অকাল বার্ধক্যের প্রতিকার

নিজেকে কি বয়সের চাইতে বুড়ো লাগছে? যদি আয়নায় নিজেকে বেশি বয়স্ক দেখায়, তাহলে প্রতিদিনের কাজের রুটিন পরিবর্তন করার সময় হয়েছে আপনার।

প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2014, 03:17 AM
Updated : 6 May 2014, 06:52 AM

হেলথ ডটকম-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুড়োটে দেখানোর অন্যতম কারণ হতে পারে প্রতিদিনের ১২টি অভ্যেস।

১. সকল কাজের কাজী

সময়টাই এই রকম, একসঙ্গে অনেক কাজ না করলে যেন উপরে উঠার সিঁড়িই বাওয়া যায় না। অথচ ‘মাল্টিটাস্ক’ মানসিক চাপের সৃষ্টি করে, যা শরীরে প্রভাব ফেলে।

ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের ডাক্তার রেইমন্ড কাসশারি বলেন, “অনেকেই মনে করেন মাল্টিটাস্কিং করা ভালো। তবে এটা মানসিক চাপ বাড়ানো ছাড়া আর কিছু করে না।”

গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিনিয়ত মানসিক চাপের কারণে শরীরে অনুগুলো অস্থির হয়ে থাকে, ফলে কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা আর ঠিক হয় না। এর থেকে ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে।

তাই কাসশারির পরামর্শ হচ্ছে, একটা কাজ শেষ করে তবেই অন্য কাজ শুরু করুন।

২. বেশি মিষ্টি খাওয়া

ওজন বাড়ানো ছাড়াও চামড়ায় বয়সের ছাপ ফেলে মিষ্টি বা চিনি।

ওজন বাড়ানো ছাড়াও চামড়ায় বয়সের ছাপ ফেলে মিষ্টি বা চিনি।

স্যান ডিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়ার সার্টিফায়েড চর্মরোগবিশেষজ্ঞ ডা. সুসান স্টুয়ার্ট বলেন, “চিনির অনুগুলো শরীরে ভিতরে প্রতিটি কোষের প্রোটিনতন্তুর সঙ্গে লেগে থাকে। এই ক্ষতিকারক প্রক্রিয়ার নাম গ্লাইকেশন।”

তিনি জানান, এর ফলে ত্বকের উজ্জ্বলতা হারায়, চোখের নিচে কালি পড়ে, শরীরে ফোলাভাব আনে, চামড়া কুঁচকে যায় ও ত্বকে বলিরেখা দেখা দেয়।

তাই তরুণ দেখানোর জন্য অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া থেকে দূরে থাকুন।

৩. কম ঘুম

ঘুমে কার্পণ্য করলে বয়স্ক দেখায়। রাতে পাঁচ ঘন্টার কম ঘুমালে শুধু চোখের নিচে কালি পড়ে না, সঙ্গে বয়সও বাড়িয়ে দেয়।

কাসশারি সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের ঘুম গবেষণাগারের ফলাফল থেকে বলেন, “সাত ঘন্টার মতো ঘুমানো সন্তোষজনক।”

বেশি রাত না জেগে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। কারণ রাতে কম ঘুমালে দিনে কম এনার্জি পাওয়া যায়, ঢিলামি বোধ হয়, মনোযোগে দিতে সমস্যা হয়, পাশাপাশি ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।

৪. মেগাসিরিয়ালে বিপত্তি

ধারাবাহিক নাটক দেখা এক কথা, আর ধারাবাহিকভাবে টিভি দেখে যাওয়া অন্যকথা।

ব্রিটিশ জার্নাল স্পোর্টস মেডিসিন প্রায় ১১ হাজার অস্ট্রালিয়ানের উপর এক জরিপ চালায়। যাদের বয়স ছিল পঁচিশের উপর। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে এক ঘন্টা টেলিভিশন দেখার ফলে প্রতিটি মানুষ ২২ মিনিট করে জীবনের প্রতি আগ্রহ হারায়। আরেকভাবে বলা যায়, দিনে ছয় ঘন্টা টিভি দেখলে পাঁচ বছর আয়ূ কমে।

কাসশারি বলেন, “চুপচাপ বসে থেকে টিভি দেখলে বেশি ক্ষতি হয়। যখন ৩০ মিনিটের বেশি চুপচাপ বসে থাকা হয় তখন শরীরের কোষে চিনি জমতে থাকে। ফলে ওজন বাড়ে।”

৩০ মিনিটের বেশি টিভি দেখলে বা বসে কাজ করার পর কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করার পরামর্শ দেন তিনি।

৫. বসে থাকা

যারা বেশিরভাগ সময় বসে সময় কাটায় তাদের স্থুলতা ছাড়াও কিডনি রোগ, কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং ক্যান্সার হতে পারে।

সাধারণভাবেই যারা কায়িক পরিশ্রম করেন বা ব্যয়ামের মধ্যে থাকেন তারা বেশিদিন বাঁচেন।

ব্রিটিশ জার্নাল স্পোর্টস মেডিসিনের জরিপে দেখা যায়, যারা সপ্তাহে ১৫০ মিনিট বা, এর বেশি ব্যয়াম করেন তারা নিষ্কর্ম মানুষের চাইতে ১০ থেকে ১৩ বছর বেশি বাঁচেন।

৬. চোখের ক্রিম

মুখের অন্যান্য জায়গার চাইতে চোখের আশপাশের চামড়া পাতলা হয়। তাই অক্ষিবলয়ের চারপাশে বলিরেখা তাড়াতাড়ি পড়ে। এই কারণে ত্বকের যত্নের পাশাপাশি চোখের চামড়ার যত্নের জন্য ‘আইক্রিম’ ব্যবহার করা উচিত।

ডা. সুসান স্টুয়ার্ট বলেন, “চোখের আশপাশ যত বেশি আদ্র রাখা যায়, ততই বার্ধক্যের ছাপ কম পড়ে।”

মাছের তেল বলিরেখা প্রতিরোধে সহায়ক।

তার ভাষায়, “ভালো আইক্রিমের মধ্যে আছে ভিটামিন এ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ময়েশ্চারাইজার, হায়ালোরনিক এসিড ও ভিটামিন সি। এগুলো ত্বক টানটান রাখতে সাহায্য করে। ফলে সহজে চোখের আশপাশে বলিরেখা পড়ে না।”

৭. সানস্ক্রিনের ব্যবহার

একটু বাইরে যাওয়া, বাজার করা, রোদের মধ্যে মটরসাইকেল-সাইকেল-গাড়ি চালানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। এতে ত্বকে বলিরেখা পড়ার সম্ভাবনা কমে। তথ্যটি জানিয়েছেন ওয়েইক ফরেস্ট ব্যাপ্টিস্ট মেডিকেল সেন্টারের চর্মরোগ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. সারাহ এল. টেইলর।

তিনি বলেন, “বলিরেখা পড়ার অন্যতম কারণ হল সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বা আলট্রাভায়োলেট এক্সপোজার। এমনকি মেঘলা বা বৃষ্টিদিনেও ইউভি লাইট থাকে। এই রশ্মি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় সানস্ক্রিন। বিশেষ করে ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের এই ক্রিম দিনেরবেলা বাইরে গেলেই ব্যবহার করা উচিত।”

৮. অতিরিক্ত মেইকআপ

বেশি পরিমানে প্রসাধনী ব্যবহার করলে মুখে পড়তে পারে বয়সের ছাপ।

ডা. সুসান স্টুয়ার্ট বলেন, “তৈলাক্ত প্রসাধনী বেশিমাত্রায় ব্যবহার করলে লোমকূপ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে প্রসাধনীর কেমিকেল, সুগন্ধীযুক্ত ও অ্যালকোহল ত্বক শুষ্ক করে ফেলে। যা থেকে দেখা দেয় বলিরেখা।”

তাই স্টুয়ার্টের পরামর্শ হচ্ছে এসব ব্যবহারের আগে একজন চর্মরোগবিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া উচিত।

৯. উপুর হয়ে ঘুমালে

বালিশে মাথা গুজে শুয়ে থাকলে বা উপুর হয়ে শুয়ে থাকলেও মুখে বার্ধক্যে ছাপ পড়ে।

ফেইশল প্লাস্টিক সার্জন ও স্কিনকেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. জেমস সি. মারোত্তা বলেন, “সবসময় উপুর হয়ে ঘুমালে মুখের সংযোগ কোষগুলোর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মুখে বালিশের ভাঁজের দাগ পড়ে। দিনের পর দিন এভাবে ঘুমালে সেই দাগগুলোই মুখে বার্ধক্যে রেখা ফেলে দেয়। তরুণ বয়সের তুলনায় অধিক বয়সে সেই দাগ সহজে দূর হতে চায় না।”

১০. স্ট্র দিয়ে পানীয় খাওয়া

রঙিন যে কোনো পানীয় স্ট্র দিয়ে টেনে খাওয়ার সময় ঠোঁট সরু করতে হয়। এই সময় চোখও কুঁচকে যায়। যা থেকে হতে পারে বলিরেখা। কারণ ঠোঁট চোখা করলে মুখের আশপাশের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে।

নিউ ইয়র্কের চর্মরোগবিশেষজ্ঞ ডা. জ্যানেট প্রেস্টোয়াস্কির ভাষায়, “সিগারেট টানার সময়ও একই ব্যাপার ঘটে।”

যারা কায়িক পরিশ্রম করেন বা ব্যয়ামের মধ্যে থাকেন তারা বেশিদিন বাঁচেন। মডেল: ফরহাদ / ছবি: ই স্টুডিও।

তাই এই চিকিৎসকের পরামর্শ হচ্ছে, যারা কোমল পানীয় বেশি ভালোবাসেন তারা স্ট্র বাদ দিয়ে গ্লাসে খাওয়ার অভ্যাস করুন।

১১. খাবার থেকে সব ‘ফ্যাট’ বাদ দিলে

কিছু ফ্যাট বা চর্বি-জাতীয় খাবার শরীরে যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে। জানালেন নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের সার্টিফায়েড পুষ্টিবিদ ও ফিজিওলজিস্ট ফ্রানসি কোহেন।

তিনি বলেন, “তৈলাক্ত মাছ (যেমন স্যামন) থেকে হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। আখরোট বা কাঠবাদাম ত্বক নমনীয় ও পুরু রাখতে সাহায্য করে। এগুলো বলিরেখা প্রতিরোধে সহায়ক। সেই সঙ্গে হৃদপিণ্ড ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাও বাড়ায়।”

তিনি আরও জানান, সপ্তাহে অন্তত দুই দিন খাবারে তালিকায় মাছ রাখার পরামর্শ দিয়েছে দি অ্যাকাডেমি অফ নিউট্রিশন এন্ড ডায়েটেটিকস।

১২. জবুথবু থাকা

“ঘন্টার পর ঘন্টা কিবোর্ডের সামনে বসে কাজ করলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে আপনাকে করে তুলতে পারে অনাকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথাও হতে পারে।” বললেন, ক্যালিফোর্নিয়া আরভাইনের হোয়াগ অর্থপেডিক ইনিস্টিটিউটের অস্থি ও মেরুদণ্ডের সার্জন ডা. জেরিমি স্মিথ।

তিনি আরও বলেন, “এস’ আকৃতির ‘ওয়েল-ব্যালেন্সড’ মেরুদণ্ড আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখে। জবুথবু হয়ে থাকা বা বাঁকা হয়ে বসে বেশিক্ষণ কাজ করলে মাংসপেশী, হাড়ের জোড়া ও হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শরীর প্রায়ই ব্যথা করবে। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়তে হবে। বেশিদিন এভাবে চললে স্থায়ী ক্ষতিও হয়ে যাবে।”

বসে কাজ করার সময় কান, কাঁধ ও নিতম্ব যেন একই সরল রেখায় বা সমান্তরাল থাকে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।