কাঠমালতির গ্রামে

রাজধানীর খুব কাছে। মাঠের পরপর মাঠ গাঁদা কিংবা গ্ল্যাডিওলাসের চাষ হচ্ছে। যেন ফূলে ফুলে ভরা একটি স্বর্গ। ঢাকা থেকে দিনে গিয়ে দিনেই বেড়িয়ে আসা যায়।

ফারুখ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2017, 11:32 AM
Updated : 12 June 2017, 12:25 PM

শুক্রবার সকাল। নাস্তা করে মোটর-সাইকেল নিয়ে কাচপুরের দিকে চললাম। কাচপুর সেতুর কাছে পৌঁছতে আধা ঘণ্টা সময় পার। তারপর থেকেই শ্যামল সবুজ আলোছায়ার লুকোচুরি খেলা। এখন ইরি ধানের মৌসুম। মাঠে-ক্ষেতে ইরি ধান রোপনের ধুম। চলতি পথে বেশ কিছু বীজতলা চোখে পড়ল। এসব দেখে দেখে পথ চলছি।

এভাবেই কখন যে লাঙ্গলবান্দ পেরিয়ে এসেছি বুঝতে পারিনি। এখন মীরকুন্দি গ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। একটু পরপর মানুষের কোলাহল, ভিড় আর পাশেই ব্রক্ষ্মপুত্র নদের শীর্ণ স্রোতধারার বুকে নজরকাড়া বেদের বহর। আর প্রতিটি বাড়ির সামনে শিমের মাচায় ঝুলে থাকা শিম। একেবারে মুগ্ধতায় ভরা দৃশ্য। ছবি তুলে কিছু মূহুর্ত কাটাই। তারপর আবার এগিয়ে চলা। যাচ্ছি স্বাবদি গ্রামে।

স্বাবদি যাওয়ার পথ।

এমনিতেই আমার দেশের গ্রামগুলো সৌন্দর্যে অনন্য। স্বাবদিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই গ্রামের বৈশিষ্ট অন্যখানে।

স্বাবদি ফুলের জন্য বিখ্যাত। বলা যায় ফুলের গ্রাম। এখানে গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাসের ক্ষেত পথে পথে। এসব ছাঁপিয়ে স্বাবদি বিখ্যাত কাঠমালতির জন্য। স্বাবদি হল কাঠমালতির গ্রাম। কাঠমালতি থেকে তৈরি হওয়া গাজরার চালান যায় এখান থেকে সারা দেশে।

চলতে চলতে মিনারা আর কাইকার টেকের মতো অসংখ্য গ্রাম পেছনে ফেলে স্বাবদি পৌঁছুতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে যায়।

পুরো গ্রামটাই কাঠমালতিতে ঘেরা। মুগ্ধতার মধ্যেই চোখে পড়ে স্বাবদি বাজার আর কালি মন্দির। খুব ক্ষিদা পেয়েছিল, প্রথমে বাজারে যাই। নাম মাত্র বাজার। খাবার বলতে জিলাপি শিঙ্গাড়া আর মিষ্টি। দুপুরে মিষ্টি খেতে মন সায় দিলনা। আধা কেজি আঙ্গুর কিনে কাছেই খেয়াঘাটে যাই।

এখানে অনেক নৌকা পারাপারের জন্য বসে আছে, ওপারের নবীনগর সবার গন্তব্য হলেও বিকালবেলা কাছে-দূরের অনেক ছেলে-মেয়ে নৌকায় চড়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ ঘুড়তে এসেছে।

খেয়াঘাট।

এখানে একটি প্রাচীন বটগাছের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বটতলায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ। পাশের কালিমন্দির আমাদের আলাপের বিষয়। মন্দিরটি খুব পুরাতন। তবে এলাকার লোকেদের মতে যতটা পুরাতন আমার ঠিক ততটা পুরান মনে হল না। মন্দিরের পাশে একটি মসজিদ রয়েছে, দেখলেই বোঝা যায় মসজিদটি একেবারে নতুন তৈরি করা। এখনও রং-পলেস্তার কিছুই করা হয়নি।

শ্রী শ্রী রক্ষা কালি মন্দির। জনৈক দ্বারিকা নাথ এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠার সময়কাল ছিল, এখন মুছে গেছে। চোদ্দশ সাত বাংলা সালে এটি পুনঃনির্মাণ করা হয়।

দ্বারিকানাথ ঠাকুর নারায়নগঞ্জ টান বাজারের বাসিন্দা ছিলেন। একশত বছর অতিক্রম করা মন্দিরটি আমরা ঘুরে দেখি। মন্দিরের চুড়ায়, কোটরে টিয়া পাখির বাসা, এখানে অনেক টিয়াপাখির বাস। পাশের বটগাছটিও টিয়া পাখির আবাস গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হতে পারে। বটগাছের ফল আবার টিয়াপাখির প্রিয় খাবার।

এবার মটরসাইকেল রেখে পায়ে হেঁটে পথ চলি। চলতে চলতে আগের চেয়ে বেশি অবাক বিস্ময়ে রাস্তার দুধারের কাঠমালতি দেখি।

বেদের বহর।

এখানে অনেক গাঁদা ও গ্লাডিওলাসের ক্ষেত রয়েছে। দুপুর হলেও ক্ষেতে বেশ কিছু অল্প বয়সি ছেলে-মেয়ের ভিড়। সবাই এখানে বেড়াতে এসেছে। এমনটা নাকি প্রতিদিনই ঘটে। বেড়াতে এসে এসব তরুণ-তরুণীরা ফুলও কিনে নেয়। ক্ষেত মালিক এভাবে ফুল বিক্রি করে অভ্যস্ত।

এসব দেখতে দেখতে ক্ষেতের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করি, যতদুর চোখ যায় ফুল আর ফুল। এভাবে ফুলের মধ্যে বসে কতনা বিকেল কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব ভাবতে ভাবতে ক্ষেত ছেঁড়ে এবার স্বাবদি গ্রামের গাজরা তৈরির কারখানা বা গাজরার কারিগরদের খোঁজে পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াই।

চলতি পথে আমার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল গরুর পাল। রাস্তার দুধারে কাঠমালতির অঢেল সমারোহ। এখানে প্রতিটি বাড়িকেই গাজরা তৈরির কারখানা বলা যায়।

কালিমন্দিরের উপর জোড়া টিয়াপাখি।

আমি এক এক করে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ঢুঁ মারি। প্রায় সব বাড়িতেই কাঠমালতির ফুল আর গাজরা তৈরি হতে দেখলাম। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই কাজে বেশি নিয়োজিত হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজনও গাজরা তৈরির কাজ করেন।

গাজরায় অভিভূত হয়ে ভুলতেই বসেছিলাম আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ফিরতে ফিরতে কাঠমালতির শোভা দেখি। এ সময় বাড়ির মহিলারা রাস্তার ধারে কাঠমালতি গাছ থেকে ফুল তোলায় ব্যস্ত। এখানে মহিলাদের পেশাই হল কাঠমালতি সংগ্রহ।

আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এক ব্যাগ কাঠমালতির জন্য গাছ-মালিক তাদের ২০ টাকা দিয়ে থাকেন। রাস্তার দুপাশে সারিসারি কাঠমালতি গাছ পাশের বাড়ির মালিকের। তবে খাস জমির কাঠমালতি সরকার ইজারা দিয়ে থাকেন। ইজারাদার তাদের নিজস্ব শ্রমিক দিয়ে ফুল তুলে তা বিক্রি করেন, আবার নিজেরাই ফুলের কলি দিয়ে গাজরা করে তা শহরে পাঠিয়ে দেন।

কাঠমালতির ক্ষেত।

শহর থেকেও অনেক পাইকার চলে আসেন গাজরার জন্য। পাইকাররা গাজরা, গাঁদা ও গ্লাডিওলাস ফুল কিনতে কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাবদি চলে আসবে। এদিকে পেটের ক্ষিদে আকাশ ছুঁয়েছে। সুতরাং পাইকারের অপেক্ষায় না থেকে ঢাকা ফেরার পথ ধরি!

প্রয়োজনীয় তথ্য

নারায়নগঞ্জ বন্দর উপজেলায় অবস্থিত স্বাবদি একটি ফুলের গ্রাম। দিনে গিয়ে দিনেই ফেরা যায়। নারায়নগঞ্জ গিয়ে পাঁচ নম্বর ঘাট হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে স্বাবদি যাওয়া যায়।

মদনপুর বা লাঙ্গলবান্দ হয়েও স্বাবদি যেতে পারেন। যেভাবেই যান গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ি থেকে বাসে চড়ে বসুন।

কাঠমালতি ফুল।

একঘন্টায় স্বাবদি পৌঁছে যাবেন। নিজস্ব বাহন হলে লাঙ্গলবান্দ হয়েই স্বাবদি যাওয়া ভালো এবং এখানে দল বেঁধে গেলে মজাই অন্যরকম।

একসঙ্গে লাঙ্গলবন্দ, স্বাবদি, সোনাকান্দা-দূর্গ এবং সোনারগাঁ ঘুরে আসা যাবে। দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে নিন। অথবা ফেরার পথে মদনপুরের কাছে দুপরের খাবার খেয়ে নিন।