জল-অরণ্যে রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়ক

উঁচু-নিচু কখনওবা ঘন অরণ্যে ঢাকা কাপ্তাই-রাঙামাটির ২৪ কিলোমিটারের এই পিচঢালা পথ। অরণ্যের সুনসান নিরবতা ভাঙে ঝরাপাতার শব্দে কিংবা শুকনা পাতার মর্মর ছন্দে।

সমির মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2017, 12:04 PM
Updated : 12 June 2017, 12:25 PM

বৃষ্টিমুখর পাহাড়ের সকালগুলো বেশ আলাদা হয়, মেঘের সঙ্গে অন্ধকার নেমে আসে পাহাড়ের চুড়ায়। বৃষ্টির হাতছানিতে মেঘের অন্ধকার গ্রাস করে পাহাড়ের রাজ্য।

পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকে কালো মেঘের দল। ঝুম ধারায় নেমে আসে অঝোর বৃষ্টি। বিজলি রেখা স্পর্শ করে পর্বতচূড়া।

ঝুমবৃষ্টির হাওয়ায় সকালের নাস্তা সেরে রওনা হলাম রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়ক ধরে। নতুন এই সড়ক ছুঁয়ে আছে জলের ধারা, অন্যপিঠে ছোট-বড় পাহাড়।

সিএনজি'র পরিচিত চালক আসামবস্তি ব্রিজে ব্রেক ধরল। এখানে ছবি তোলার অল্প বিরতি। দারুণ মুগ্ধতায় ঝড়ো হাওয়ায় একের পর এক আঁছড়ে পরে ঢেউ, যেন কোনো সমুদ্র তটে পৌঁছে গেছি। জলের ধারা পেরিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো ফুরোমন পাহাড়।

আগে তো ফুরোমন থেকে পুরো কাপ্তাই লেকের দৃশ্য দেখেছি। এবার দূর থেকে ফুরোমনের চুড়ায় মেঘের নাচন দেখছি। অচেনা মেঘের দল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রাঙামাটির এই সর্বোচ্চ উচ্চতা।

আকাশ ছোঁয়া ফুরোমন দেখতে দেখতে আবার যাত্রা করলাম সর্পিল সড়কের উঁচুনিচু পথ ধরে। বৃষ্টির দমকা হাওয়া সকাল থেকে, কাপ্তাই লেকে সীমাহীন দিগন্তের ভাঁজে ভাঁজে কালো মেঘের রেখা। জলে ভেসে বেড়ায় ছোট ছোট মাছ ধরার ডিঙি নৌকা। বিরূপ আবহাওয়া এখানে জীবকার ধারাকে বন্ধ করতে পারে না।
আসামবস্তি ছেড়ে কাপ্তাইয়ে দিকে এগিয়ে যেতেই বনভান্তের আদম (গ্রাম)। নির্মিত হচ্ছে বন বিহার আর জলের মাঝে স্তম্ভ। ছোট ছোট পাহাড়ের জুম বাড়ি পেরিয়ে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে পাহাড়ি বসতি। জুমের জন্য এখানে অনেকে স্থায়ী বসতিও তৈরি করেছে। সড়কের লাগায়ো পাহাড়ের এসব বসতি যেন স্বর্গপল্লী।

ধীরে ধীরে আকাশটা কেমন জানি উজ্জ্বল হচ্ছিল, মেঘের অন্ধকার ছাপিয়ে আকাশে আলোর রেখা। টুকরা টুকলা নীল মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে সাদা ক্যানভাসে, চিত্রকরের অগোছালো চিত্রপটের মতই আকাশে এলোমেলো রংয়ের বাহার। এমন বাহারি আকাশের রং বদলে দিতে পারে একমাত্র প্রকৃতি।

লেকের পাড় ধরে বয়ে চলা সুর সড়ক সুন্দরের পালকে বাঁধানো, ঘন পল্লবে ঢাকা অরণ্য, পাহাড় সড়কের অন্যপাশে সুদূরের দিগন্ত রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত জলধারা। এমন সড়ক এখানে বেশ বিরল!

সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাজার, জুমের কুমড়ার ফুল, লেকের মাছ- কি নেই সে বাজারে। তবে সবচেয়ে বেশি ওঠে নানা রকমের ফলমূল। পেঁপে, কমলা, কলা, আনারস এখানে বিকিকিনি হয়, ক্রেতা সাধারণত পর্যটকরা।

এবার কিছুটা উঁচু পথ পেরুতে হবে, তীব্র গতিতে পাহাড়ে ওঠার একটা দারুণ ছন্দ আছে। উঁচু-নিচু কখনওবা ঘন অরণ্যে ঢাকা কাপ্তাই-রাঙামাটির ২৪ কিলোমিটারের এই পিচঢালা পথ। অরণ্যের সুনসান নিরবতা ভাঙে ঝরাপাতার শব্দে কিংবা শুকনা পাতার মর্মর ছন্দে। বুনো পাখির অচেনা ডাকে যেন পাহাড়ি সুরের শব্দ শোনা যায়।

এই বুনো পথে মাঝেমধ্যেই বন থেকে নেমে আসে বুনো হাতির পাল। তাই সন্ধ্যার পর এ পথে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কেউ চলাফেরা করে না।

কখনও বুনো জঙ্গল কখনও বা সৃজন বন, কাপ্তাই লেকের জলাধারা আর  নীলাকাশে মোড়ানো ২৪  কিলোমিটারের সড়ক নিতান্তই সাদামাটা কোনো রাস্তা নয়, এ পথ প্রকৃতির বুনো সৌন্দর্যের ডানায় ভর করা সড়ক।

প্রয়োজনীয় তথ্য:
ঢাকা থেকে ননএসি বা এসি বাসে চড়ে রাঙামাটি শহর পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।

শ্যামলী, এস. আলম, হানিফ, ডলফিন, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার বাস নিয়মিত চলাচল করে।

রাঙামাটি শহর থেকে রির্জাভ সিএনজি বা মাইক্রো করে কাপ্তাই যাওয়া যায়। তবে রাত যাপন করতে হবে রাঙামাটি শহরে। বেশ কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল আছে- হোটেল প্রিন্স, নাদিসা, হোটেল সুফিয়া, সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম।  বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।

ছবি: লেখক ও জিয়াউল হক।