দন্ত্য বন্দনা

আজকাল আমরা বেশ ত্বক সচেতন তো বটেই, দাঁত কিংবা মুখের ভেতরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও চিন্তিত থাকি।

ইশরাত মৌরিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2014, 02:14 AM
Updated : 20 May 2014, 02:14 AM

দাঁত কেনো হলুদ, ছবি তুলতে গেলে দাঁত সুন্দর লাগে না কিংবা দাঁতে সাদা পাথরের মতো কি যেন জমছে। আবার যারা ধূমপায়ী তাদের চিন্তা— মাড়ি কালো হয়ে যাচ্ছে, দাঁতে দাগ পড়ছে।

এরকম বিভিন্ন সমস্যার কারণ আর সমাধান দিয়েছেন চিল্ড্রেন্স ওরাল হেলথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. মঞ্জুরুল আলম সাগর।

হলুদ দাঁত

দাঁত হলদে হওয়া মানেই কোনো সমস্যা নয়। সাধারণত দাঁতের রং দুই রকম হয়, সাদা এবং হলুদ। সত্যি বলতে পৃথিবীতে গোত্র বা মানুষ ভেদে ৩২ শেইডের দাঁত হতে পারে। জন্মগত কারণে রংয়ের তারতম্য হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ইউরোপিয়ান শ্বেতবর্ণের চেয়ে আফ্রিকান কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের দাঁত সাদা হয়।

জেনেটিক বা জন্মগত কারণ ছাড়া আরো কিছু কারণে দাঁতের রং বিকৃত হতে পারে। যেমন: নিয়মিত বা ঠিকমতো দাঁতের যত্ন না নেওয়া। ধূমপান থেকে স্টেইন।

খাদ্যাভ্যাস: পান, চা, কফি বা অ্যালকোহলজাতীয় দ্রব্য বেশি খেলে বা, পরিবেশগত কারণ: সাপ্লাই বা খাবার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লোরাইড দাঁতের হলদেভাবের অন্যতম কারণ হতে পারে।

আঘাত পেলে বা মুখে কোনো কারণে ব্যথা পেলে দাঁতের রং হলদে বা লালচে হয়ে যায়। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।

কিছু অষুধ যেমন: টেট্রাসাইক্লিন বা ডক্সিসাইক্লিন-জাতীয় কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় কিছু অষুধ দাঁতের রং পরিবর্তনের কারণ।

অন্যান্য: কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন এমন রোগী, গর্ভবতী মা, অনেকদিন ধরে মুখে ডেঞ্চার ব্যবহারকারী, বা বৃদ্ধদের দাঁতের রং বিকৃত হয়ে যেতে পারে।

হলদেভাব দূর করার উপায়

নিয়মিত এবং সঠিকভাবে দাঁত ও মুখের যত্ন নিলে এ ধরনের যে কোনো সমস্যা কম হয়। এছাড়া ধূমপান, তামাক, পান খাওয়া, অ্যালকোহল বর্জনসহ খ্যাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন অন্যতম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

দাঁত সাদা করার চিকিৎসা

দাঁত সাদা করার সর্বাধুনিক পদ্ধতিকে বলা হয় ব্লিচিং। বিভিন্ন প্রকারের ব্লিচিং পদ্ধতিতে দাঁতের রং সাদা করা সম্ভব। কালের চাহিদায় এখন অনেক দন্তচিকিৎসক এই পদ্ধতিতে কাজ করছেন।

কমপোজিট ফিলিং বা বন্ডিং: আপনার পছন্দের শেইড অনুযায়ী বন্ডিং করে নেওয়া যেতে পারে। এটি এক ধরনের কম্পোজিট জিলিং ম্যাটিরিয়াল। তবে সবগুলো দাঁত হলদে হয়ে গেলে এই পদ্ধতিতে না যাওয়াই ভালো।

পোরসেলিন ক্রাউন বা ক্যাপ বা ভিনিয়ার: দাঁতের ক্যাপ বা ক্রাউন সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন।

এছাড়াও কিছু ভেষজ উপাদান দাঁত সাদা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। যেমন: লেবু, নিম, তুলসি, কমলার খোসা। পরিমিত পরিমাণে বেকিং সোডা বা হাইড্রজ়েন পারক্সাইড দিয়ে কুলিকুচি করেও উপকার হয়।

কালো মাড়ি

দাঁতেরমতো মাড়ির রং গোত্র ভেদে কালচে বা গোলাপি হতে পারে। সাধারণত গোলাপি মাড়ি মানে সুস্থ মাড়ি, যেখানে সঠিকভাবে রক্ত চলাচল করে।

এছাড়া কিছু কারণে মাড়ির রং কালচে হতে পারে। যেমন: অটো-ইমিউনোডিজোর্ডারস্, ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত মাড়ির ইনফেকশন, ধূমপান, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, তীব্র অপুষ্টি, কিছু ভাইরাস, ভিটামিন বি ১২ স্বল্পতা, কিছু এন্ডোক্রাইন ডিজ অর্ডার এবং কিছু ডেভেলপমেন্টাল রোগ যেমন- ফরবেস অ্যালব্রাইট সিন্ড্রম।

ধূমপায়ীদের মাড়ি কালো হওয়ার কারণ

ধূমপানের ফলে মাড়ির স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হয়। মাড়ির রক্তনালীকাগুলো আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে আসে। রক্তসঞ্চালনের অভাবে মাড়ি কালো বা কালচে রূপ ধারণ করে। ধূমপান ত্যাগে মাড়ি স্বাভাবিক রং ফিরে পেতে পারে। তবে সেটি খুব দ্রুত হয় না।

এছাড়াও অতিরিক্ত ধূ্মপানের ফলে ‘স্মোকারস্ মেলানোসিস’ নামের একটি রোগ হতে পারে। যার কারণে মাড়িতে কালো কালো স্পট তৈরি হয়।

মাড়ির কালোভাব দূর করার উপায়

নিয়মিত দাঁত ব্রাশ। ডেন্টালফ্লস ব্যবহার করা। ধূমপান ত্যাগ করা। ভিটামিনযুক্ত খাবার খাওয়া। অতিরিক্ত কালো মাড়ির জন্য সার্জারি পর্যন্ত করা যেতে পারে। সাধারণত ‘স্কালপেল সার্জিকাল টেকনিক’ অথবা ‘ক্রায়ো সার্জারি’ করা হয়ে থাকে।

দাঁতে পাথর

প্রায়ই দুই দাঁতের মাঝে বা দাঁত ও মাড়ির সংযোগ স্থলে শক্ত পাথরের মতো বস্তু জমতে দেখা যায়। এটা ব্রাশ করার পরেও চলে যায় না। ডাক্তারি ভাষায় একে ডেন্টাল ক্যালকুলাস বলা হয়। 

এটা আসলে কিছু ব্যাকটেরিয়াল কলনির ক্যালসিফাইড রূপ।

পাথর পড়ার কারণ

রাতে দাঁত ব্রাশ না করে ঘুমানোর ফলে জমে থাকা খাদ্যকণাগুলোতে ব্যাকেটেরিয়া কলনি তৈরি করে। প্রায় ১২ ঘন্টা পর্যন্ত যদি ব্রাশ না করা হয় তাহলে প্লাক তৈরি হয়। যাদের দাঁত ব্রাশ করার পদ্ধতি ঠিকমতো হয় না, বা সবজায়গায় ব্রাশ পৌঁছায় না, তাদের ক্ষেত্রে এই প্লাক আস্তে আস্তে ক্যালসিফাইড হয়ে মোটামুটি ৯ থেকে ২১ দিনের মধ্যে শক্ত খোলসের মতো পাথুরে রূপ নেয়।

পাথর দূর করার উপায়

দাঁতের পাথর দূর করার জন্য ‘স্কেলিং’ করতে হয়। বছরে অন্তত একবার স্কেলিং করা উচিত। কারণ এই পাথর বা ক্যালকুলাস মাড়ির ইনফেকশনের অন্যতম কারণ।

মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার কারণ

দাঁত ব্রাশ করার সময় রক্ত পড়ার আসল কারণ মাড়ির ইনফেকশন। এটি দূর্বল মাড়ির লক্ষণ। দাঁতে জমে থাকা পাথর থেকে প্লাক জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। জমে থাকা প্লাক সিআইপিডি বা ক্রনিক ইনফ্লাম্যাটোরি পিরিয়োডোন্টাল ডিজিজ-এর জন্ম দেয়। এই অবস্থায় দাঁত পরিবেস্টিত করে রাখা মাড়ি থেকে রক্ত পরে।

এছাড়া কিছু শারীরিক রোগ যেমন: হেমোফিলিয়া, এপ্লাস্টিকএনেমিয়া, লিউকেমিয়াবাস্কার্ভি হলেও মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে।

রক্তপড়া বন্ধের উপায়

আগে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। নিয়মিত ও সঠিক নিয়মে দাঁত ব্রাশ এবং মুখের যত্ন নিতে হবে। বছরে অন্তত একবার স্কেলিং করাতে হবে। ভিটামিন বি ও সি মাড়ি রক্ষায় সহায়ক।

মডেল: সালমিন

ছবি: ই স্টুডিও