বালিয়াটির জমিদারবাড়ি

শুধু রাজ্যটা আছে, রাজা নেই।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2017, 12:19 PM
Updated : 12 June 2017, 12:22 PM

রাতেই কথা হয়েছিল ভোর ছয়টায় বের হব। তবে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না। এরমধ্যে নাজমূল ভাইর ফোন আর ফোন। তিনি এবারের ভ্রমণসঙ্গী। কি আর করা এক সময় অনিচ্ছাতেই বিছানা ত্যাগ করতে হল। যখন বাসা থেকে বের হলাম তখন সকাল আটটা। নাজমূল ভাই গুলিস্তান বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে চলে এসেছেন। বাস ছাড়লো সকাল সাড়ে আটটায়। ধলেশ্বরি আর বংশাই নদী পেরিয়ে আসলামপুর আসতে দুই ঘণ্টা।

ঢাকা থেকে ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বের ছোট্ট জনপদ আসলামপুর। আগের দুবার সরাসরি সাটুরিয়া হয়ে বালিয়াটি যাওয়াতে আসলামপুর সম্পর্কে কিছইু জানা ছিল না। হোটেলে খেতে বসে আসলামপুর সম্পর্কে খোঁজ-খবর করলাম। তারপর একটি ব্যাটারি চালিত ভ্যানগাড়ির সওয়ার হলাম।

সোজা রাস্তার দুপাশেই ধান খেত। ছোট খাল আর কিছু ডোবাও দেখা গেল। তখন ছিল হেমন্ত। সেই ডোবাতে দেখলাম পাট জাগ দিতে। শুকিয়ে দেওয়া পাটও দেখলাম চলতি পথে কিছু কালভার্ট ও সেতুতে। আক্ষরিক অর্থে নয়, জায়গাটা সত্যি সুন্দর।

এক ঝাঁক কাঠঠোকরার উড়ে চলা দেখে ভ্যানগাড়ি থামতে বলতেই বোঝা হল আমরা এক আজব বাহনের যাত্রী।

সবচেয়ে মজার হল, গাড়িতে ব্রেক নেই, ব্রেক করতে হয় গাড়ি থেকে নেমে কিছু সময় দৌঁড়ে পা দিয়ে। ব্রেকজনিত সমস্যার জন্য কাঠঠোকরা পেছনে ফেলে পেলাম সবুজ সুঁইচোরা। সুঁইচোরার ছবি তোলা শেষ করে আবার সেই ব্রেকহীন যানে চেপে একঘণ্টায় সাটুরিয়া পার হয়ে বালিয়াটি যখন পৌঁছালাম তখন দুপুর দেড়টা। রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ফটক খুলবে আড়াইটায়। অনেকটা অনুরোধ করেই ভেতরে প্রবেশ করলাম।

প্রবেশ মুখে সিংহ দেখে যতটা না বিস্মিত নাজমূল ভাই, তারচেয়ে বেশি বিস্মিত সিংহের রং দেখে। সত্যিকার অর্থেই আমরা আজব দেশের আজব বাসিন্দা। তা না হলে সিংহের রং এমন মেটে হবে কেনো আর একটি অ্যান্টিক ভবন কেনো এভাবে সাদায় মুড়িয়ে ফেলা হবে। তবে যাই বলি রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনের শোভা একবারে মনোমুগ্ধকর। পরিবেশও খুব ভালো। শেষ পর্যন্ত যা হল নাজমূল ভাই সেই পুরাতনকে নতুন করে দেখে মুগ্ধ হলেন, তারপর ফটাফট ছবি তোলা। বলাবাহুল্য তিনি কিন্তু নতুন রং করা বা সাদায় মোড়া ভবনটির ছবি তোলেন নি, সাদাতেই তো তাঁর যত কষ্ট!

আমরা প্রায় ঘন্টা দুয়েক বালিয়াটি রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনে ছিলাম। এখানে সময় কাটানোর মজাই আলাদা। প্রাসাদ মিউজিয়ামে দুপুর আড়াইটার পর দল বেঁধে অনেকেই প্রবেশ করলেও প্রাসাদের পেছনের পুকুর আর তার ছয়টি ঘাটলা সত্যি দৃষ্টি নন্দন। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াশে পার করে দেয়া যায়। পরিবেশের কথা শুরুতে বলেছিলাম। পুরো প্রাসাদ এলাকা একবারে ঝকঝকে তকতকে। এখানকার পরিছন্নতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সারা দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমরা সব কিছু খুঁটিয়ে দেখি। ঘুরে ফিরে অনেকবার দেখি গোথিক শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন রাজপ্রাসাদের সবকটি ভবন।

ধারণা করা হয় জমিদার গোবিন্দ রাম সাহা ছিলেন বালিয়াটি রাজপ্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা। যিনি মূলত ছিলেন একজন লবণ ব্যবসায়ী। গোবিন্দ রাম সাহার মৃত্যুর পর তাঁর চার সন্তান গোলাপ রাম, আনন্দ রাম, পন্ডিত রাম ও দধি রাম- এর মালিক হন।

বর্তমানে বালিয়াটি রাজপ্রাসাদের ৫.৮৮ একর জমির পুরোটাই প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অংশ। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ মুখেই দেখা হবে সাদা রংয়ে মোড়নো দুই নম্বর প্রাসাদের সঙ্গে। প্রাসাদের দ্বিতীয়তলা এক সময় ছিল নাচঘর বা রঙমহল। যা বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যেকেউ বালিয়াটি রাজপ্রাসাদে গেলে জাদুঘরের ভেতর প্রাচীন নিদর্শনের সংগ্রহশালাটি দেখে মুগ্ধ হবেন। আসলে পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়েই মুগ্ধতা। এখানে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা নিয়ে আছে ছয়ঘাট বিশিষ্ট চমৎকার একটি পুকুর, আর আছে প্রাসাদসম সাতটি বিশাল ভবন।

পুরো রাজপ্রাসাদ এলাকা একবারে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। একদুইটা ভবন নতুন রং করা দেখে একটু খটকা লাগে। তবে খটকার চেয়ে ভালো লাগাই বেশি। বিশাল করিনি'য়াম থাম, পেঁচানো লোহার সিড়ি, বিশাল সব থাম, ঝারবাতি, প্রসাদ ভবনের গায়ের বিভিন্ন কারুকার্য বা নকশা। জানালার রঙিনকাচ মিলে প্রাসাদ শোভা অসাধারণ।

প্রায় দুঘন্টা বালিয়াটি রাজপ্রাসাদ ঘুরে বেড়িয়ে যখন বের হব তখন লক্ষ্য করি একটি স্মৃতি স্তম্ভে রাজপ্রাসাদের ইতিবৃত্ত লেখা। রাজপ্রাসাদ বর্ণনার কিছু অংশ সেখান থেকেই সংগ্রহ করা। গোসল ঘর, টয়লেট রঙমহলসহ সবই আছে রাজপ্রাসাদে এবং সব কিছুই সুরক্ষিত। যা দেখে আপনার ভালো লাগায় পূর্ণতা আসবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রতি ২০ মিনিট অন্তর পাটুরিয়া মানিকগঞ্জ বাস চলাচল। তেমন একটি বাসে চেপে বসুন। দুই ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন কালামপুর।

কালামপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকসা, ব্যাটারি চালিত অটো-রিকসা, ব্যাটারি চালিত ভ্যানগাড়ি কিংবা সাটুরিয়ার বাসে চেপে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন বালিয়াটি রাজপ্রাসাদ।

গাবতলি-আমিন বাজার থেকে সরাসরি সাটুরিয়ার বাস পাবেন। সেক্ষেত্রে সাটুরিয়া নেমে ব্যাটারি চালিত ভ্যান গাড়িতে বালিয়াটি পাঁচ মিনিটের পথ। চাইলে বঙ্গবাজারের সামনে থেকে মানিকগঞ্জের বাসে কিংবা সাটুরিয়ার বাসে সরাসরি বালিয়াটি চলে যেতে পারবেন। সারাদিনের ভ্রমণ, দিনে গিয়ে দিনেই ফেরত। নিজস্ব বাহন হলে ভ্রমণ সবচেয়ে বেশি আনন্দদায়ক হবে।

আমি দলবেঁধে নিজস্ব বাহনেই বালিয়াটি যাওয়ার পরামর্শ দেব। তাহলে খুব সকাল সকাল বের হয়ে এক সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, ধামরাই কাসা পল্লিও ঘুরে আসা যাবে।

দুপুরের খাবারের জন্য জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, কালামপুর বাজার বা সাটুরিয়া বাজার ও বালিয়াটির খাবারের ওপর ভরসা করতেই পারেন।

ছবি: লেখক।