বয়সজনিত অন্ধত্ব

সময় থাকতে সাবধান হলে বয়স বাড়ার সঙ্গে চোখের জ্যোতি কমে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2014, 07:23 AM
Updated : 29 Sept 2014, 07:23 AM

গোলাম মেজবাহ উদ্দিন, বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের, স্কুল অফ মেডিকেল সায়েন্সের ফার্মাকোলজি বিভাগের মরিস ল্যাব ও ক্যাজুয়াল একাডেমিক-এর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট (পিএইচডি) হিসেবে কাজ করছেন।

তার গবেষণার প্রধান বিষয় হচ্ছে বয়সের সঙ্গে দৃষ্টিলোপ। এই বিষয়ে তিনি কোরিয়া থেকে এমএস ডিগ্রিও নিয়েছেন।

বাংলাদেশি এই গবেষক বয়স বাড়ার সঙ্গে চোখের জ্যোতি কমার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে জানাচ্ছেন।  

বয়স বাড়ার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়, শুধু কি তাই? পরিবারের বয়স্ক সদস্যকে নিয়ে অন্য কোথাও না যেতে হলেও চোখের ডাক্তারের কাছে বছরে একবার যেতে হবেই।

সংক্ষিপ্ত ও সহজ ভাষায় আমরা চোখের যে কালো মনি দেখতে পাই তাকে বলা হয় পিউপিল। ঠিক তার চারপাশ জুড়ে থাকে কর্নিয়া। এই দুটি অংশের পেছনে থাকে লেন্স, যার মাধ্যমে চোখের ভেতরে আলো প্রবেশ করে। তবে এতেই আমরা কিছু দেখতে পাই না। সেই আলো মেকুলা থেকে অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং আমরা দেখতে পাই।

অপটিক নার্ভ, মেকুলা, ভিট্রিয়াস (চোখের পানি) এসব কিছুই রেটিনার মাঝে অবস্থিত।

প্রতিনিয়ত চোখের ভেতরে রেটিনার প্রত্যেক অংশ অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়ায় (RETINAL CYCLE) আমাদের দৃষ্টি শক্তির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ভিটামিন এ তৈরিতে ব্যস্ত থাকে।

চোখের এই জটিল প্রক্রিয়ার মাঝে একটু ওলটপালট ঘটলেই হতে পারে বড় ধরনের কোনও এক সমস্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে আমাদের শরীরের সবকিছুই দুর্বল হয়ে পড়ে। যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে চোখের ওপর।

বয়সের সঙ্গে মেকুলা ও অপটিক নার্ভ ক্ষয়ে রেটিনাকে দুর্বল করে। রেটিনার সঙ্গে জড়িত অনেক রোগের মাঝে মেকুলার পতন অথবা ইংরেজিতে যাকে বলে AGE RELATED MACULAR DEGENERATION হলো সবচেয়ে দুরারোগ্য, যা অন্ধত্ব এনে দিতে পারে।

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে ৪৫ বছর বয়সের পর থেকেই এই রোগ বেশি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের জরিপে দেখা যায় এশিয়ান ও আফ্রিকান দেশগুলোর মানুষ এই রোগে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। আর ক্ষতির পরিমাণ ২০২০ সালের মাঝে হয়ে যাবে দ্বিগুণ।

ধরণ ও প্রতিকারের উপায়

প্রধানত রোগটি দুই ধরনের মেকুলার পতন অথবা AGE RELATED MACULAR DEGENERATION হতে পারে, শুকনা কিংবা ভেজা।

যেভাবেই হোক না কেনও দৃষ্টি হয়ে যাবে ঘোলা। আমরা যতটুকু চোখ মেলে দেখতে পাই তার কিছু অংশ অন্ধকার হওয়া থেকে শুরু হবে এই রোগের সূচনা। ধীরে ধীরে ঠেলে নিয়ে যাবে অন্ধত্বের দিকে।

শুকনা মেকুলার পতন (DRY MACULAR DEGENERATION) ক্ষেত্রে আসলে এখন পর্যন্ত কোনও চিকিৎসা নেই। তবে ভেজা মেকুলার পতন (WET MACULAR DEGENERATION) এর ক্ষেত্রে জেনেটিক ইনজেকশনের মাধ্যমে হয়ত কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে। তবে সেটা ব্যয়বহুল।

দুই ক্ষেত্রেই সার্জারি করার ব্যবস্থা আছে। তবে সেটা শেষ চেষ্টা।

এ রোগের কারণ হিসেবে আসলে বয়সটাই প্রথমে ধরা হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেটিনাল সাইকেল (RETINAL CYCLE) এর উপজাত হিসেবে তৈরি হয় কিছু রাসায়নিক পদার্থ– লিপোফিউসিন (LIPOFUSIN) এবং জমা হতে থাকে রেটিনার চারপাশে ঘিরে থাকা একটি স্তরে, যা রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াল নামে পরিচিত।

সাধারণত এই রাসায়নিক পদার্থ লিপোফিউসিন-গুলো কোনো ক্ষতি করে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বহন করছেন এই অপ্রয়োজনীয় উপজাত রাসায়নিক পদার্থ, লিপোফিউসিন।

তবে এই রাসায়নিক পদার্থ লিপোফিউসিন কোনোভাবে বিক্রিয়া (অক্সিডেশন) ঘটায় তবে সেটা তৈরি করবে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। যা মেকুলা ও রেটিনার ক্ষয় করা শুরু করবে। এছাড়া আরেকটি বড় কারণ হলো আলো।

আমরা অনেকেই জানি সাদা রং ৭টি ভিন্ন রংয়ের মিশ্রণে তৈরি হয়। যেটা আমরা সাধারণত সূর্যের আলো থেকে পাই। এর প্রত্যেক রংয়ের আলোর বিকিরণ ক্ষমতা রয়েছে। যাকে বলা হয়, হাই ওয়েভ লেন্থ (WAVE LENGTH)।

মজার বিষয় হলো আমাদের চোখের কর্নিয়া এই ৭টি রংয়ের ৬টির বেশিরভাগ অংশই রেটিনার ভেতরে পৌঁছাতে দেয় না। তবে নীল রংয়ের আলো কর্নিয়া ভেদ করে রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াল-এ জমে থাকা রাসায়নিক পদার্থ লিপোফিউসিন-এর সঙ্গে বিক্রিয়া (অক্সিডেশন) করে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে।

এই রোগ থেকে উদ্ধারের উপায় খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষণার শুরুতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। যা রাসায়নিক পদার্থ লিপোফিউসিন-এর বিক্রিয়া থামাবে অথবা কমিয়ে দেবে।

তবে বাজারে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া গেলেও কোনোটাতেই সেভাবে কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-এর মাঝে এন্থসিয়ানিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা চেরি, আঙুর, লালবাঁধাকপি, কলা, বেগুন ধরনের ফল ও সবজিতে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া জিয়াজেন্থিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা পালংশাক, ব্রকলি, ডিম, কমলা, ভুট্টা, কর্নজাতীয় খাবারে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।

এই দুই ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় খুবই অল্প কিছু ফল অথবা সবজির মাঝে। প্রাকৃতিক খাবারের মাঝে সহজেই যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় সেটা হলো ফ্লাভনয়েড।

দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সরকারি গবেষণা কেন্দ্র কোরিয়া ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজিতে দুই বছর (২০১১-২০১২) আমি এ বিষয়ের উপর গবেষণা করি।

গবেষণায় আমি কোরিয়ান কিছু পরিচিত মেডিসিনাল গাছ এবং সবজি থেকে ফ্লাভনয়েডজাতীয় কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বের করতে পেরেছিলাম। যা প্রাথমিক গবেষণায় রেটিনাতে জমে থাকা রাসায়নিক পদার্থ লিপোফিউসিন-এর অক্সিডেশন কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।

আমার জানা মতে প্রায় সকল শাকসবজি, ফল এবং ফাইবারজাতীয় প্রাকৃতিক খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফ্লাভনয়েডজাতীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা আমাদের সকলকেই হয়ত বয়সের সঙ্গে অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচাতে পারে।

এছাড়া আলো থেকে যেহেতু এই বিক্রিয়া ঘটার সম্ভবনা থেকে যায় সেক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব নিজেদের চোখ আলো থেকে বাঁচিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।