বাংলার ঈদ

ঢাকা, মোগল রাজধানী হওয়ার আগে এখানে ‘ঈদ’ উৎসবে পরিণত হয়নি। কেননা উৎসব উদযাপনকারী তথা মুসলমানদের সংখ্যা তেমন একটা ছিল না। ফলে ঈদকে নিয়ে থাকত না আলাদা কোনো উৎসাহ কিংবা আয়োজন।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2014, 01:52 PM
Updated : 28 July 2014, 01:52 PM

১৬১০ সালে ঢাকায় মোগলরা এল। বাংলার প্রশাসক সুবাদার ইসলাম খান যখন নিজে পা রাখলেন ঢাকায় তখন তাঁর সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনী মিলিয়ে আনুমানিক ৫০ হাজার লোকজন। শুধু যে মোগলরাই এসেছিলেন তা নয়; তাদের খেদমতের জন্য এসেছিল বিশাল সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী এবং তাদের পরিবার পরিজন। ফলে সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়; হঠাৎ করে কীভাবে ঢাকা কোলাহলমুখর এক ব্যস্ত ‘রাজধানী’ হয়ে উঠেছিল।

মোগল ঢাকার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ‘ঢাকা কেল্লা’র (বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগার) চারপাশে গড়ে উঠেছিল ঢাকায় আগত পেশাজীবীদের আবাসস্থল। সে সময়কার ঢাকা বলতে বোঝানো হত আজকের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাঝামাঝি থেকে পাটুয়াটুলী বা সদরঘাটের আশপাশের অংশটুকু।

মোগলরা ঢাকায় আসায় উৎসব হিসেবে ‘ঈদ’ পালন করা হতে থাকে। শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে ‘ঈদ’ উৎসবে রূপ নেয়। মোগলদের ঈদ উদযাপন হত দু-তিন দিন ধরে। চলতো সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন। আত্মীয়স্বজন পরিবার পরিজন নিয়ে একরকম মেলাই বসে যেত।

অনুমান করে নেওয়া যায় এই মেলা আয়োজিত বাদশাহী বাজারে (বর্তমান চকবাজার), বিশেষ করে বললে তখনকার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকা কেল্লার (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার) আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট।

ঈদ মিছিলের জন্য চকবাজারে আপেক্ষমান ঢাকাবাসী, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। শিল্পী- আলম মুসাওয়ার।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সেই সময়ে বাংলার যে অঞ্চলেই মোগলরা থাকতেন (বিশেষ করে সামরিক এবং প্রশাসনিক কারণে) সেখানকার ঈদ উদযাপনের সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে চিত্র পাওয়া যায়।

তখন তাঁর দায়িত্ব পড়েছিল বোকাইনগরে। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, "সন্ধ্যায় যখন মোমবাতির আলোয় আলোকিত হত মোঘল আমলের ঢাকা শহর তখনও শেষ রোজার সন্ধ্যাকাশে উঠতো ঈদের চাঁদ। তখন শিবিরে বেজে উঠতো শাহী তূর্য (রণ শিঙ্গা) এবং গোলন্দাজ বাহিনী গুলির মতো একের পর এক ছুঁড়তে থাকতো আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো এই আতশবাজির খেলা। শেষ রাতের দিকে বড় কামান দাগা হত।"

সেই সময় ঢাকাবাসীরা বাদশাহী বাজার (বর্তমানে চকবাজার) থেকে ঈদের কেনাকাটা সারতেন।

ইসলাম খাঁর (ঢাকায় তার অবস্থানকাল ১৬১০-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) পর প্রায় ২৫ বছরের মধ্যে ঢাকার প্রসার ও বিকাশ ঘটে অতি দ্রুততার সঙ্গে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ সুজাকে সুবে বাংলার শাসক করে পাঠান ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। শাহ সুজা শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় তিনি ঢাকায় আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসেন ৩শ' শিয়া পরিবার। এদের আগমনে ঢাকার অভিজাত শ্রেণির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে ধানমন্ডির মোগল ঈদগাহের পাশে বসা ঈদের মেলার কাল্পণিক ছবি। শিল্পী : আসেম আনসারী।

প্রায় একই সময়ে ঢাকায় বসবাসকারী (১৬২৯-১৬৫০খ্রিস্টাব্দ) মোগল কর্মচারী কবি সাদিক ইসফানি তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, "সে সময়ে ঢাকায় অভিজাতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ অভিজাতদের পূর্ব পুরুষ এসেছিলেন শিরাজ, তেহরান, ইসফাহান, মাশহাদ, তাবরিজ এবং বোখারা থেকে। এতে বোঝা যায় সে সময়ে মোগলদের ঢাকা কতটা জমজমাট হয়ে উঠেছিল।"

ঢাকা এলেও শাহজাদা সুজা বিভিন্ন কারণে শহরটিকে পছন্দ করলেন না। তিনি কিছুদিনের (১৬৩৯-১৬৫৯) জন্য রাজধানী পরিবর্তন করে ঢাকা থেকে নিয়ে যান রাজমহলে। এ সময়ের ঢাকার মোগলদের ঈদের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি করা হয় একটি ঈদগাহ। এটি হল ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের ঈদগাহ। পোড়ামাটির ইটে তৈরি এ ঈদগাহটি তৈরি হয়েছিল ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে।

তখন থেকে ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মুসলমানরা এই ঈদগাহে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে। তবে সাধারণ নগরবাসীর এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ ছিল না। কখনও শাসকরা নতুন কোনো রাজ্য জয় করলে ঈদ উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত হত বাড়তি আনন্দ।

দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁর সময় (১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে) জয় করা হয়েছিল ত্রিপুরা। নবাব সুজা উদ্দিনের নির্দেশে ঢাকা কেল্লা থেকে ঈদগাহ যাওয়ার রাস্তায় ১ হাজার টাকা মুদ্রা দিয়ে দুই মাইল জুড়ে সাজানো হয়েছিল।

সিলেটের শাহী ঈদগাহ।

ঢাকার দেখাদেখি সিলেটেও মোগলরা তৈরি করে আরেকটি ঈদগাহ। শহরের এক প্রান্তে ‘শাহী ঈদগাহ’ এলাকার এক ছোট্ট টিলার উপর এই ঈদগাহর অবস্থান। মনোমুগ্ধকর এই ঈদগাহটি তৈরি করেছিলেন সিলেটের মোগল ফৌজদার ফরহাদ খান। সপ্তদশ শতাব্দীর সত্তর দশকে তিনি সিলেটের ফৌজদারের দায়িত্ব পান। তখন দিল্লীর সিংহাসনে সম্রাট আওরঙ্গজেব (শাসনামল ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল)। এই দায়িত্বপালনের সময়টুকুতে ফৌজদার ফরহাদ খান সিলেটের ‘ফরহাদ খান পুল’সহ অনেকগুলো মসজিদ, রাস্তাঘাট ও সুরম্য দালান গড়ে তুলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর আশির দশকে তিনি এই ঈদগাহ নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং সম্পূর্ণ নিজ তত্ত্বাবধানে তা নির্মাণ করেন বলে জানা যায়।

অত্যন্ত ২২টি বড় সিড়ি মাড়িয়ে ঈদগাহতে যেতে হয়। ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত শাহী ঈদগাহ। সীমানার চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় ১০টি প্রবেশপথ। ঈদগাহের সামনেই বিশাল পুকুর মুসল্লিদের ওযুর জন্য। এখানে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লি এক সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। এত লোক হয়ত সেই সময়ে হত না। এটা ঠিক ঈদে নামাজ পড়ার মতো একটা ভালো সংখ্যার মুসলমান গোষ্ঠী হয়ে গিয়েছিল তখনই। আর এটাই প্রমাণ করে ঢাকার বাইরেও ঈদ মোটামুটিভাবে একটি উৎসব হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

মোগল আমলে মেলাগুলো কেমন হত? সমসাময়িক মোগল লেখকদের স্মৃতিকথায় মোটা দাগে ঈদ উৎসবের কথাই লেখা আছে। সেখানে মেলা নিয়ে বিস্তারিত কিছু নেই। তারপরেও ধরে নেওয়া যায়- পারস্যের সংস্কৃতি চর্চা করা সেসব মোগলরা ঈদে মেলার আয়োজন করত। ‘নওরোজ’ (পারস্যের নববর্ষ) পালনের সময় যে মেলার আয়োজন করতো সে সূত্র ধরেই সম্ভবত ঈদের মেলারও আয়োজন করা হত। মোগলদের আমলে এটা চর্চার ফলে ঢাকায় ঈদের মেলার বোধহয় একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে যায়। আর দীর্ঘদিন ধরে সেটা চর্চা হতে থাকে। হয়ত ঢাকাকে অনুসরণ করে বাইরে এলাকাগুলোতেও ঈদ উৎসব উপলক্ষে শুরু হয় গ্রামীণমেলা। যা বাংলার অন্যন্যা পূজা-পার্বণ উপলক্ষে আগেও আয়োজিত হত।

এভাবে চলতে থাকলেও বাংলার শাসনযন্ত্রের উপর মূল ধাক্কা এসে লাগে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে। মোগল সম্রাটের কাছ থেকে ইংরেজরা বাংলার-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের ভার পায়। ঢাকার নায়েব-নাযিমরা পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে। পড়তি ঢাকার জৌলুস ধরার চেষ্টা করা হত ঈদ ও মহরমের মিছিলের মাধ্যমে। এই মিছিলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নায়েব-নাযিমরা। শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে নায়েব-নাযিমরা ঈদের পাশাপাশি মহরমেরও মিছিল বের করতেন। নিজেদের শৌর্য দেখানোর জন্য এ মিছিলগুলোর ছবি এঁকে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।

রাজধানীর বর্তমান ঈদ মেলা।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদের মিছিলের ছবি এঁকেছিলেন।

ঢাকার ঈদ ও মহরমের মিছিলের মোট ৩৯টি ছবি এঁকেছিলেন তিনি। চিত্রগুলোতে দেখা যায় ঈদের মিছিলগুলো নায়েব-নাযিমদের নিমতলী প্রাসাদ (বর্তমানে নিমতলী এলাকা), চকবাজার, হোসেনি দালান প্রভৃতি স্থাপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। মিছিলে থাকত সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি, অস্ত্র হাতে সৈন্যদল। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও হাতে থাকতো রং-বেরঙের ছাতা অথবা বাদ্যযন্ত্র। মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে নায়েব-নাযিমরা থাকতেন একেবারে সামনের দিকে। দর্শক হিসেবে থাকতেন অভিজাত শ্রেণির লোকজন। এ দেশীয়রাতো থাকতেনই সেই সঙ্গে থাকতেন ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপিয়ানরা। সেসময়ের এই আয়োজনগুলো মোগল ঢাকার উজ্জ্বল সময়ের কথা মনে করিয়ে দিতে পারতো।

হাকিম হাবিবুর রহমান, প্রখ্যাত নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, আশরাফ-উজ-জামানদের স্মৃতিকথায় গত শতকের বিশ-ত্রিশ দশকেও ঢাকায় যে ঈদের মিছিল বের হত তার বিবরণ পাওয়া যায়। সে শতাব্দীতেই চল্লিশ দশকের দাঙ্গায় এবং অন্যান্য কারণে ঈদের মিছিল বন্ধ হয়ে যায়।

এত গেল ঢাকার কথা। তবে ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলোতে ঈদকে উৎসব হিসেবে পালনের অবস্থা কী ছিল? কেননা শাসক স্থান থেকে মুসলমানদের অবস্থানটা সরে গেলে সেই প্রভাব নিশ্চয় গ্রাম বাংলাতেও পড়েছিল, এটা নিশ্চিত।

তবে এই অবস্থাতেও আমরা দেখতে পাই কিশোরগঞ্জে ১৮২৮ সাল থেকে শুরু হয় আজকের বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ার চল। এই ঈদগাহের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

ইসলামের প্রচারের জন্য ইয়েমেন থেকে আসা শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ির’ পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তাঁর নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। এই জামাতে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ নিজেই। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসল্লিদের আধিক্যতা প্রকাশে ‘সোয়া লাখ’ কথাটি ব্যবহার করেন।

আবার অনেকের মতে সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়েছিল। ফলে ‘সোয়া লাখ’ থেকে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল ‘সোয়া লাখ টাকা’। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে ‘সোয়ালাখিয়া’ সেখান থেকে ‘শোলাকিয়া’। পরে ১৯৫০ সালে স্থানীয় এক ধন্য ব্যক্তি দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ এই ময়দানকে অতিরিক্ত ৪.৩৫ একর জমি দান করেন। বর্তমান শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন ৭ একর। নরসুন্দা নদীর তীরে শোলাকিয়ার অবস্থান।

উনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করলে মুসলমানদের অভিজাত শ্রেণির (যারা মোগল সম্রাজ্যের অংশীদার এক আদি রইস পরিবারের ছিলেন) পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণির উত্থান দেখা যায়।

তারা ঢাকার আদিবাসী ছিলেন না। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরির অন্বেষণে এদের ঢাকায় আগমন এবং ঢাকাতেই স্থায়ী হয়ে যাওয়া এই সব নতুন ঢাকাবাসীরা বেশিরভাগই পল্লী অঞ্চলের ছিলেন। এসব মুসলমানদের ঢাকায় আসার ফলে রাজধানীর ঈদ উৎসবে নতুন কিছু সংযোজন হয়েছিল। যেমন বিভিন্ন ধরনের পিঠা, সেমাই ও ঈদের দিনে মেলার আয়োজন। এরা শুধু যে ঢাকাতেই হাজির হলেন তা নয় চাকুরির সুবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়লেন তাদের সংস্কৃতি নিয়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঈদ উদযাপনে ভিন্নতা আসা শুরু করল।

তাদের উপস্থিতি ঢাকার ঈদের মেলায় সংযোজন করে গ্রামীণ সংস্কৃতি। ফলে মেলা ঢাকার প্রাণকেন্দ্র চকবাজারেই সীমাবদ্ধ রইল না; ছড়িয়ে পড়ল শহরের আশপাশেও। সেটার সত্যতা পাওয়া যায় মুন্সী রহমান আলী তায়েশের স্মৃতিকথা থেকে।

তিনি তাঁর ‘তাওরারিখে ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন— উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার মুসলমানরা (তখন সম্ভবত প্রায় সব শ্রেণির মুসলমানরা একসঙ্গেই যোগ দিতেন) ধানমণ্ডির মোগল ঈদগাহে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে। যদিও সেই ঈদগাহ তখন অযত্ন অবহেলায় ‘জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ’। তারপরেও তায়েশের বর্ণনার উল্লেখযোগ্য অংশটি হচ্ছে— ‘ঈদ উপলক্ষে এখানে মেলা হত, সেখানে যোগ দিতেন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার লোকজন।’

পান্ডুনদীর কাছেই মেলা হওয়ায় নানান রকম ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে আশপাশের গ্রামের বিক্রেতার হাজির হতেন এই মেলায়। বলা যায় একধরনের গ্রামীন ও নাগরিক জীবনের মেলবন্ধনেরও সৃষ্টি হত। ধারণা করে নেওয়া যায়, এই মেলার ধারাবাহিকতায় ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ঈদ উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হতে থাকে।

এত গেল ঢাকাবাসীর ঈদ উদযাপনের খন্ডিত চিত্র। অপরদিকে ঢাকার আদি অভিজাত শ্রেণি যারা নিজেদের মধ্যে মোগল ঐতিহ্য বেশ করে চর্চা করতেন তাদের ঈদ উদযাপনটা ছিল খানিকটা ভিন্ন।

উনিশ শতকের আশির দশকের শেষ দিকে সেলাই মেশিনের ব্যবহার শুরু হলেও তাঁরা (যারা মোগল ঐতিহ্য বহন করতেন) হাতে সেলাইয়ের কাপড় পরতেন। ঈদ উৎসবে তাদের ঘরে পরিবেশিত হত তোরাবন্দি খাবার। সর্বমোট চল্লিশ রকমের খাবার থাকত এই তোরা বিন্দতে। অর্থনৈতিক কারণে এ তোরা বন্দি খাবার কালক্রমে ‘নিম তোরাবন্দি’ বা অর্ধেক তোরাবন্দিতে পরিণত হয়ে গত শতাব্দীর বিশ দশকের দিকে এসে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ঢাকার নবাব বাড়িতেও ঈদে বিভিন্ন ধারায় আনন্দের ব্যবস্থা ছিল। খানা-পিনা হত জাঁকজমকের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলায় অন্দরমহলে নাচ-গানের আসর জমাত হিজড়ার দল। আলো দিয়ে সাজানো হত আহসান মঞ্জিল।

গত শতকের ত্রিশ দশক থেকে ধীরে ধীরে ঈদ উদযাপনে ভিন্নতা আসতে শুরু করে। ততদিনে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে, টকি সিনেমা এসেছে, এসেছে রেডিও, ধানমণ্ডির ময়দানে হয়েছে অ্যারোপ্লেন নামার জন্য অ্যারোফিল্ড।

ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রাম থেকে বেড়াতে এসে দর্শনার্থীরা যেতেন ঢাকার কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে। এসবের মধ্যে ছিল সদরঘাটের কালু খাঁ কামান, হুসেনি দালান, ফরাশগঞ্জের লোহার পুল, হাতির পুল, রমনার রেসকোর্স, লালবাগের কেল্লা, বড় কাটরা ছোট কাটরা।

ঈদের দিন সিনেমা হলগুলোতে ঈদের বিশেষ ছবি প্রদর্শন করা হত। এই দশক থেকে বাংলার মানুষ ঈদ এলেই একটি গান শুনতে পায় অথবা বলা যেতে পারে এই গান শুনে সবাই বুঝতে পারে ঈদ এসেছে। আর সেই গানটি হলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।' শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল ইসলাম এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন। লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে যা প্রকাশ করা হয়। বুঝাই যাচ্ছে ব্যবসায়িক একটা ভাবনা এতে কাজ করেছে।

গ্রামোফোন কোম্পানি এটির রেকর্ড প্রকাশ করে। রের্কডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। ‘হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সাল।

তবে একবিংশ শতাব্দীতে এখন ঢাকাবাসীর ঈদের উদযাপনের মাত্রা বিভিন্ন রকম। ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ চাঁদ দেখা যাক বা না যাক সরকারী ঘোষণাতেই এখন ঠিক হয় কবে ঈদ হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সবচেয়ে বড় উৎসব।

সাধারণভাবে যানজট পীড়িত ঢাকা থেকে প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ ঈদের উৎসব পালনের জন্য নিজ নিজ দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ায় রাজধানী অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। আর এই উৎসবের শুরুটাই যেন হয় টিকেট কাটার লড়াই দিয়ে। বাস, ট্রেন আর লঞ্চে থাকে ব্যাপক ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে নিজের প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারাই যেন বিশাল আনন্দ।

লেখক: তরুণ ঢাকা গবেষক রিদওয়ান আক্রাম। 

প্রকাশিত বই: ১. ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন (২০০৬), বাঙালায়ন, ঢাকা। ২. ঢাকার কোচোয়ানরা কোথায় (২০০৭) রিদম প্রকাশন, ঢাকা। ৩. ড’য়লির ঢাকা (২০০৯) আকাশ প্রকাশন, ঢাকা। ৪. ঘটনা সত্য (২০১২) ইছামতি, ঢাকা। ৫. ঢাকাই খাবার (যৌথ), (২০১৩), বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা। ৬. ঢাকা কোষ (যৌথ), (২০১৩), বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা।