রঙিন চুড়ি

যে চুড়ি একসময় ছিল বিবাহিত মেয়ের প্রতীক। সেই চুড়ি এখন ফ্যাশনের অনুষঙ্গ।

মনি ইয়াছিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2014, 02:12 AM
Updated : 27 April 2014, 02:38 AM

“ক্যাম্বোডিয়ান বাদকদলের সঙ্গে নাচিয়ে মেয়ের চুড়ি পরা হাতের দিকে আমার চোখ আটকে গেল। কারণ, কয়েকদিন আগেই এই রকম চুড়ি আমি দেখেছি। তবে ক্যাম্বোডিয়ার কোনো সমভূমিতে নয়, উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। সেখানে এক নারীর হাতে জড়িয়ে আছে অনেক চুড়ি, সে জীবিত নয়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। তার ফসিলের হাতে চুড়িগুলো লেপটে আছে যেন।”

ইতিহাসভিত্তিক ওয়েবসাইট স্মিথসোনিয়ানম্যাগ ডটকম-এ প্রত্নতাত্ত্বিক লেখক অ্যান্ড্রু ললার তার ‘বডিস অফ এভিডেন্স ইন সাউথইস্ট এশিয়া’ প্রবন্ধ এভাবেই শুরু করেছেন।

তিনি আরও বলেন, “এর থেকেই বোঝা যায় ১২শ’ শতাব্দীর ক্যাম্বোডিয়ার অ্যাঙ্কর ওয়াট মন্দিরের খেমার কারিগরদের পাথরে খোদাইয়ের অনেক আগেই চুড়ি পরা হাতের ছোঁয়া লেগেছিল।”

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, এই চুড়ি থেকে আন্দাজ করা যায়, ভারত ও চীনের মানুষেরা এখানে আসার আগেই অ্যাঙ্করের অধিবাসীরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উন্নত ছিল। ইন্দোচায়নার লোকেরা তাদের শিল্পকে শুধু সমৃদ্ধ করেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে চুড়ি ঠিক কবে চালু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও আকিক পাথরের চুড়ি পাওয়া গেছে।

সার্ফইন্ডিয়া ডটকমের ‘ট্র্যাডিশন অফ ব্যাঙ্গলস ইন ইন্ডিয়া’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোতে (খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ বছর) পাওয়া এক ব্রোঞ্জের মূর্তিতে দেখা যায়, নৃত্যরত এক বালিকার বাম হাতে চুরি রয়েছে। সম্ভবত তখন দুহাতে চুড়ি পরার প্রচলন ছিল না।

অন্যদিকে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ডিজাইনের চুড়ি পাওয়া গেছে ভারতের তক্ষশীলায়।

আবার রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৭ খ্রি.) আস্থাকবি বাণভট্টের লেখা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উপন্যাস ‘কাদম্বরী’র নায়িকা কাদম্বরীকে কাঁকন পরা হাতে দেবী স্বরস্বতীর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তাই বলা যায় এই অঞ্চলে চুড়ির আবেদন সব সময়ই ছিল। তবে বিবাহিত মেয়েদের প্রতিকী অলঙ্কার ছিল চুড়ি।

সংস্কৃতিম্যাগাজিন ডটকমের ‘হোয়াই ডু উইমেন ওয়্যার ব্যাঙ্গলস’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভারতের বিবাহিত মেয়েদের অন্যতম অলঙ্কার হচ্ছে চুড়ি। এই চুড়ি পরাতেও রয়েছে এলাকাগত ঐতিহ্য।

পাঞ্জাবের মেয়েরা বিয়ের ২১ দিন পর্যন্ত হাতির দাঁতের চুড়ি পরে। তবে কেউ কেউ পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এক বছর ধরেও পরে থাকে এই চুড়ি।

রাজস্থানের মেয়েরা কবজির উপরে পরে হাতির দাঁতের চুড়ি। বাকি হাতজুড়ে থাকে সোনার কাঁকন। স্বামী যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এভাবে পরে থাকতে হয়। যদিও আধুনিক যুগে এই প্রচলন আর নেই।

ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলের মেয়েরা যেখানে সোনার চুড়ি পরছে সেখানে পশ্চিম বাংলার বিবাহিত মেয়েরা সাদা শাখার সঙ্গে পরছে কোরাল লাল রংয়ের চুড়ি।

আবার রঙিন কাচের চুড়ির বিভিন্ন রকম মানে রয়েছে।

লাল চুড়ি– ক্ষমতা। নীল চুড়ি– জ্ঞান। পার্পল চুড়ি– স্বাধীনতা। সবুজ চুড়ি– ভাগ্যবতী/বিবাহিত। হলুদ চুড়ি– সুখী। কমলা চুড়ি– সাফল্য। সাদা চুড়ি– নতুন করে শুরু। কালো চুড়ি– শক্তি। রুপালি চুড়ি– তেজ। সোনালি চুড়ি– ভাগ্য।

চুড়ির আবেদন এখনও আছে। তাই শুধু বিবাহিত মেয়েদের প্রতিকী অলঙ্কার নয়, এখন ফ্যাশনের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে চুড়ি। উৎসব অনুষ্ঠানে শাড়ির সঙ্গে কাচের চুড়ি না পরলে যেন সাজে পূর্ণতা পায় না।

‘চুড়ি রাখবেন, চুড়ি?’ মাথায় করে চুড়ির ঝাঁপি নিয়ে ঘুরতে থাকা চুড়িওয়ালিদের এখন আর দেখা যায় না। এর বদলে দোকানে কাচের সেলফে সোভা পায় কাচের চুড়ি।

এছাড়া বাণিজ্য মেলা, পৌষ মেলাসহ বিভিন্ন উৎসবে রংবেরংয়ের চুড়ি পাওয়া যায়। তবে রাজধানীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় চুড়ির পসরা বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ, ইডেনসহ বিভিন্ন কলেজের সামনে। চলার পথে চোখে পড়ে চুড়ির দোকান।

এসবের নিয়ন্ত্রণকারী অধিকাংশই নারী। ওসব টংয়ের সামনে দিয়ে হাঁটলেই শোনা যায়, “চুড়ি নেবেন আপা? কোন রং লাগবে, এই যে কাঁচাহলুদ, লাল, নীল- সব রং আছে। নীল নেবেন? ঠিক আছে অন্য রং নেন। ভাঙলে বদলাইয়া দিমু।”

চুড়ির টান বা কথার টান কিছুই বোঝা যায় না, তবে তরুণীরা তাদের পাশে গিয়ে বসেন, দরাদরি করেন। কেউ কেনেন, কেউ দেখেন।

এসব টং দোকান ছাড়াও নিউ মাকের্ট, গাউছিয়া, মৌচাক, চাঁদনী চক, দেশীয় পোশাকের বুটিক হাউজগুলোতেও দেশি-বিদেশি চুড়ি পাওয়া যায়। তবে ফুটপাথের চুড়ি বিক্রেতারা সেই চুড়িওয়ালিদের মতোই কমদামে কাচের চুড়ি বিক্রি করেন।

শাহবাগের ফুটপাথে বসা চুড়ি ব্যবসায়ী সেঁজুতি সাহা বলেন, “রেশমি চুড়ি মেয়েরা খুব বেশি পছন্দ করে। এ চুড়ির দামটাও একটু কম।”

তিনি জানান ডজন প্রতি চুড়ি ৩০ থেকে ৫০ টাকা। খাঁজকাটা চুড়ির দাম একটু বেশি, ৪০ থেকে ৫০ বা ৬০ টাকা। কখনও কখনও (চুমকি ও জরির চুড়ি) ৭০, ৯০ থেকে ১০০ টাকা ডজনেও বিক্রি হয়।

চুড়িওয়ালি রমলা ঘোষের কথায়, “চুড়িতে যে খুব বেশি লাভ হয় এমন না। তবে চুড়ি পরিয়ে দেওয়া একটা নেশা, একটা আনন্দ। তবে বিক্রি প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু হয়। সংসারও চলে, আনন্দও আসে।”

আরেক চুড়িবিক্রেতা বিন্তি বলেন, “জায়গার ভাড়া তো লাগে না। তাই মাল কেনা বাদ দিলে সবটাই লাভ। শইল্যের উপরে দিয়া যায়। বৃষ্টি, রইদে একটু কষ্ট এই যা।”

সেবা রানীর কথায়, “কাচের চুড়ির কদর আর আগের মতো নাই। কারণ সিটি গোল্ডের চুড়ি, বিদেশি চুড়ির কারণে মানুষ আর আগের মতো কাচের চুড়ি কেনে না। রেশমি চুড়ির মান মানুষ আর আগের মতন বোঝেও না।”

প্রচলিত রয়েছে ঢাকায় কাচের চুড়ির একসময় খ্যাতি ছিল। এ খ্যাতির জন্য চকবাজারের কাছে ‘চুড়িহাট্টা’ নামের উদ্ভব হয়। চুড়ি বানানোর জন্যই ওই মহল্লার এই নামকরণ হয়েছিল।

সেই চকবাজার ঘুরে জানা গেল, এবারের বৈশাখ উপলক্ষে চুড়ি ব্যবসায়ীরা রেশমি, জয়পুরি, সেট, জোনাকি, কাটিং, গোপি, মিশুরসহ নানান ধরনের চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারের চুড়িবাজার থেকে গতবারের চেয়ে অনেকটাই কম চুড়ি বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন দোকানিরা। তাদের মতে গতবছর রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও এত খারাপ ব্যবসা হয়নি।

“এ বছর বৈশাখের আগের দিনগুলোতে দুপুর থেকে শুরু করে রাত ৮টা পর্যন্ত মোটামুটি বেচা-বিক্রি হয়েছে। অথচ গত কয়েকবছর পহেলা বৈশাখের প্রায় একমাস আগে থেকে বিক্রি শুরু হয়েছিল।” এমনটাই বললেন, সুলতান স্টোরের মালিক আলম গণি বাবু।

তিনি বলেন, “প্রতিদিন দুই লাখ টাকার বেশি পণ্য দোকানে তোলা হলেও সারাদিনে ৮০ হাজার টাকাও বিক্রি হয় না।”

চকবাজারে গ্রুস হিসেবে চুড়ি বিক্রি হয়। এক গ্রুস মানে ১২ ডজন চুড়ি। রেশমি চুড়ির গ্রুস ৩৬০ টাকা। কাঁচের চুড়ির গ্রুস ৪৮০ টাকা। কাটিং রেশমির গ্রুস পাঁচশ’ টাকা। মিশুর চুড়ির গ্রুস দুই হাজার টাকা। কাঠের ঢালাই সেট প্রতি ডজন দুই হাজার চারশ’ টাকা। মাটির চুড়ি ৪৮০ টাকা।

ছবি: নয়ন কুমার/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম