আম খেতে শিবগঞ্জ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি আমের চাষ হয়। আর শিবগঞ্জ উপজেলায় বসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট।

মুসস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2014, 10:12 AM
Updated : 20 June 2014, 10:12 AM

এই এলাকায় আরো আছে প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা। আমের মৌসুমে তাই ঘুরে আসতে পারেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে।

আমবাগান

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ছেড়ে মহানন্দা সেতু পার হলে মসৃণ পিচঢালা পথ চলে গেছে সোনামসজিদ স্থল বন্দরে। এই রাস্তার দুই পাশে শুধুই আম বাগান। এই মৌসুমে সব বাগানেই দেখা যাবে কৃষকদের ব্যস্ততা। গাছগুলোর ডাল আমের ভারে মাটি ছুঁই ছুঁই। পছন্দমতো যে কোনো বাগানেই ঘুড়ে বেড়ানো যায়।

কানসাট আমবাজার

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের বাজার, কানসাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আমের বিকিকিনি। দেশের নানান প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পাইকারি ক্রেতা এ বাজারে আসেন আম কিনতে। সাইকেল কিংবা রিকশাভ্যানে বোঝাই করে আম নিয়ে গভীর রাত থেকেই এ বাজারে জড়ো হতে থাকেন আম চাষীরা। আমের সময়ে সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে হাট বসে।

কানসাট আমবাজার / মুস্তাফিজ মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

কানসাটের আমবাগান / মুস্তাফিজ মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছোট সোনামসজিদ

কানসাট আম বাজার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার গেলে রাস্তার পূর্ব পাশে দেখা যাবে সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনামসজিদ। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদ দেখতে খুবই দৃষ্টি নন্দন।

প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী, জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলীর তত্ত্ববধানে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। শিলালিপি থেকে তারিখ মুছে যাওয়ায় মসজিদ তৈরির সঠিক সময় জানা যায়নি।

তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ’র নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোন এক সময় নির্মিত।

মসজিদের পূর্বপাশের সমাধিক্ষেত্রের ভিতরে একটি পাথরের প্ল্যাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি আছে। এখানে কারা সমাহিত রয়েছেন তা সঠিক জানা যায় নি। তবে জনশ্রুতি আছে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলী এখানে সমাধীস্থ আছেন।

মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যনন্তরে দক্ষিণ পূর্ব কোণে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে। যার একটিতে সমাহিত আছেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর।

তাহখানা কমপ্লেক্সে শাহ নিয়ামত উল্লাহর মসজিদ ও সমাধি / মুস্তাফিজ মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তাহ্‌খানা কমপ্লেক্স

সোনামসজিদের পশ্চিম পাশে বিশাল একটি দিঘির ধারে অবস্থিত পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর সবচেয়ে দক্ষিণেরটি হল তাহখানা। এই ভবনে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। লাগোয়া পূর্ব দিকের দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনের পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল।

নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহসুজা, তার বসবাসের জন্য ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার কারো কারো মতে শাহসুজা গৌর অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।

তাহ্‌খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ। এর পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চারপাশে আছে অল্প উচু দেয়াল। পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ।

মসজিদের পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে এলাকার মানুষের কাছ থেকে জানা যায়, শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন সম্রাট শাহজাহান। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগ দখল করে এর আয় থেকে তার খানকার খরচ চালাতেন। বাকি অর্থ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।

মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গা জুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনি। মাঝখানে মূল সৌধের চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধান বেশ কিছু কবর। দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌর এলাকায়।

শাহসুজা তখন বাংলার সুবাদার। তিনি নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। তারপর থেকেই এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন নিয়ামত উল্লাহ। ১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।    

দরসবাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ / মুস্তাফিজ মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

দরসবাড়ি মাদ্রাসা ও মসজিদ

তাহখানা থেকে সামনে সোনামসজিদ স্থল বন্দরের আগে, রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনায় ৪০টি কক্ষ ছিল। ৪১.৫ মিটার আঙিনার চারপাশে ঘিরে ছিল ৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো।

এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান। সেখান থেকে জানা যায় মাদ্রাসাটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে নির্মাণ করেছিলেন।

দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষা কেন্দ্র। আর দরসবাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে পরিচিতি পায়।

দরসবাড়ি মাদ্রাসা থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের অপরপাশে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ এটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন।

মসজিদের ছাদ বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। আর সামনে আছে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ। বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্য বৈশিষ্টের এই মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটার কাজ রয়েছে।

মসজিদের দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের স্তম্ভগুলো। কারুকার্য খচিত মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের মিহরাবগুলি এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

কোতোয়ালী দরওয়াজা

ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে ছোট সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে ভারতের প্রবেশ পথটিই কোতওয়াল দরজা। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ কোতওয়াল-এর অনুকরণে এর নামকরণ। এ নগর পুলিশ প্রাচীন গৌর নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়।

প্রবেশ পথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলি দিয়ে শত্রুর উপর গুলি কিংবা তীর ছোড়া হত বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত কোতোয়ালী দরওয়াজা সাধারণভাবে কাছে গিয়ে দেখার উপায় নেই। সোনামসজিদ স্থল বন্দরে দাঁড়িয়ে কেবল দূর থেকে দেখা সম্ভব। কারণ এটি ভারতের অংশে পড়েছে।

খনিয়াদিঘি মসজিদ

সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের বাম পাশে আম বাগানের ভেতরে খনিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই মসজিদ। ইটের তৈরি এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা।

পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মূল মিহরাব অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটায় আচ্ছাদিত ছিল। যার অনেকগুলো এখনো বিদ্যমান।

খনিয়াদিঘি মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যিক রীতির বিচারে ঐতিহাসিকগণ এটিকে পরবর্তী ইলিয়াস ইলিয়ামশাহী আমলে ১৪৮০ সালের দিকে নির্মিত বলে মনে করেন।

মসজিদের পূর্ব দিকেই রয়েছে রয়েছে প্রাচীন আমলের খনিয়াদিঘি। এ কারণেই এরকম নামকরণ। তবে মসজিদের অন্য একটি নাম হল, রাজবিবি মসজিদ।

ধুনিচক মসজিদ / মুস্তাফিজ মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ধুনিচক মসজিদ

খনিয়াদিঘি মসজিদের প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি মসজিদ। ইটের তৈরি আয়তকার এই স্থাপনার  নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণ শৈলী বিবেচনায় এ মসজিদও ১৫ শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।     

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে যেতে পারেন কানসাট। এছাড়া বাসে জেলাশহরে পৌঁছে সেখান থেকে বিভিন্ন নিদর্শন ও আমবাগান দেখতে যাওয়া যেতে পারে।

ঢাকার গাবতলী থেকে সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যায় দেশ ট্রাভেলস এর এসিবাস। ভাড়া ১ হাজার টাকা। এছাড়া দেশ ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহনের ননএসি বাস যায় সরসরি কানসাট বাজার, ভাড়া সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কানসাট, সোনামসজিদ স্থল বন্দরে যাওয়ার জন্য লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৪৫ থেকে ৬৫ টাকা। 

যেখানে থাকবেন

কানসাটে থাকার ভালো কোন ব্যবস্থা সেই। সারাদিন ঘুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে এসে রাত যাপন করতে হবে। এ শহরের শান্তির মোড়ে হোটেল আল নাহিদ, আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী, লাখেরাজপাড়ায় হোটেল রাজ ও হোটেল রংধনু।

সাধারণমানের এসব হোটেলে ২শ’ থেকে ২ হাজার টাকায় কক্ষ ভাড়া পাওয়া যাবে।