ঢাকাইয়া স্বাদ

পুরান ঢাকার সব জনপ্রিয় খাবার চোখের সামনে। ডানে হাজি, বামে নান্না। হাত বাড়ালেই বিউটির শরবত। স্বপ্ন নয়, এ সত্যি। কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাঠে পুরান ঢাকার মুখরোচক খাবারের মেলা বসেছে।   

শরীফ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2014, 11:25 AM
Updated : 12 April 2014, 03:22 PM

খাবারের পাশাপাশি পুরান ঢাকার যানজটও যেন চলে এসেছে ধানমণ্ডির রাস্তায়। ‘টেস্ট অফ ঢাকা ২০১৪’ নামের এই মেলায় যেতে হলে টপকাতে হবে বিশাল জ্যাম।

২০০৮ ও ২০১০ সালের পর তৃতীয়বারের মতো ‘ঢাকা মহানগর সমিতি’ ও ‘স্পেলবাউন্ড কমিউনিকেশন লিমিটেড’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হচ্ছে এই মেলা।

গন্ধেই যে অর্ধভোজন। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পুরান ঢাকার পরিচিত মসলার ঘ্রাণ। একটু খোঁজ করতেই আয়োজক স্পেলবাউন্ডের মিডিয়া ম্যানেজার নিরঞ্জন বৈদ্যের দেখা মিলল।

তিনি বললেন, “১১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই মেলা চলবে পহেলা বৈশাখের রাত পর্যন্ত।”

মাঠ জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় ৫২টি স্টল। যেখানে রসনাবিলাসীদের জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছেন– হাজীর বিরিয়ানি, নান্নার মোরগ পোলাও, শমসেরের ভুনা খিচুরি, বিউটির লাচ্ছি, মাস্টার শেফ সুবরাত আলী, রয়েল রেস্টুরেন্ট, বশির কাবাবসহ আয়োজকদের সহযোগী HUNGRYNAKI’র মতো প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান।

জিভে জলআনা স্বাদের জন্য বিখ্যাত এইসব নামের পাশাপাশি খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ঘুড়িয়া শরবত’-এর স্টল।

ব্যবসায়িক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, তারপরও উৎসব-পার্বণে নিজেদের সামিল করেন এই শরবতের তিন মালকিন সাঈদা বেগম, সাজেদা হাশেম ও রেইনা ইমরোজ। তিন বোনেরই জন্ম গেন্ডারিয়ায়। শৈশব থেকেই পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রসনার সঙ্গে পরিচিতি। তাই তো নতুন ঢাকাবাসীর সামনে পুরান স্বাদ নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতেই তাদের এই অংশগ্রহণ।

পুদিনা পাতা কিংবা কাঁচাআমের মতো ৬-৭ রকমের শরবত পাওয়া যাচ্ছে তাদের এই স্টলে।

নামের মতোই ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া যাবে, মাস্টার শেফ সুবরাত আলীর স্টলেও। ঢাকা শহরে কোনো রেস্টুরেন্ট নেই তাদের। তবে নিয়মিত ক্যাটারিং সার্ভিস দিয়ে থাকেন তারা। এমনটাই জানালেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও বিএম জাহিদ হোসেন মারুফ। যে সুবরাত আলীর রন্ধনশৈলীর জন্য রাজনীতিবিদদের দোরগোড়া থেকে ব্যবসায়ী মহলেও সুনাম কামিয়েছেন, তার নামেই প্রতিষ্ঠানটি।

আগে ‘সুবরাত আলী’ নামে পরিচিত হলেও, ২০১২ সালে তার মৃত্যুর পর, প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মাস্টার শেফ জুড়ে দেওয়া হয়। তবে হালের স্টার ওয়ার্ল্ডের কোনো পুরস্কার নয়, ২০০১ সালে সুবরাত আলী এই খ্যাতি পেয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছ থেকে। স্টলের বিরিয়ানি, ফিরনি কিংবা স্পেশাল শরবতের স্বাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে সেই ঐতিহ্য।

পুরান ঢাকার কুলফি বরফ। ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ।

চলছে সমীরের কাওয়ালি। ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ।

মাঠে এক প্রান্তে শামিয়ানা টাঙিয়ে বানানো হয়েছে, বিশাল এক মঞ্চ। শুক্রবার উদ্বোধনী দিনে সেই মঞ্চ কাঁপাচ্ছিলেন কাওয়ালি গায়ক ‘সমীর কাওয়াল’। তবে সেটা যাদের হাত ফসকে গেল তাদের জন্য বাকি দিনগুলোতে প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে।

শনিবার গানে গানে পুরান ঢাকাকে স্মরণ করবেন শিল্পীরা। রোববার গান শোনাবেন হায়দার হোসেন। আর বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন মঞ্চ মাতাবে ব্যান্ড ‘ওল্ড স্কুল’।

শুধু এই না, সঙ্গে থাকা শিশুদের আনন্দ দিতে রয়েছে নাগরদোলা। তবে হারানো শৈশব ফিরে পেতেই বোধহয়, বড়দেরই নাগরদোলায় সিটে বেশি দেখা গেল।

“মাঠ-ভর্তি মানুষ এটা-ওটা খাচ্ছে আর গুলতানি মারছে। ঠাস বুনোটের ভিড়ে, ঢাকায় এমন আয়োজন সত্যিকারেই অভাবনীয় এক ব্যাপার।” নিজের এমন অভিজ্ঞতা এভাবেই ব্যক্ত করলেন রেইনালদো লুইরেইরো।

স্পেন থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে উড়ে এসেছেন তিনি ভাষা শিখাতে। কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটে।

কাজের চাপ আর যানজটের কারণে, কখনও পুরান ঢাকার মসলার ঝাঁজ নিতে যেতে পারেননি। তবে এখানে এসে অভিভূত এই স্প্যানিশ দম্পতি। বললেন, “ঢাকাকে সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরতে এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।”

এরপর টেবিলে ছড়িয়ে রাখা পিঠা আর কাবাবের দিকে মনযোগ দিতে দিতে, পরিব্রাজক ভাস্কো-দা-গামার মতোই জানালেন, নিজেরা তো আবার আসবেনই, পারলে বন্ধু-বান্ধবদেরও টেনে আনবেন বাকি দিনগুলোতে।

ব্যস্ত রাজধানীর বুকে ঢাকাবাসীকে পুরান ঢাকার বৈশাখি আমেজ দিতে, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা খোলা থাকবে এই আয়োজন। চলবে নববর্ষের রাত পর্যন্ত।