ করতে চান তারা। আর যে 'পোশাকশিল্প' নামটাই অনেক শংকার জন্ম দেয়, সেটি নয় বরং আদিবাসীদের কোমর-তাঁত, সিল্ক, খাদি এমন বৈচিত্র্যময় বুননেই আগ্রহ তাদের। এই আয়োজনে যেমন গত কয়েক দশকের তাঁতের সুক্ষ্ম বুননের পরিক্রমা প্রদর্শিত হচ্ছে। ঠিক তেমনি ভবিষ্যতেও তারা দেশীয় শিল্পের উপর কাজ অব্যাহত রাখবেন। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে, আমাদের সব পণ্যই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করবে।

এবারে চারদিনের এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন ডিজাইনার মাহিন খান, বিপ্লব সাহা, চন্দনা দেওয়ান, শৈবাল সাহা, শাবানা আলী, কুহু প্লামন্দন, এমদাদ হক, ফারাহ আঞ্জুম বারী, লিপি খন্দকার, শাহরুখ আমিন ও নওশিন খায়ের।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে করা ডিজাইনের কাজ নিয়ে হাজির হয়েছে আড়ং।

তবে শুধু ডিজাইনারদের করা কাজই নয়, বরং বয়ন শিল্পীদের এই লম্বা সময়ের গল্প তুলে ধরবার জন্য পুরানো কাজও প্রদর্শিত হচ্ছে একইসঙ্গে।

যদিও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায়, ইতিহাস তুলে ধরাটাও খুব সহজ কাজ নয়। তারপরও নিজেদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠা দিয়ে এই শিল্পের কথা সবাইকে জানানোর পাশাপাশি এক ধরনের সচেতনতা তৈরির প্রয়াস রয়েছে বলে জানিয়েছেন,  ডিজাইনারদের এই সংগঠনের সভাপতি মাহিন খান।

বুধবার এই আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর ও ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত হ্যানে ফুগল এসকেয়া। আমন্ত্রিত অতিথিরা ভবিষ্যতেও এমন উদ্যোগে সবাইকে পাশে থাকবার আহ্বান জানান।

অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ৪ তারিখ পর্যন্ত। আর প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ঘুরে দেখবার ও পছন্দমতো কেনাকাটা করবার জন্য উন্মুক্ত থাকছে এই প্রদর্শনী।

গ্যালারির ঠিকানাঃ ৮০, গুলশান এভিনিউ, রোড – ১৩১, গুলশান – ১২১২, ঢাকা

ছবিঃ ফায়হাম ইবনে শরীফ