আপনার জন্য মজা, তার জন্য উৎপাত

রাস্তায় দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনো নারীর প্রতি মজা করতে গিয়ে মন্তব্য ছুঁড়ছেন! একবারও কি ভেবে দেখেছেন সেটা আপনার জন্য আনন্দের হলে নারীটির জন্য বিব্রতকর।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2017, 10:26 AM
Updated : 14 June 2017, 10:48 AM

বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, ‘ছেলেদের জন্য খেলা, ব্যাঙের জন্য মরণ’। ছেলেরা হয়ত খেলাচ্ছলে ব্যাঙের গায়ে ঢিল মারে। তবে এই ঢিল প্রাণনাশের কারণ হয় ব্যাঙ'য়ের।

দৃশ্যপট ১: ঢাকার অদূরে একটি কারখানার কলোনি। জায়গায় জায়গায় কারখানার বর্জ্য রাখা, সংকীর্ণ চলাচলের পথ, রাতের বেলা জমাট বেঁধে থাকে অন্ধকার। এলাকাটি মেয়েদের জন্য খুব অনিরাপদ। অন্ধকারের সুযোগে যে কেউ ওদের গায়ে অযাচিত স্পর্শ করে। জায়গায় জায়গায় ছেলেরা জটলা বেঁধে আড্ডা দেয়। পাশ দিয়ে মেয়েরা হেঁটে গেলে তাদের শুনতে হয় নোংরা মন্তব্য।

প্রতিবাদ করার উপায় নেই, এতে হীতে বিপরীত হয়। তুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়, ধর্ষণ করে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। মেয়েরাও জানে এগুলো শুধু হুমকি না। চাইলেই ছেলেরা এগুলো করতে পারে। তাই ওরা কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ উক্তি শুনেও মুখ বুজে থাকে।

দৃশ্যপট ২: দীপা (ছদ্মনাম) এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রধান পরীক্ষা শেষ, চলছে ব্যবহারিক পরীক্ষা। একদিন মেয়েদের সঙ্গে ল্যাবে অন্য কলেজের ছেলেদেরও পরীক্ষা নেওয়া হয়। তখনই শুরু হয় তাণ্ডব। ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে অনেকটা খেলাচ্ছলে সরঞ্জামাদি টানাটানি শুরু করে, কেউ কেউ মেয়েদের খাতাও টানতে থাকে। কর্তব্যরত শিক্ষকরা দেখেও না দেখার ভান করেন। কিছু মেয়ে শিক্ষকের নীরব ভূমিকার প্রতিবাদ করলে তারা বলেন, জানোই তো ছেলেরা দুষ্ট তোমরা অন্যদিকে গিয়ে কাজ করো।

দীপা বাড়ি ফিরে সেই ক্ষোভের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। ছেলেরা এসে উল্টো মেয়েদের গালাগাল শুরু করে। একটি ছেলে মন্তব্য করে ‘এগুলিরে রেপ করে আসা দরকার ছিল।’

দৃশ্যপট ৩: রুবা (ছদ্মনাম) একটি অফিসে শিক্ষানবিশ। একদিন অফিসের একটি অনুষ্ঠানে পেছন থেকে কে যেন তাকে জড়িয়ে ধরে। রুবা বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে ঘুরে দেখে প্রায় অবসরে চলে যাওয়ার বয়সি একজন সহকর্মী। রুবা এই ঘটনা কাউকে জানাতে বা বলতে ভয় পায়। কে বিশ্বাস করবে ওর কথা! যদি ওর ইন্টার্নশিপ বাতিল হয়ে যায়! যদি উল্টা ওর নামে সবাই খারাপ বলে!

উপরের ঘটনাগুলো সত্য। তবে বদলে দেওয়া হয়েছে নামগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগের শিক্ষক আবু সালেহ মোহাম্মদ সোয়াদ, কাজ করেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষদের ভূমিকাগুলো নিয়ে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, কেনো ছেলেরা নারীদের প্রতি এরকম অসহনশীল আচরণ করেন।

“প্রথমত পুরুষেরা যৌন বৈশিষ্ট্য বা অন্য লিঙ্গের প্রতি সহনশীল আচরণ শেখার সুযোগ পায় না। আমাদের সমাজে এসব নিয়ে আলোচনা করা ‘ট্যাবু’- ধর্ম বা লোকাচারে চর্চা করা হয় না। তবে এ বিষয়গুলোর উপস্থিতিকে অস্বীকার করা সম্ভব না। ফলে শিক্ষাটা আসে বন্ধু, বড় ভাই বা এমন কারও কাছ থেকে যাদের নিজেদের কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার না। এই বিপুল কৌতূহল ছেলেরা মেটায় পর্নোগ্রাফির মধ্য দিয়ে। ফলে ছেলেরা একজন নারীর স্বাভাবিক জীবন বা মানুষ হিসেবে তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, দেহটাই তার কাছে প্রধান হয়ে যায়। তাদের কাছে মেয়ে, নারী, মহিলা এগুলোর মানে-  যাকে ভোগ করা যায়, যার অধিকার নেওয়া যায়।”

“এখানে গণমাধ্যমের প্রভাবও কম নয়, প্রচলিত গণমাধ্যমের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে দেখানো হয়।” যোগ করেন সোয়াদ।

“পরিবারে, এলাকায় এমনকি স্কুলগুলোতে পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে ছেলেদের প্রতি যত উদার থাকা হয় মেয়েদের প্রতি সেভাবে থাকা হয় না। ফলে মেয়েরা বড় হয় একটা ‘অপ্রধান’ মানুষের পরিচয়ে। অপরদিকে ছেলেরা বড় হয়, আমি ছেলে তাই আমি ‘অদ্বিতীয়’ মনোভাব নিয়ে।”

“তারপরেও যখন একজন নারী কোনোভাবে নিপীড়িত হয়, আমাদের সমাজে সাধারণ প্রথা হচ্ছে তাকে একঘরে করে দেওয়া। সবাই নির্যাতিতের দোষ খোঁজে আর লোকে দোষ দেবে এই ভয়ে মেয়েরাও চূড়ান্ত কোনো সমস্যা না হওয়া পর্যন্ত মুখ খোলে না। ফলাফল দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে ছেলেরা বুক ফুলিয়ে এসে মেয়েদের বাজে কথা বলে যাচ্ছে। আর তৃতীয় প্রেক্ষাপটে মেয়েটির নীরবতার সুযোগে একজন অপরাধী দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছে।” ব্যাখ্যা করলেন সোয়াদের।

সোয়াদের মতে, “যেহেতু নারীরা আগে থেকেই অপ্রধান মানুষ। তাই তাদের দমিয়ে সহজেই রাখা হয়। মেয়ে নির্যাতনের স্বীকার হলে পরিবার তাকে ওই পরিবেশ থেকে সরাসরি ‘প্রত্যাহার’ করে ফেলে। পরে ঝামেলা আরও বাড়বে এই ভয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা হয়, বাড়ি বদল করা হয়। তবে যেটাই করা হোক তা মানুষ হিসেবে একজন নারীকে বেড়ে ওঠায় বাধা দেয়।”

২০০৩ সালে করা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আইসিডিডিআরবি’র একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শতকরা ৪৪.২ ভাগ বাল্য বিবাহের কারণ কন্যা সন্তান আছে এমন পরিবারগুলো যৌন হয়রানি ভয় পায় এবং বিয়ে দিয়ে তারা মেয়েকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে।

সোয়াদ বলেন, “বিয়ে দিয়ে যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টাটি সবসময় কাজে আসে না। অনেকসময়ই মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও ঝামেলায় পড়ে। এসব ক্ষেত্রেও দোষ গিয়ে মেয়ে এবং তাদের পরিবারের উপর পড়ে। বলতে পারেন, জন্মই তাদের আজন্ম পাপের মতো কিছু না করেও সব কিছুর দায় নারীদের বয়ে বেড়াতে হয়।”

‘প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল’ নামের উন্নয়ন সংস্থা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’য়ের সহযোগিতায় সম্প্রতি ঢাকার শ্যামপুর ও বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় নারীদের নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা সমাপ্ত করেছে। তারা সেই গবেষণাকে ‘সেফটি অডিট’ হিসেবে অভিহিত করেন।

সোয়াদ জানান, এটি গবেষণা হচ্ছে একটি উপায় যা দিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব কেনো নির্দিষ্ট কোনো এলাকা নারীদের জন্য অনিরাপদ।

সে গবেষণায় অংশ নেওয়া একজন কিশোরী জানায়, “এমন না যে আমরা সারাক্ষণই হয়রানীর সম্মুখীন হই। তবে চাপা একটি আতংক আমাদের সর্বক্ষণ তাড়া করে যেটা থেকে আমাদের মুক্তি নেই।”

তাহমিনা হক, কাজ করেন ‘প্ল্যান বাংলাদেশ’য়ের ‘জেন্ডার অ্যাডভাইজর’ হিসেবে।

তিনি বলেন, “আমাদের গবেষণার এলাকায় নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাতে এলাকায় কোনো আলো থাকে না। কোথাও হয়তো পানি জমে থাকে, শিল্প এলাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে সহজেই কাউকে লুকিয়ে ফেলা যায় এই সামান্য কারণগুলো নিরাপত্তার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।”

তিনি আরও জানান, “যৌন নিপীড়নের যেমন ভিন্ন ভিন্ন উপায় এবং ক্ষেত্র রয়েছে তেমনি আমাদের দেশের যৌন নিপীড়নের আইনও দেশে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন প্রথম প্রেক্ষাপটে যদি নারীটিকে শুধু মৌখিকভাবেই উত্যক্ত করা হয় সেটা পিনাল কোড ৫০৯ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রমে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়ই। আবার স্পর্শ করলে অপরাধটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী তিন থেকে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা পেতে পারেন।”

তাহমিনা হক।

এই দুই আইনের বাইরেও ২০০৯ সালে নারীর প্রতি নিপীড়ন রোধে হাইকোর্টের একটি পূর্ণাঙ্গ রায় আছে যা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন বলে গণ্য হওয়ার কথা। তাতে বলা আছে, কোনো পরিস্থিতিতে নারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা যাবে না এবং যদি করা হয় তার সাজা কেমন হবে। এ ছাড়াও তথ্য ও প্রযুক্তি আইনেও কিছু ধারায় নারীদের বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ আছে।

“আইনগুলো অনেক প্যাঁচানো, এখানে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পরে শাস্তির বিধান আছে কিন্তু হুমকি দেওয়া হলে সেটা আইনের আওতায় আসছে না। অথচ নারীরা এবং তাদের পরিবার সর্বক্ষণ সেই হুমকির কাটা মাথায় নিয়ে চলে। এর ফলাফল বাল্য বিবাহের মতো ভয়াবহ রূপে ভিকটিমকে ভোগ করতে হয় সারা জীবন।”

বাংলাদের পুলিশের ক্রাইম কনফারেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৮০৩টি ধর্ষণ, ৮টি অ্যাসিড নিক্ষেপ, ২৫৭৬টি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে।

তাহমিনা বলেন, “নারীদের সঙ্গে যত অপরাধ হয় তার খুব কম অংশই নথিভুক্ত করা হয়। যথাযথ আইন না থাকায় সব ধরনের অপরাধ আইনের আওতায় আনাও সম্ভব হয় না, যা আছে তার প্রয়োগও নগণ্য। অধিকাংশ সময় নথিভুক্ত অপরাধগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। তাই ছেলেদের দিক থেকে তারা সব সময়ই যা খুশি করে পার পায়। আর মেয়েরা যতটা পারে নিজেদের গা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারপরেও তারা এইসব সহিংসতার স্বীকার হয়।”

সোয়াদ মনে করেন, আইন করার চেয়ে যেটা বেশি জরুরি তা হল সচেতনতা।

তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত যে কোনো অপরাধ রোধে যতগুলো আইন আছে তার কোনোটাই শতভাগ কাজে আসে না। তবে আমরা যদি ছোটবেলা থেকে পাঠ্যবইয়ে, গণমাধ্যমে এবং পরিবার থেকে সন্তান লালন-পালনের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সংবেদনশীলতা গড়ে তুলতে পারি সেটা সহজেই অনেক অপরাধকে রুখে দেবে।”

আবু সালেহ মোহাম্মদ সোয়াদ।

“আমরা যদি ছেলেদের শেখাতে পারি কাউকে খুন করা অন্যায়, কারও জিনিস চুরি করা অন্যায় তাহলে কেনো শেখাতে পারব না, মেয়েদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করাও অন্যায়? তাদের শিক্ষার অভাবে তো নারীদের জীবন দুঃসহ হয়ে উঠতে না।” যোগ করলেন সোয়াদ।

শিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে যে ছেলেদের আক্রমণাত্মক আচরণ যে সহনশীল আচরণে পরিণত হতে পারে তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ শ্যামপুরের ঢাকা ম্যাচ কলোনিতে চলমান ‘প্ল্যান বাংলাদেশের আরবান প্রোজেক্ট’।

ইশতিয়াক আহমেদ মোক্তার ওই এলাকারই একজন তরুণ। তিনি এই প্রোজেক্টের আওতায় এলাকার ছেলেমেয়েদের নাটক মঞ্চায়ন করা শেখান। তাদের করা নাটকগুলোতে গণ সচেতনতার বিষয়গুলো উঠে আসে।

মোক্তার বলেন, “নাটকের রিহার্সেল করা, এর আয়োজন করা ইত্যাদির মাধ্যমে ছেলেরা মেয়েদেরকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পায়। ফলে তারা মেয়েদের সমস্যাগুলোর প্রতি সহনশীল হতে শিক্ষা পায়।”

“আমি এমন অনেক ছেলেকে চিনি যারা এইসব নাটক দেখার আগে মেয়েদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করত, এখন তদের মনোভাব বদলেছে, তারা তাদের কাজের জন্য লজ্জিত।” জোর দিয়ে বলেন মোক্তার।

তাহমিনা বলেন, “ছেলে ও মেয়েরা নিজেদের অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রোজেক্ট এলাকায় বেশ কিছু শুভ উদ্যোগের সূচনা হয়েছে, এখন মূল পথগুলোতে আলো দেওয়া হয়েছে, ছেলেরাও অনেকটাই সহনশীল হয়েছে। ছেলেমেয়েরা মিলিতভাবে তাদের সমস্যা সুবিধার বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ করছে।

আশা করা যায় এ ধরনের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ ব্যাপকভাবে নেওয়া গেলে নারীদের বিষয়ে পুরুষদের সহনশীলতা বাড়বে এবং হয়রানি বন্ধ হবে।

প্রচ্ছদের ছবি কৃতজ্ঞতায় মোসফিকুর রহমান জোহান।