একদিনেই বেড়ানো যায় এসব জায়গাগুলোতে। শহর সিলেট আর আশপাশের কিছু দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়েই এবারের বেড়ানোর আয়োজন।
হযরত শাহজালাল (র) এর মাজার
সিলেট শহর ভ্রমণে সর্বপ্রথম ঢুঁ দিতে পারেন হযরত শাহজালাল (র) এর মাজারে। শহরের প্রাণ কেন্দ্রেই অবস্থিত এটি। প্রধান রাস্তা থেকে কিছুটা পথ ভেতরে গেলে মূল মাজার কমপ্লেক্স। শুরুতেই সামনে দেখা যাবে দরগাহ মসজিদ।
বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের ফলে মসজিদটি বর্তমানে আধুনিক রূপ নিলেও, প্রথম এটি তৈরি হয়েছিল ১৪০০ খ্রীস্টাব্দে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে মাজারে উঠার সিঁড়ি। গম্বুজ বিশিষ্ট একটি হল ঘরের মধ্য দিয়ে মাজারে প্রবেশ করতে হয়। এই হল ঘরের ঠিক পশ্চিমের ভবনটি ঘড়ি ঘর। ঘড়ি ঘরের আঙিনার পূর্ব দিকে যে তিনটি কবর রয়েছে তা হযরত শাহজালের ঘনিষ্ট তিনজন সঙ্গীর। এর দক্ষিণপাশে ছোট ঘরটি হযরত শাহজালালের চিল্লাখানা। কথিত আছে দুই ফুট চওড়া এ জায়গাতে তিনি জীবনের তেইশটি বছর ধ্যানমগ্ন কাটিয়েছেন।
এখান থেকে পাওয়া একটি শিলালিপি অনুযায়ী জানা যায়, সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজশাহের শাসনকালে ১৩০৩ সালে হযরত শাহজালালের হাতে এ অঞ্চল বিজিত হয়। হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন তিনি। সে সময়ে তুরষ্কের কুনিয়া শহর থেকে তিনি ৩১৩ জন শিষ্যসহ এদেশে আসেন। বহু যুদ্ধে বিজয়ের পর এখানেই তিনি থেকে যান। ১৩৪০ খ্রীস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মাজার কমপ্লেক্সের ভেতরে পূর্ব পাশের পুকুরে আছে বহুকালের ঐতিহ্য গজার মাছ। শত শত জালালী-কবুতরও রয়েছে এখানে। মাজার কমপ্লেক্সের পশ্চিম পাশের একটি ঘরে এখনও রক্ষিত আছে হযরত শাহ জালালের ব্যবহৃত তলোয়ার, খাবার বাসন, বাটি ইত্যাদি।
লাক্কাতুরা চা-বাগান
সিলেট শহর থেকে বিমানবন্দর সড়ক ধরে কিছুদূর এগুলেই লাক্কাতুরা চা-বাগান। ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন এ বাগান ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। সড়কের পাশেই প্রবেশ পথ। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে।
মালনিছড়া চা-বাগান
লাক্কাতুরা চা বাগান ছেড়ে বিমানবন্দরের দিকে একটু যেতেই চোখে পড়বে সুন্দর এই চা বাগান। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো এই চা-বাগান ১৮৫৪ সালে ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে। টিলা ঘেরা চা-বাগানের ভেতরে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করা যাবে সবুজের সৌন্দর্য। এছাড়া বানরও দেখেতে পাবেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশাববিদ্যালয়
সিলেট শহরের পাশে কুমারগাঁও এলাকায় অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘুরতে যেতে পারেন। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলামেলা ক্যাম্পাস ভালো লাগবে সবার।
ক্বিন ব্রিজ
সিলেট শহরের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা ক্বিন ব্রিজ। সুরমা সেতু নামেও এটি বেশ পরিচিত। ১৯৩৬ সালে নির্মাণ করা হয় লোহার তৈরি এ সেতু। ইংরেজ গভর্নর মাইকেল ক্বিনের নামেই এর নামকরণ করা হয়। ১১৫০ ফুট লম্বা এবং ১৮ ফুট প্রস্থ এ সেতুটি দেখতে ধনুকের মতো বাঁকানো। ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা ব্রিজটির একাংশ উড়িয়ে দেয়। পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের অর্থায়নে বিধ্বস্ত অংশটি পুনঃনির্মাণ করা হয়।
ক্বিন ব্রিজের উত্তর পাড়ে আছে পুরান একটি ঘড়িঘর। সেতুর পাশের এ জায়গাটির নাম চাঁদনীঘাট। কাঁটা থেমে থাকলেও নানান ইতিহাসের সঙ্গী এ ঘড়িঘরটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।
জানা যায় পৃথ্বিমপাশার বিখ্যাত জমিদার আলী আমজাদ খাঁ দিল্লীর চাঁদনীচকের শাহজাদী জাহানারার একটি ঘড়িঘর দেখে মুগ্ধ হন। তাই তিনি সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাটের কাছে অনুরূপ একটি ঘড়িঘর নির্মাণ করেন। এজন্যই সবাই একে জানেন আলী আমজাদের ঘড়ি নামে।
মনিপুরী জাদুঘর
শহরের সুবিদবাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এ জাদুঘর। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী সম্প্রদায় মনিপুরীদের শত বছরের কৃষ্টি আর ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে এ জাদুঘরের মাধ্যমে। দেখা মিলবে কয়েকশ বছরের পুরানো ঘন্টা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত নানান দ্রব্যসামগ্রী, যুদ্ধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, মনিপুরীদের ঐতিহ্যবাহি হস্তশিল্প সামগ্রীসহ আরও অনেক কিছু।
এমসি কলেজ
সিলেট শহরে অবস্থিত প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুরারীচাঁদ কলেজ বা সিলেট এমসি কলেজ। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশাল জায়গাজুড়ে এ কলেজের ক্যাম্পাসে এখনও আছে অনেক পুরানো স্থাপনা।
ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর
সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টের কাছে নাইওরপুলে আছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর বাস ভবন ‘নূর মঞ্জিল’। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনায় এ ঘরে বসেছে ওসমানী স্মৃতি জাদুঘর। খোলা থাকে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। আর অক্টোবর থেকে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। শুক্রবার খোলা থাকে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার এবং অন্যান্য সরকারী ছুটির দিনে জাতীয় জাদুঘর বন্ধ থাকে।
হযরত শাহ পরান ছিলেন হযরত শাহ জালালের ভাগ্নে। তিনিও ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে দক্ষিণগাছের খাদিমপাড়ায় এই মাজার। বিশাল বটগাছের ছায়াতলে এ মাজারে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্তের পদচারণায় মুখরিত থাকে পুরো মাজার এলাকা।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে সরাসরি সিলেট যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে।
এ পথে গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ' থেকে ১ হাজার ১শ' টাকা। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ' থেকে সাড়ে ৪শ' টাকা।
এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা এয়ারের বিমান যায় সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে।
কোথায় থাকবেন
সিলেট শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল আছে। শহরের নাইওরপুল এলাকায় হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)। জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)। ভিআইপি সড়কে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৮২৬৩)। লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)। আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)। দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)। হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)। জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০)। তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি।
এসব হোটেলে ৫শ' থেকে ৪ হাজার টাকায় রাত যাপনের ব্যবস্থা আছে।