১৬১০ সালে ঢাকায় মোগলদের পা পড়ে। তবে বহু বছর পরেও গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম পালন সেভাবে বলতে গেলে ব্যাপক ছিল না।
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ যেমনটা লিখেছিলেন, “কোরবানি ঈদের সময় লক্ষ্যা নদীর তীরে স্থানীয় গ্রামবাসী মিলিত হয়েছিলেন নামাজ পড়ার জন্য। তবে সেটা কীভাবে করবেন তা তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আসলে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সর্ম্পকে তাদের অজ্ঞতাই এর জন্য দায়ী। অবশেষে নদীতে নৌকায় করে ঢাকার এক যুবক যাচ্ছিল; তাকে দিয়ে ঈদের জামাত পড়ানো হল।”
ব্যতিক্রমও ছিল
তবে এই অবস্থাতেও আমরা দেখতে পাই কিশোরগঞ্জে ১৮২৮ সাল থেকে শুরু হয় আজকের বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ার চল। এই ঈদগাহের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
আবার অনেকের মতে সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়েছিল। ফলে ‘সোয়া লাখ’ থেকে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানকার পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল ‘সোয়া লাখ টাকা’। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে ‘সোয়ালাখিয়া’ সেখান থেকে ‘শোলাকিয়া’। পরে ১৯৫০ সালে স্থানীয় এক ধন্য ব্যক্তি দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ এই ময়দানকে অতিরিক্ত ৪.৩৫ একর জমি দান করেন। বর্তমান শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন ৭ একর। নরসুন্দা নদীর তীরে শোলাকিয়ার অবস্থান।
পড়েছ মোগলের হাতে
সে যাই হোক, ফিরে যাই ১৬১০ সালে। বাংলার প্রশাসক সুবাদার ইসলাম খান যখন নিজে পা রাখলেন ঢাকায় তখন তাঁর সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনী মিলিয়ে আনুমানিক ৫০ হাজার লোকজন। শুধু যে মোগলরাই এসেছিলেন তা নয়; তাদের খেদমতের জন্য এসেছিল বিশাল সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী এবং তাদের পরিবার পরিজন। ফলে সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়; হঠাৎ করে কীভাবে ঢাকা কোলাহলমুখর এক ব্যস্ত ‘রাজধানী’ হয়ে উঠেছিল।
মোগল ঢাকার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ‘ঢাকা কেল্লা’র (বর্তমানে পুরান ঢাকার বন্ধ হয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় কারাগার) চারপাশে গড়ে উঠেছিল ঢাকায় আগত পেশাজীবীদের আবাসস্থল। সে সময়কার ঢাকা বলতে বোঝানো হত আজকের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাঝামাঝি থেকে পাটুয়াটুলী বা সদরঘাটের আশপাশের অংশটুকু।
মোগলরা ঢাকায় আসায় উৎসব হিসেবে ‘ঈদ’ পালন করা হতে থাকে। শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে ‘ঈদ’ উৎসবে রূপ নেয়। মোগলদের ঈদ উদযাপন হত দু-তিন দিন ধরে। চলতো সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন। আত্মীয়স্বজন পরিবার পরিজন নিয়ে একরকম মেলাই বসে যেত।
অনুমান করে নেওয়া হয় বাদশাহী বাজারে (বর্তমান চকবাজার) এই মেলা আয়োজিত হত। বিশেষ করে তখনকার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকা কেল্লার (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার) আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট।
তখনকার ঈদ উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায় সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে। যদিও তিনি সে সময়ে বোকাইনগরে ছিলেন। তার বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় তখনকার ঢাকাতেও মোগলরা একইভাবে ঈদ উদযাপনের আয়োজন করতেন।
সন্ধ্যায় যখন মোমবাতির আলোয় আলোকিত হত মোগল আমলের ঢাকা শহর, তখনও শেষ রোজার সন্ধ্যাকাশে উঠত ঈদের চাঁদ। শিবিরে বেজে উঠত শাহী তূর্য (রণশিঙ্গা) এবং গোলন্দাজ বাহিনী গুলির মতো একের পর এক ছুঁড়তে থাকত আতশবাজি।
সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত এই আতশবাজির খেলা। শেষরাতের দিকে বড় কামান দাগা হত। সে সময় ঢাকাবাসী বাদশাহী বাজার (বর্তমানে চকবাজার) থেকে ঈদের কেনাকাটা সারতেন।
ইসলাম খাঁর (ঢাকায় তার অবস্থানকাল ১৬১০-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) পর প্রায় ২৫ বছরের মধ্যে ঢাকার প্রসার ও বিকাশ ঘটে অতি দ্রুততার সঙ্গে। মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ সুজাকে সুবে বাংলার শাসক করে পাঠান ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে।
এসব উৎসবে ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতি থাকত না বললেই চলে।
ঢাকা এলেও শাহজাদা শাহ সুজা বিভিন্ন কারণে ঢাকা শহরটি পছন্দ করলেন না। তিনি কিছুদিনে (১৬৩৯-১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দ) জন্য রাজধানী পরিবর্তন করে ঢাকা থেকে নিয়ে যান রাজমহলে। তাই বলে ঢাকা একেবারে মোগল প্রতিনিধি শূন্য হয়ে থাকেনি। আর মোগল স্থাপত্য নির্মাণও বন্ধ হয়ে যায়নি।
এ সময়ের উল্লেখযোগ্য দুই মোগল স্থাপনার কথা বলা যেতে পারে। একটি হল বড় কাটরা। অন্যটি হল ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের ঈদগাহ। এই দুটিই শাহ সুজার নির্দেশে নির্মাণ করেছিলেন মীর আবুল কাশেম।
পোড়ামাটির ইটে তৈরি এ ঈদগাহটি তৈরি হয়েছিল ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে। তখন থেকে ঢাকায় অভিজাত শ্রেণির মুসলমানরা এই ঈদগাহে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তেন। তবে সাধারণ নগরবাসীর এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ ছিল না।
আনন্দ উৎসব
কখনও শাসকরা নতুন কোনো রাজ্য জয় করলে ঈদ উদযাপনের সঙ্গে যুক্ত হত বাড়তি আনন্দ।
দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁর সময় (১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে) জয় করা হয়েছিল ত্রিপুরা। নবাব সুজা উদ্দিনের নির্দেশে ঢাকা কেল্লা থেকে ঈদগাহ যাওয়ার রাস্তায় ১ হাজার টাকা মুদ্রা বসিয়ে দুই মাইলজুড়ে সাজানো হয়েছিল।
এভাবে চলতে থাকলেও ঢাকার উপর মূল ধাক্কা এসে লাগে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে।
মোগল সম্রাটের কাছ থেকে ইংরেজরা বাংলার-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের ভার পায়। ঢাকার নায়েব-নাযিমরা পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে। পড়তি ঢাকার জৌলুস ধরার চেষ্টা করা হত ঈদ ও মহরমের মিছিলের মাধ্যমে। এই মিছিলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নায়েব-নাযিমরা। শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার দরুণ নায়েব-নাযিমরা ঈদের পাশাপাশি মহরমেরও মিছিল বের করতেন। নাযিমরা নিজেদের শৌর্য দেখানোর জন্য এ মিছিলগুলোর ছবি এঁকে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন।
উনিশ শতকের প্রথমদিকে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদ ও মহরমের মিছিলের ছবি এঁকেছিলেন। মোট ৩৯টি ছবি আঁকেন তিনি। চিত্রগুলোতে দেখা যায় ঈদের মিছিলগুলো নায়েব-নাযিমদের নিমতলী প্রাসাদ (বর্তমানে নিমতলী এলাকা), চকবাজার, হোসনি দালান প্রভৃতি স্থাপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। মিছিলে থাকত সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি, অস্ত্র হাতে সৈন্যদল।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও হাতে থাকত রং-বেরংয়ের ছাতা অথবা বাদ্যযন্ত্র। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে নায়েব-নাযিমরা থাকতেন একেবারে সামনের দিকে। দর্শক হিসেবে থাকতেন অভিজাত শ্রেণির লোকজন।
এ দেশীয়রা তো থাকতেনই সেই সঙ্গে থাকতেন ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপীয়রা। হাকিম হাবিবুর রহমান, প্রখ্যাত নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, আশরাফ-উজ-জামানদের স্মৃতিকথায় গত শতকের বিশ-ত্রিশ দশকেও ঢাকায় যে ঈদের মিছিল বের হত তার বিবরণ পাওয়া যায়।
রসনায় আনন্দ
সে শতাব্দীতেই চল্লিশ দশকের দাঙ্গায় এবং অন্যান্য কারণে ঈদের মিছিল বন্ধ হয়ে যায়। উনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করে। এতে মোগল সম্রাজ্যের অংশীদার পরিবারগুলোর পাশাপাশি মুসলমানদের আরেকটি শ্রেণির উত্থান হয়।
তারা ঢাকার আদিবাসী ছিলেন না। শিক্ষাদীক্ষা, চাকরির অন্বেষণে এরা ঢাকায় এসে স্থায়ী হতে থাকেন।
এই সব নতুন ঢাকাবাসীরা বেশিরভাগই মুসলমান ছিলেন আর পল্লি অঞ্চল থেকে আসতেন।
এদের ঢাকায় আসার ফলে রাজধানীর ঈদ উৎসবে নতুন কিছু সংযোজন হয়েছিল। যেমন বিভিন্ন ধরনের পিঠা, সেমাই ও ঈদের দিনে মেলার আয়োজন।
শুধু তাই নয়, তাদের উপস্থিতি ঢাকার ঈদের মেলায় সংযোজন করে গ্রামীণ সংস্কৃতি। ফলে মেলা ঢাকার চকবাজারেই সীমাবদ্ধ রইল না, ছড়িয়ে পড়ল শহরের আশপাশেও। সেটার সত্যতা পাওয়া যায় মুন্সী রহমান আলী তায়েশের স্মৃতিকথা থেকে। তিনি তাঁর ‘তাওরারিখে ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন— “উনিশ শতকের শেষের দিকে ঢাকার মুসলমানরা (তখন সম্ভবত প্রায় সব শ্রেণির মুসলমান একসঙ্গেই যোগ দিতেন) ধানমন্ডির মোগল ঈদগাহে যেতেন ঈদের নামাজ পড়তে। যদিও সে ঈদগাহ তখন অযত্ন অবহেলায় জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ।”
তারপরেও তায়েশের বর্ণনার উল্লেখযোগ্য অংশটি হচ্ছে, “ঈদ উপলক্ষে এখানে মেলা হত, সেখানে যোগ দিতেন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার লোকজন।”
পান্ডুনদীর কাছেই মেলা হওয়ায় নানারকম ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে আশপাশের গ্রামের বিক্রেতারা হাজির হতেন এই মেলায়। বলা যায় এক ধরনের গ্রামীন ও নাগরিক জীবনের মেলবন্ধনেরও সৃষ্টি হত। ধারণা করে নেওয়া যায়, এই মেলার ধারাবাহিকতায় ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে ঈদ উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হতে থাকে।
এ তো গেল ঢাকাবাসীর ঈদ উদযাপনের খণ্ডিত চিত্র। অপরদিকে ঢাকার আদি অভিজাত শ্রেণি যারা নিজেদের মধ্যে মোগল ঐতিহ্য বেশ করে চর্চা করতেন তাদের ঈদ উদযাপনটা ছিল খানিকটা ভিন্ন।
উনিশ শতকের আশির দশকের শেষ দিকে সেলাই মেশিনের ব্যবহার শুরু হলেও তাঁরা (যারা মোগল ঐতিহ্য বহন করতেন) হাতে সেলাইয়ের কাপড় পরতেন। ঈদ উৎসবে তাদের ঘরে পরিবেশিত হত তোরাবন্দি খাবার। সর্বমোট চল্লিশ রকমের খাবার থাকত এই তোরাবন্দিতে। অর্থনৈতিক কারণে এ তোরাবন্দি খাবার কালক্রমে ‘নিম তোরাবন্দি’ বা ‘অর্ধেক তোরাবন্দি’তে পরিণত হয়ে গত শতাব্দীর বিশ দশকের দিকে এসে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ঢাকার নবাব বাড়িতেও ঈদে বিভিন্ন ধারায় আনন্দের ব্যবস্থা ছিল। খানাপিনা হত জাঁকজমকের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলায় অন্দরমহলে নাচ-গানের আসর জমাত হিজড়ার দল। আলো দিয়ে সাজানো হত আহসান মঞ্জিল।
গত শতকের ত্রিশ দশক থেকে ধীরে ধীরে ঢাকাবাসীর ঈদ উদযাপনে পরিবর্তন ঘটে। ততদিনে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। টকি সিনেমা এসেছে। এসেছে রেডিও। ধানমণ্ডির ময়দানে হয়েছে অ্যারোপ্লেন নামার জন্য ‘এরোফিল্ড’। ঈদ উপলক্ষ গ্রাম থেকে বেড়াতে এসে দর্শনার্থীরা যেতেন ঢাকার কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে। এসবের মধ্যে ছিল সদরঘাটের কালু খাঁ কামান, হোসনি দালান, ফরাশগঞ্জের লোহারপুল, হাতিরপুল, রমনার রেসকোর্স, লালবাগের কেল্লা, বড় কাটরা, ছোট কাটরা।
[তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের লাইফস্টাইল বিভাগে প্রকাশিত তরুণ ঢাকা গবেষক রিদওয়ান আক্রামের ‘বাংলার ঈদ’, ‘ঢাকায় কোরবানির ঈদ’ ও ‘ঈদ যুগে যুগে’ প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত।]