সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকে মায়ের স্বপ্ন

হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন সব নারীর হয়ত পূরণ করা হয় না। তবে সন্তানের সফলতার মধ্য দিয়ে অনেক মা খুঁজে পায় আত্মতৃপ্তি। এমন কিছু মায়ের গল্প নিয়েই মা দিবসের আয়োজন।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2017, 06:45 AM
Updated : 14 May 2017, 11:12 AM

একসময় মেয়েরা বেড়ে উঠতো বিভিন্ন বিধিনিষেধের বেড়াজালে। তারা চাইলেই এটা হতে পারবে না সেটা করতে পারবে না! এরমধ্যে কৈশোর যেত ফুরিয়ে। আর কুড়ির মধ্যেই বিয়ে করে অন্যের বাড়ি। ব্যস হয়ে গেলো স্বপ্নের শেষ! কোথায় আর নিজের স্বপ্ন সফল করা আর কোথায়-বা স্বপ্ন দেখার ফুরসত? সারাদিন বাড়ির কাজ, পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ, সন্তানের দেখভালে একসময় হারিয়েই যায় নিজের স্বপ্নগুলো। কাজ যদিও করার অবকাশ মেলে সেগুলো খুব ছোটখাট। বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোলা সব পুরুষদের জন্য। মেয়েদের বাবা বাড়িতেই ভালো লাগে। নীরব এবং চুপচাপ।

তবে এখনকার কথা আলাদা। মেয়েরা চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ধুপধাপ নেমে যায়। সংসার বা সন্তানের চিন্তাও তাদের স্বপ্নের পথে এসে দাঁড়াতে পারে না। কারণ তার স্বপ্নগুলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সেই চুপচাপ ঘরের গণ্ডিতে বাঁধা পরা মেয়েটি। জীবন তাকে চুপ থাকতে শিখিয়েছে তবে মানাতে পারেনি থেমে যেতে। তাই কন্যার ডানায় ভর দিয়ে আজও উড়ছে তাদের স্বপ্নগুলো।

ফারহানা মাহমুদ, একটি বেসরকারি ব্যাংকে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আছেন। বরাবর লেখাপড়ায় ভালো, কাজে ভালো, শান্ত মানুষটি নিজের সব সাফল্যের প্রেরণা হিসেবে তার মাকেই খুঁজে পান।

“আমার মায়ের বিশ্বাস আমি একটা হীরার খনি। আমার মধ্যে সব আছে, আমি সব করতে পারব। এ পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমি অর্জন করতে পারব না।” হেসে বলেন ফারহানা।

ফারহানা ও তার মা।

“আমাদের শৈশব কৈশোর খুব আড়ম্বর ছিল না। বাবা সরকারী চাকুরে, পারিবারিক দায়িত্ব ইত্যাদির মধ্যে আমাকে এবং ভাইকে লেখাপড়া করতে হতো। বাড়িতে শিক্ষক রাখার উপায় ছিল না, স্কুলও অনেক দূরে ছিল। এত বৈরী পরিবেশ কখনও গায়ে লাগেনি শুধুমাত্র মায়ের কারণে। তিনি বিশ্বাস করতেন আমি পারবো। অনেক সময় আমি পারতাম না, তাও মা এমনভাবে আমাকে নিয়ে কথা বলতেন যেন আমি করছি না, করছেন উনি নিজেই। আমার মধ্য দিয়েই উনি নিজের জয় খুঁজে নিতেন।” যোগ করেন ফারহানা।

মা কীভাবে শক্ত হাতে তার জীবনটা গড়ে দিয়েছেন সে বিষয়ে ফারহানা বলেন, “পারিবারিক চাপে হয়ত গ্রাজুয়েশন শেষের আগেই আমার বিয়ে হয়ে যেত। শুধু আমার মা অটল ছিলেন। সবার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে উনি বলতেন, আমার মেয়ে আগে চাকরি করবে, পরে বিয়ে হবে। আজ আমি যখন কাজ করি, আমার পদোন্নতি হয়, আমি এগিয়ে যাই, আমার চেয়ে আমার মা বেশি খুশি হন। যেন উনি নিজের স্বপ্নগুলোকে সত্য হতে দেখছেন।”

“যখন কঠিন সমস্যায় পড়ি, মনে হয় হেরে যাব তখন ঠিক মায়ের মুখটাই মনে পড়ে। মনে হয় যেন আমি হেরে গেলে আমার মা হেরে যাবেন, সেটা কি আমি কখনও হতে দিতে পারি?” সহাস্য জবাব ফারহানার।

শাহনাজ খালেক একজন টিপটপ আধুনিক মা। চাকরি করেছেন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন ব্যাংকেও। ড্রাইভিং ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি। তবে আশির দশকের বেশিরভাগ নারীর মতো তাকেও সব স্বপ্নের সীমা টানতে হয়েছে শুধুমাত্র মেয়ে বলে। পরিবারের অর্থের অভাব আর শাসনের চোখ রাঙানোতে থেমে যাওয়া এই মা নিজের স্বপ্ন সফল করেছেন তার দুই কন্যা সারা ও নামিয়ার মধ্য দিয়ে।

শাহনাজ ও তার মেয়েরা।

“আমি একটা সময় সন্তানদের কথা ভেবে কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। বাচ্চারাও আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। একদিন আমার বড় মেয়ে ইনভিজিলেটরের কাজে যোগ দেয়। ও যখন গালায় ব্যাচ ঝুলিয়ে কাজে বের হয় আমার মনে হতো যেন আমিই বের হচ্ছি। হ্যাঁ এটাই তো আমি।” গর্ব ভরে বলেন শাহনাজ।

“আমার বড় মেয়েটা এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। আর ছোট মেয়েটা এবার অনার্স শেষ করল। ছোটটা বেশ পাকা ড্রাইভার। মেয়ে বলে লাইসেন্স পাওয়ার পরেও আমার আর গাড়ি চালানো হয়নি। তবে আমার কন্যাকে আমি সে সীমায় বাঁধতে দেইনি।”

“আমার মেয়েরা কখনও একা কখনও আমাকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতে চলে যায়। ওদের সঙ্গে উড়ে বেড়াতে আমারও বেশ লাগে।”

“মেয়েগুলোর জন্য সকালে উঠে এখনও টিফিন বানাই। অনেকে বলে এত বড় মেয়েদের টিফিন কেনো বানাই? আমি ওদের সঙ্গে আমার শক্তিও বাইরে পাঠাই, যেন এগিয়ে যেতে ওদের জ্বালানীর কমতি না হয়।” বললেন শাহনাজ।

“আমার দুই মেয়ে আমাকে বারবার মুগ্ধ করে ভালো লাগায় ভরিয়ে দিয়ে ভোলায় আমার না পাওয়ার বেদনা। তাদের জীবনতো কেবল শুরু আরও অনেক অর্জন বাকি। আমি বিশ্বাস করি তাদের লক্ষ্যে তারা ঠিক পৌঁছে যাবে।” আশা শাহনাজের।

শাহনাজ ও তার মেয়েরা।

মোবাশ্বেরা টুম্পা, গোয়া ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করছেন। তার দৃষ্টিতে তার মা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত মহিলার একজন।

টুম্পা বলেন, “মায়ের নিজের ইচ্ছা ছিল সে বিএ পাশ করে চাকরি করবে। সেই ইচ্ছাটা সত্যি করা হয়নি। এরপর তার জীবনের ব্রত হয়েছি আমরা তিন ভাই বোন।”

“আমাদের লেখাপড়া আর ক্যারিয়ার ছাড়া মা নিজের জন্য চিন্তা কিছু করে না। আল্লাহর রহমতে সেই স্বপ্ন আমরা তিনজনই অনেকটা পূরণ করতে পেরেছি। আমার বড়বোন একজন অর্থনীতিবিদ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কর্মরত আছেন। আমি বাংলাদেশে একটি কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলাম এখন ভারত সরকারের বৃত্তিতে গোয়াতে এমবিএ করছি। আমার ভাই এ লেভেল দিল। সেও চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছে।” জানান টুম্পা।

টুম্পার মা দিবস কেমন হয় প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মা দিবসে বা যেকোনো সময় আমরা কিছু এনে দিলে তার একটাই কথা, কেন টাকা খরচ করলাম অযথা। এরপরে এতগুলো বকা, এরপরে দেখি খালাকে ফোন করে বলছে আজকে মেয়েরা এটা দিল।”

“আজ যখন দেখি আমাদের সাফল্যের কথা তিনি গর্ব ভরে বলে বেড়ান তখন মনে হয়, হ্যাঁ আমরা পেরেছি আমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। তিনি আমাদের মধ্য দিয়েই নিজেকে বড় করছেন।” তৃপ্ত কণ্ঠে বলেন টুম্পা।

টুম্পা ও তার পুরো পরিবার।

শাহীন মির্জা একজন গৃহিণী। অন্য সব গৃহিণীর মতো তিনি তার অসাধারণ নৈপুণ্য দিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোর লালন করছেন তার সন্তানদের মধ্যে। তার স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে একজন চিকিৎসক হবেন। তার কন্যা শিরিন মির্জা মায়ের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। শিরিন আমেরিকাতে একটি হাসপাতালে রেসিডেন্ট ডাক্তার।

মায়ের কথা বলতে গেলে শিরিন বলেন, “মামণির কথা ভাবলেই মনে হয়, আমি জীবনের বাস্তবতায় তলিয়ে যাচ্ছি। আমার মা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সেটি বাবা মারা যাওয়ার পরে বরিশাল মেডিকেলেই নেওয়া হোক, অথবা আমেরিকায় আমার নবজাতক সন্তানকে রেখে আরেকবার চিকিৎসক হওয়ার পরীক্ষায় আবার উত্তীর্ণ হওয়াই হোক। মামণি আমার হাত ধরে ছিলেন শক্ত করে।”

শাহীন বলেন, “আমি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারিনি। তবে আমি এবং ওর বাবা সবসময় চাইতাম আমাদের মেয়ে যেন ডাক্তার হয়। মেয়ের সাহসও ছিল দারুণ। ছোটবেলায় একবার কারেন্ট যাওয়ার পরে মেয়ে বাথরুমে আটকে ছিল। অন্ধকারে সে ভয়ও পায়নি, চিৎকারও দেয়নি। আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার ভয় লাগে না? আমার কেজিতে পড়া মেয়ে জবাব দিল, কেন ভয় লাগবে মা? আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো না!”

চমৎকার এই পরিবারটির জীবনে ভীষণ দুঃখজনক স্মৃতি শিরিনের বাবার মৃত্যু।

শিরিন, তার মা শাহীন ও কন্যা অ্যামেলিয়া।

শাহীন বলেন, “আমার স্বামী খুব সহযোগিতা করতেন, সন্তানদের পালনে আমার সব সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখতেন। তিনি চলে যাওয়ায় আমি অকুল পাথারে পড়লাম। দুদিন দিশেহারা হয়ে কান্নাকাটি করার পরে আমি বুঝলাম, আমার এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। আমি দুর্বল হলে আমার সন্তানরা ভেঙে পড়ছে। ছেলের দশদিন বাদে ফাইনাল, মেয়েও বরিশাল ফিরে যেতে চাইছে না। আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম।”

“সন্তানরা আমার আশা পূরণ করল। ছেলে এই দুঃখের দিনেও বিবিএতে ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হল, আর মেয়ে ডাক্তার। আমার মেয়ে এখন আমেরিকাতে। ওর নিজের একটা তিন বছরের বাচ্চা আছে। বাচ্চাটাকে নিয়ে জামাই থাকে অন্য আরেকটা রাজ্যে। সবসময় আমি ওদের পাশে দাঁড়াতে পারি না। তবে আমার মেয়ে আর জামাই তাও যে থেমে যায়নি এটা আমাকে খুব শান্তি দেয়।” গর্ব নিয়ে বললেন শাহীন।

মা দিবস উপলক্ষ্যে শিরিন মাকে কার্ড পাঠিয়েছেন, তবে শাহীনে আক্ষেপ এত খরচ করে কার্ড পাঠানোর কী দরকার ছিল! শাহীনের ছেলেও মায়ের জন্য নানান আয়োজন করছেন।

শাহীন বলেন, “ওরাই তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। ওদের বাবা নেই সে কথা ওরা আমাকে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে দেয় না। ওদের বড় হওয়াতেও আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ।”

প্রচ্ছদের ছবি: রয়টার্স।