বাবার জন্য ভালোবাসা

সন্তানকে বড় করতে বাবা-মায়ের থাকে অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ। তবে বড় হওয়ার পর সন্তান কি আসলেই বাবার সেই আদর-ভালোবাসার ঠিকঠাক প্রতিদান দিতে পারে বা দেয়!

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2017, 03:32 AM
Updated : 18 June 2017, 08:12 AM

বড় হওয়ার পর নিজেকে নিয়ে বা সংসারের ব্যস্ততায় কি বাবাকে ঠিক মতো সময় দিতে পারছেন? সেই ছোটবেলায় বাবা আপনাকে যেভাবে আগলে রাখতো, সেভাবে?

বাবা দিবসকে সামনে রেখে সন্তান ও বাবার সম্পর্ক কেমন এবং বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কর্তব্য আসলেই কি সন্তানরা যথার্থভাবে পালন করে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্তব্য আসে, ‘বাবা যতটা আদর ভালোবাসা দিয়ে সন্তানকে বড় করে তুলেছে তার প্রতিদান হয়ত সন্তানরা ঠিক মতো দিতে পারেন না।’

এই সম্পর্কে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সাবরিনা ববি বলেন, “বাবা ছোট থেকে অনেক আদর যত্নে বড় করে। কিন্তু আমরা বড় হওয়ার পরে আসলে বাবার প্রতি ঠিকঠাক ভালোবাসা প্রকাশ করি না। আর বিয়ের পরে আমরা বাবার খোঁজ খবরও ঠিক মতো রাখি না। তখন নিজের সংসার, স্বামী বা শ্বশুর-বাড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকি।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের উচিত বাবার খোঁজ খবর রাখা, তার ভালোলাগা খারাপ লাগার মূল্যায়ন করা। বাবারা আমাদের কাছ থেকে তেমন কিছু চায় না আমরা তার খোঁজ রাখলে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলেই দেখা যায় দেখা যায় তিনি খুব খুশি থাকে। কিন্তু আমরা এটুকুও ঠিক মতো করি না।”

বাবা মা থাকতে তাদের প্রতি কর্তব্য করা উচিত এমনটাই মনে করেন জাকিয়া আজিজ। তিনি একজন গৃহিণী। বাবাকে হারিয়েছে। তিনি নিজে এখন এক সন্তানের মা।

তার কথায়, “বাবা থাকতে কখনও তার প্রতি ঠিকঠাক ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি নাই। মা হওয়ার পর এখন বুঝি সন্তান আসলে বাবা-মায়ের কাছে কতটুকু। ছোট থেকে খুব আদরে মানুষ করেছে, বিয়ের পর বাবা থাকতে আগে প্রতিদিন একবার করে ফোন দিত, খোঁজ খবর নিত। তবে দেখা যেত নানা ব্যস্ততার জন্য ঠিক মতো কথাও বলতে পারতাম না। অনেক সময় তাড়াহুড়া করেই ফোন রেখে দিতাম। বাবা কখনও কিছু বলত না। এখন সেসব ভেবে খুব খারাপ লাগে।”

“ছোট থেকে বাবা যে আদর্শ আর ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে আমি বড় হওয়ার পরে তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি, এখন মনে হয় কেনো বাবাকে আরও ভালোবাসা দিতে পারলাম না। এখন চাইলেও আর বাবাকে দেখতে পারিনা, তার কথা শুনতে পারিনা। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।” বললেন তিনি।

বাবা দিবসে বাবার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনে ও ভালোবাসা প্রকাশে কতটা সফল জানতে চাইলে যশোরের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট, নওশাদ খান বলেন, “আমার জীবনের সফলতার পেছনে বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি। তার প্রচেষ্টায় আমি আজ এখানে। আমি সবসময়ই বাবার ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করি। তার ভালো বা খারাপ লাগার প্রতি মনোযোগ দেই। বাবা মায়ের ঋণ কখনও পূরণ করা যায় না। তবে সন্তান হিসেবে আমাদের উচিত বাবা মায়ের ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া। তাহলে অন্তত বাবা মায়ের প্রতি কিছুটা কর্তব্য পালন করা হবে।।

তিনি আরও বলেন, “আমি 'বৃদ্ধাশ্রম' বিষয়টাকে একেবারেই সমর্থন করি না। অনেকেই বাবা-মা বয়স্ক হলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। এটা একদমই উচিত না। বাবা মা কতটা যত্ন করে একটা সন্তানকে বড় করে তোলে তা আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত।”

বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক আতিয়া পারভিন বলেন, “বাবা মা চাওয়া মাত্রই সন্তানের আবদার পূরণ করে এবং সন্তান এতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে সন্তানরা বাবা মায়ের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করে না। এতে বাড়তে থাকে দূরত্ব।”

“তাছাড়া এখনকার ভালোবাসা অনেকেটাই প্রযুক্তি ভিত্তিক হয়ে গেছে। সন্তান বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকলে ফোন বা স্কাইপ হচ্ছে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। একই শহরে এমনকি একই এলাকায় থাকার পরও সন্তান অনেক সময় বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না এসে কেবল ফোনের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে। এটা বাবা মায়ের জন্য খুবই কষ্টের। বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষ অনেকটাই শিশুর মতো হয়ে যায়। তখন তাদের আদর ভালোবাসার বেশি প্রয়োজন হয়। তবে অধিকাংশ সন্তানরাই তা বোঝার চেষ্টা করে না। তাদের কাছে বৃদ্ধ বাবা মা অর্থ 'বোঝা'।” মন্তব্য করলেন এই অধ্যাপক।

তিনি আরও বলেন, “ভালোবাসার কোনো দিবস নেই, প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হয়, প্রকাশ ঘটাতে হয়। বাবা মায়ের উচিত সন্তাকে বোঝানো- আমি তোমার জন্য এসব কষ্ট করছি তোমারও আমার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য আছে। সন্তান চাওয়া মাত্রই তার আবদার পূরণ না করে তাকে বোঝানো উচিত যে, চাহিদা পূরণ করার জন্য বাবা মাকে কতটা কষ্ট করতে হয়।”

“ছোট থেকেই যদি সন্তান বাবা মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে তাহলে বড় হয়ে তারা বাবা মায়ের কষ্টের মর্যাদা দেবে। তাছাড়া পারিবারিক বন্ধন সন্তানের ভবিষ্যত জীবনে প্রভাব রাখে। ছোট থেকেই সন্তানকে পরিবারের বন্ধন সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে তাহলে সে বড় হওয়ার পরে বাবা-মায়ের প্রতি নিজ দায়িত্ব পালন করবে।”

তিনি পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, “আমরা বাবা মায়েরাই সন্তানকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারি না বলে বর্তমানে 'বৃদ্ধা শ্রম'য়ের প্রচলন বেড়েছে। ছোট থেকে সন্তানকে নিজেদের কষ্ট ও ত্যাগ সম্পর্কে জানাতে হবে। একটু বড় হলে তাদের সঙ্গে নিজে ছোটবেলা ও তার ছোট বেলার গল্প করতে হবে। তাহলে সে বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।”

নিজের প্রয়োজন বাদ দিয়ে বাবা সন্তানের চাহিদা পূরণ করেন। সন্তানের কোনো কষ্ট যেন না হয় এজন্য বাবাকে ত্যাগ করতে হয় অনেক কিছুই। তবে এসবই বিফলে যাবে যদি সন্তান মানুষ না হয়। তাই সন্তানের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাকে মানুষ করার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে বলে করেন আতিয়া পারভিন।

‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে’- তাই ছোট থাকতেই সন্তানকে বাবা=মায়ের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা না করতে শেখাতে হবে। আর বড় হয়ে যতই নিজেকে বা সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করুন না কেনো বাবাকে সময় দিতে ভুলবেন না যেন।

ছবি: রয়টার্স।