মাতৃত্বকালীন আইন: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

কর্মজীবী নারীর জন্য মাতৃত্ব সবসময়ই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। প্রচলিত আইন তাদের কতটুকু সাহায্য করে বা আইন থেকে তাদের প্রত্যাশাই বা কী!

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2017, 11:12 AM
Updated : 14 May 2017, 11:12 AM

একজন নারীর জীবনে মাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কর্মক্ষেত্রে যখন নারীদের আগমন শুরু হয় তখন থেকে কর্ম এবং মাতৃত্বের দায়িত্বের একটি স্বাভাবিক ভারসাম্য তাদের রক্ষা করতে হয়। কর্মক্ষেত্র থেকে তারা কতটুকু সহায়তা পায় তার উপরে তাদের উভয় ভূমিকার সাফল্য নির্ভর করে।

পৃথিবীর অন্য সকল দেশের মতো বাংলাদেশেও মাতৃত্বকালীন সময়ে কর্মজীবী নারীদের সহায়তার জন্য একটি মাতৃত্বকালীন সুবিধা শ্রম আইন-২০০৬’য়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কী আছে সেই আইনে তা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন।

তাসলিমা ইয়াসমিন।

“আমাদের যে মাতৃত্বকালীন আইনটি আছে তাতে বলা হয়েছে, কর্মজীবী নারী যিনি তার চাকরির প্রথম ছয়মাস পূর্ণ করেছেন তিনি গর্ভবতী হলে গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান জন্মের পরে সর্বমোট ১৬ সপ্তাহ ছুটি পাবেন এবং তা বৈতনিক ছুটি হবে। ২০১০ সালে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারী চাকুরীজীবী নারীদের জন্য তা ছয় মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা। এটি একটি সর্বনিম্ন সময় চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের বিবেচনার ভিত্তিতে এটি এর চেয়েও বাড়ানো সম্ভব।”

“শ্রম আইনের মাতৃত্বকালীন সুবিধা সংক্রান্ত অধ্যায়টির বাকি অংশ মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য যেমন, আইনের ৪৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি চাকুরিদাতা গর্ভধারণের কথা জানেন তবে তিনি সন্তান জন্মদানের নির্দিষ্ট সময়ের ১০ সপ্তাহ আগে এবং সন্তান জন্মদানের ১০ সপ্তাহ পরে শ্রমসাধ্য কোনো কাজ করতে পারবে না। আবার ৫০ অনুচ্ছেদে এও বলা হয়েছে যে, সন্তান জন্মের ছয়মাস আগে এবং আট সপ্তাহ পরে যদি কোনো নারীকে চাকরীচ্যুত করা হয় তবে যথাযথ কারণ দর্শাতে হবে, অন্যথায় নারীটি তার প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন না।” যোগ করেন তাসলিমা।

তাসলিমা আরও জানান, “এ ছাড়াও মাতৃত্ব পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলার জন্য শ্রম আইনের ৯৪ অনুচ্ছেদে শিশু কক্ষ বিষয়ক একটি আইনের কথা বলা হয়েছে, যদি কোনো কর্মক্ষেত্রে ৪০ জন বা তার থেকে বেশি নারী কর্মী থাকে তবে তাদের ছয় মাস থেকে ছয় বছরের শিশুদের কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু কক্ষ স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।”

“যদিও মাতৃত্বকালীন আইন ভঙ্গের জন্য আলাদা কোনো শাস্তির বিধান নেই তবে, শ্রম আইন ভঙ্গের একটি সার্বিক শাস্তি রয়েছে তা হল, আইন ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেলে চাকুরীদাতাকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। এ ছাড়াও, কর্মক্ষেত্রে চাকুরীদাতার অবহেলার জন্য কেউ যদি গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হন তাহলেও শাস্তির বিধান রয়েছে।” জানান তাসলিমা।

তিনি আরও যোগ করেন, “এই আইন কেউ ভঙ্গ করলে বা আইন ভঙ্গের জন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে লেবার কোর্টে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। বাদী যদি মনে করেন লেবার কোর্টে তিনি সুবিচার পাননি তবে উচ্চতর আদালতেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।”

ড. সানজীদা আক্তার নীরা।

এ আইনটি চাকুরীরত মহিলাদের ক্ষমতায়নে কতটুকু সহায়তা করে তা ব্যাখ্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের শিক্ষক ড. সানজীদা আক্তার নীরা।

তার মতে, “আইনটি একটি নূন্যতম আইন, এটিকে সংশোধনের অবকাশ রয়েছে, সময়ের সঙ্গে আইনটি উপযোগী করা হয়নি। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা এ আইনের প্রচার এবং প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে।”

“বিভিন্ন সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের নানান গবেষণা থেকে দেখতে পেয়েছি এই আইনের বিষয়ে সুবিধাভোগীদের প্রায় ৪৭ শতাংশই আইন সম্পর্কে অজ্ঞাত। বেশিরভাগ কর্মজীবী মহিলা ভাবেন এটি তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মপন্থার নীতি। এটি যে একটি দেশের আইন তা সম্পর্কেই সবাই অবহিত নন।” বললেন তিনি।

ড. সানজীদার মতে, “মাতৃত্বকালীন এই আইন সার্বজনীন নয়, একজন মা কখনও, সরকারী বা বেসরকারী হতে পারে না। মাতৃত্বের প্রয়োজন সবার জন্য সার্বজনীন হয় তাই চার মাস এবং ছয় মাসের মধ্যকার দ্বিধা দূর করা খুবই জরুরি। এ ছাড়াও অপ্রচলিত চাকুরী যেমন শিল্পী, কলাকুশলী, ফ্রিল্যান্সার এবং ব্যবসায়ী নারীদের নিরাপত্তা এই আইন দেয় না।”

তিনি আরও বলেন “আইনের আরও একটি বড় সমস্যা চাকুরীতে যোগদানের ছয় মাসের মধ্যে কেউ এই আইনের আওতায় মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবে না। এতে নতুন চাকুরীজীবীরা তো বটেই মধ্যবর্তী সময় চাকুরী পরিবর্তন করা নারীরাও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।”

এ ছাড়াও এই আইনে কোনো জন্মপূর্ববর্তী ছুটির কথা বলা নেই। যে ছুটিটার কথা বলা হয়েছে এতে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময়ের ছাড় নেই। অনেক সময় অনেকের গর্ভধারণ স্পর্শকাতর হয়, পা ফুলতে পারে, সকালে বমি হতে পারে, সন্তান জরায়ু মুখে অবস্থান করতে পারে। এধরণের অবস্থায় মা এবং সন্তানের নিরাপত্তার জন্য মাকে বিশ্রামের সময় বাড়িয়ে দিতে বলা হয়। গর্ভাবস্থায় প্রথম ১৩ সপ্তাহ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। গবেষণা থেকে জানা যায় ২৫ শতাংশ প্রসূতি ১৩ সপ্তাহ সময় পার করার আগেই গর্ভস্রাবের সম্মুখীন হন। এ ছাড়াও গর্ভাবস্থায় শারীরিক মানসিক অধিক পরিশ্রমের দরুণ জন্মক্ষণের পূর্বেই সন্তান জন্ম (premature birth) নিতে পারে।

“আইনটিতে ধরেই নেওয়া হয়েছে সন্তান জন্মদান একটি নিয়মমাফিক মসৃণ প্রক্রিয়া। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতে পারবে না।” মত দেন জানান ড. সানজীদা।

“একইভাবে শিশু কক্ষ বিষয়ক আইনটিতেও বৈষম্য করা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন নারী থাকলে তবে শিশু-কক্ষ দেওয়ার বিষয়টি নির্দেশ করে, অনেক পরিমাণে নারী যদি কাজে আসতে পারে তবে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে। এটি এমন একটি আইন নয় যা অনেক পরিমাণ নারীকে কাজে আসতে উৎসাহিত করবে।” উল্লেখ করেন তিনি।

“আমরা যখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা চিন্তা করি তখন অশিক্ষিত দরিদ্র নারীদের বিষয়টি মাথায় রাখি। তবে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীরা সমাজের যে বহুমুখী চাপে থাকে এবং অর্থের উপার্জন থেকে বঞ্চিত হলে তাদের ক্ষমতায়নও ব্যাহত হয়। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা এবং মেধার পিছনে ব্যয়কৃত অর্থ থেকে কোনো লাভ সমাজ পায় না। শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও পরিবারে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায় এবং তার নিজের সকল চাহিদার জন্য অন্যের গলগ্রহ হয়ে রয়।”

শারমীন শামস।

শারমীন শামস একজন কলামিস্ট এবং সক্রিয় নারীবাদী।

তিনি বলেন, “যদিও আইনে লেবার কোর্টে যাওয়ার একটা সুযোগ রাখা হয়েছে তবে আমাদের দেশে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কারও অজানা নয়। তাছাড়াও লেবার কোর্টে মামলা উঠলে কর্মী নিজ কর্মক্ষেত্রে তো অসহযোগী আচরণ পাবেই অন্য কোথাও তার কাজ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। এরকম অবস্থায় আইনটি বরাবরই প্রয়োগহীন অবস্থায় থাকে।”

তিনি আরও বলেন, “আইনে এমন কিছু বিষয় আছে যা হালনাগাদ করার জায়গা রয়েছে, যেমন আইনে বলা নেই নারীকে ঠিক কোন কোন পরিস্থিতিতে চাপ দেওয়া যাবে না। যেসব কর্মক্ষেত্রে শরীরের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় অথবা রাত্রিকালীন দায়িত্ব গ্রহণের বিষয় থাকে সেখানে একজন গর্ভবতী নারীকে অব্যাহতির বিষয়টি পুরোটাই কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। কেউ চাইলেই এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরি করে গর্ভবতী নারীকে চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে বাধ্য করতে পারে।”

“অর্থাৎ পরিস্থিতিটাই এমন যে এখানে হয় সব অসুবিধা সহ্য করে টিকে থাকতে হবে নতুবা চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

“তাই যতটুকুই আইন আছে তা ঠিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য একটা আলাদা সেল বা অভিযোগের জায়গা থাকার প্রয়োজন এবং সেটিকে নিয়মিত তত্ত্বাবধায়ন প্রয়োজন যেন আইনের সুবিধাটা অন্তত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।” দাবী শারমীনের।

মুনির হাসান।

মুনির হাসান বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্বরত আছে। তিনি তার কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কম নিয়ে সচেতন।

তিনি বলেন, “কিছু গবেষণা থেকে এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে, যে পরিমাণ নারী কোনো বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ আনুপাতিক হারে অনেক নিম্ন।”

মুনির হাসান এই নিম্ন হারের জন্য অনেকগুলো সমস্যা চিহ্নিত করেন যার মধ্যে একটি মাতৃত্বের দায়িত্বের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের সমন্বয় না করতে পারা।

বর্তমানে বিডিওএসএন তাদের “মিসিং ডটার” নামক প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের কর্মক্ষেত্রে সংযুক্ত করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।

মুনির জানান, “আমরা যদি আমাদের দেশের জিডিপিকে দুই অংকের সংখ্যায় উন্নীত করতে চাই তবে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তবে নারীদের কাজে নিতে হলে তাদের অবস্থান অনুযায়ী সুবিধার ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। তা না হলে নারীদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করা অর্থের সুফল ভোগ করা সম্ভব হবে না, নারীদের ক্ষমতায়নও ব্যহত হবে।”

প্রচ্ছদের ছবি: রয়টার্স।