বৈশাখী খাবারের সুলুক সন্ধানে

উৎসব ভেদে খাবারের মেন্যু যায় পাল্টে। সেই সূত্র ধরে পহেলা বৈশাখের উৎসবেও থাকে হরেক খাবার- চোষ্য থেকে লেহ্য।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 April 2017, 02:46 AM
Updated : 14 April 2024, 06:19 AM

প্রাচীনকালে বাংলা-ভূমিতে কী ধরনের খাবার খাওয়া হত পহেলা বৈশাখে? এই নিয়ে তরুণ গবেষক রিদওয়ান আক্রামের লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হল।

বৈশাখ মাসটা বঙ্গাব্দের; যা কিনা চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫ সালে)। তাই বলে কি আকবরের আগে কৃষি প্রধান এই বাংলায় নতুন বছরের উদ্‌যাপন হত না? পণ্ডিতেরা বলছেন, হত।

সাহিত্যিক আতোয়ার রহমান সেই পণ্ডিতদের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ‘নববর্ষের উৎসব প্রাচীনকালের বাংলায়ও ছিল, কৃষির প্রথম যুগে। তখনকার নববর্ষের দিন-তারিখ বেঁধে রাখত না কেউ, নববর্ষ তখন উদ্‌যাপিত হতো চাষ মৌসুম শুরুর দিনটিতে, গ্রামের সবার সামাজিক ভোজের মাধ্যমে।’

সেই সামাজিক ভোজে কী কী খাবার থাকত তার কোনো উল্লেখ নেই। তবে মোগল আমলে ঢাকার মুসলিম মৎস্যজীবীরা সেই রকমের এক সামাজিক ভোজের আয়োজন করত। এই মৎস্যজীবীরা পরিচিত ছিলেন ‘মাহিফরাস’ নামে।

বৈশাখ মাসে আজিমপুরে তাদের নিজস্ব মাঠে বিরাট খানাপিনার আয়োজন করা হতো। ২০ থেকে ২৫ মণ চালের খানা রান্না করে নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকসহ কয়েক হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করত তারা। আর এই খাওয়াদাওয়া চলত সারা দিনই।

‘আধুনিক’ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব রীতি অনেক আগেই ত্যাগ করেছি আমরা। তবে সমতলের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী নতুন বছর উপলক্ষ্যে এখনও সামাজিক ভোজের আয়োজন করে থাকেন।

যেমন ওরাঁও, ভুনজার, তুরি, মুণ্ডা এবং সাঁওতালরা বৈশাখের প্রথম প্রহরেই তীর ধনুক নিয়ে দলবেঁধে শিকারে বের হয়। শিকারগুলো দিয়ে বিকালে রান্না করা হয় খিচুড়ি। যা গ্রামের সবাই মিলে খেয়ে থাকেন।

বৈশাখ এলে এখন যে খাবারের স্ট্যাটাস বেড়ে যায় সেটি হচ্ছে পান্তা-ভাত। বছরের বাকি সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে দিন কাটালেও পহেলা বৈশাখের সকাল থেকে ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার পাতে সগৌরবে উপস্থিত এই পদ।

অথচ প্রাচীনকাল থেকে ক্ষেত্র বিশেষে এখনও গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের প্রতিদিনের খাবার কিন্তু এই  পদ।

ঐতিহাসিক সাবাসি-য়ানো মানরিকের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়; ‘ষোড়শ শতকে গরিব বাঙালিরা নুন আর শাক দিয়ে ভাত খেতেন। ঝোল জুটত সামান্যই।’

হতে পারে রাতের খাবার বেঁচে যাওয়া বাড়তি ভাত সংরক্ষণের জন্য পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হত। পরের দিন সকালে মাঠে যাওয়ার আগে ‘ব্রেকফাস্ট’ হিসেবে সেই পান্তা ভাত খেয়ে নিতেন কৃষক।

দীর্ঘদিনের এই পান্তা ভাত খাওয়ার চর্চা হয়ত একসময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন বছর উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল।

অধ্যাপক মুহাম্মদ এনামুল হকের ‘বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ’ প্রবন্ধেও তার সমর্থন পাওয়া যায়;

“বৈশাখ মাসে প্রাতে এক থাল ‘পান্তা’ খেয়ে মাঠে লাঙল দিতে বের হতে আমিও বাংলার কয়েক জেলার চাষিকে দেখেছি। তাই বলছিলাম হয়ত অনুষ্ঠানটি একসময় দেশের সর্বত্র প্রচলিত ছিল।”

অন্যদিকে পান্তা ভাত খাওয়ার মতো আরেকটি অনুষ্ঠান, ‘আমানি’। এর মানে হচ্ছে অসিদ্ধ (আম) চালজাত জল বা পানি।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৯৭০ সালে লেখা তাঁর ‘জয়বাংলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,

‘পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের অতি ধার্মিক পরিবারেও ‘আমানি’ অনুষ্ঠান করতে দেখেছি। চৈত্র মাসের শেষ দিনের (অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির শেষ দিনগত রাতে) সন্ধ্যায় গৃহিণীরা এক হাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব (আম) চাল ছেড়ে দিয়ে সারা রাত ভিজতে দেন এবং তার মধ্যে একটি কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। পহেলা বৈশাখের ভোর বেলায় সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে তাঁরা (গৃহিণীরা) ভেজা চাল গৃহের সবাইকে খেতে দেন। ঘরের সবাই মিলে একে একে তা খেতে থাকে, আর হাঁড়িতে ডোবা আমের শাখা দিয়ে গৃহিণীরা সবার গায়ে পানি ছিটাতে থাকেন। তাঁদের ধারণা, এতে গৃহে নতুন বছরের শান্তি নেমে আসবে।’

এই আমানির সমান্তরাল আরেক অনুষ্ঠান হত চট্টগ্রামে।

সেই সত্তর দশকের কথা স্মরণ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ এনামুল হক আরও লিখেছেন, ‘এখনও চট্টগ্রাম জেলার গ্রাম-দেশে বৈশাখ মাসের সকাল বেলায় এক মুঠো চাল ও এক ‘কত্তি’ (নলবিশিষ্ট মাটির পানপাত্র) ঠাণ্ডা পানি খেয়ে অনেক চাষি মাঠে লাঙল দিতে যায়। তারা বলে, এতে শরীর সারাবেলা ঠাণ্ডা থাকে।’

বাংলা বছরের শেষ দিন এবং পহেলা বৈশাখে উপলক্ষ্যে খাওয়া-দাওয়া কথা উল্লেখ করে প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক আহমদ ছফা লিখেছেন,

‘৩১ চৈত্র, যেদিন বছরের শেষ, রাতে খাওয়ার সময় সকলে সামান্য পরিমাণে হলেও তিতা খাবার খেয়ে থাকেন। এই তিতা খাবারের মধ্যে একটা প্রতীকী ব্যাপার রয়েছে। যে বছরটি পার হয়ে এলাম, সে বছরের ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-শোক সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে নতুন একটা বছরে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। তিতা খাওয়া হচ্ছে সে দুঃখ-বেদনা ধুয়ে ফেলার প্রতীক। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, ৩১ চৈত্র পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হত এবং পহেলা বৈশাখে খাওয়ার জন্য মাছ রান্না করে রাখা হত।’

যাহোক পান্তা ভাতের কথা তো হল, তো ইলিশ মাছই বা বাদ যায় কেনো?

এখনকার পহেলা বৈশাখের দিনটিতে পান্তা ভাতের মানিকজোড় হিসেবে থাকে ইলিশ মাছ। এ মাছের এক-আধটা টুকরা না হলে অনেকেরই এখন নববর্ষ উদ্‌যাপন পূর্ণতা পায় না। তাতে যদি মাছের বাজারে ‘আগুন’ লাগে তাতেও সই।

তবে এই ইলিশ মাছ কীভাবে পহেলা বৈশাখের মেন্যুতে ‘প্রেস্টিজিয়াস’ভাবে উপস্থিত হওয়া শুরু করল!

এ ব্যাপারে ইতিহাস সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কিছু জানায়নি। হয়ত কোনো ঐতিহাসিকই ‘ইলিশ প্রেমী’ ছিলেন না। ঐতিহাসিকদের কথা না হয় বাদ দিলাম। তাই বলে কি বাংলার প্রাচীন কবিদের মুখে জল আনতে পারেনি ইলিশ? সত্যিই অবাক করার বিষয়ই বটে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের আগে এই মাছের নাম-নিশানা পাওয়া যায়নি। এমনকি এপার বাংলার কবি বিজয়গুপ্তের কাব্যেও নেই ইলিশের উপস্থিতি।

আঠারো শতকে সংকলিত বৈয়াকরণিক ম্যানুয়াল বা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড়ের মুনশির অভিধানেও ইলিশের নাম নেই।

আর এসবের জন্য দায়ী করা যেতে পারে ইলিশের কাঁটাকে। এই কাঁটা সমীহ করে চলেছে ভারত বিজয়ী ইংরেজরা। এমনকি অলিখিত আইন করে ইলিশ থেকে যোজন যোজন দূরেই ছিলেন সাহেবসুবারা।

সে সমস্যা থেকে মুক্তি দিতেই যেন ‘স্মোকড হিলসার’ আবিষ্কার। বাষ্পীয় পদ্ধতিতে রান্না করা ইলিশই ইংরেজদের ছাড়পত্র দিয়েছিল এর স্বাদটুকু নির্বিঘ্নে আস্বাদন করতে।

প্রখ্যাত সাতিহ্যিক শংকর ‘স্মোকড হিলসা’কে আখ্যায়িত করেছেন ‘বিলিতি মেম সাহেব এবং দিশি রাঁধুনীদের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন’ হিসেবে।

৮৪ বছর আগে প্রকাশিত সুশীল কুমার দে সংকলিত ‘বাংলা প্রবাদ’ বইয়ে রয়েছে প্রায় ৯ হাজার প্রবাদ। সে সবের মধ্যে মাত্র একটি প্রবাদে দেখা মেলে ইলিশের।

‘ইলিশো খলিশশ্চৈব ভেটকির্মদগুর এবচ। রোহিতো মৎস্যরাজেন্দ্রঃ পঞ্চ মৎস্যা নিরামিষাঃ।’

এতে দেখা যায় খলিশা, ভেটকি, মাগুর আর রুই মাছের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে ইলিশের নাম। তবে এখন নিশ্চিত করেই বলা চলে স্ট্যাটাসের দিক থেকে ইলিশ এখন অনেক উপরে। তাইতো ইলিশ এখন ‘মাছের রাজা’। বাঙালির নতুন বছর উদ্‌যাপনে যে, মাছের রাজাই উপস্থিত থাকবেন এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে।

তবে মধ্যযুগ থেকেই নাকি ঢাকাবাসীরা পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাজা খেয়ে থাকত। সেই সূত্র ধরেই কি পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ খাওয়ার চল চালু হয়েছে? ইতিহাস অবশ্য নিশ্চিত করে কিছু বলে না।

এবার না হয় ঘর ছেড়ে বৈশাখের মেলায় যাওয়া যাক।

বৈশাখী মেলায় হরেক রকম জিনিসপত্রের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই খাবারদাবারও থাকত। সেসবের মধ্যে শুকনা খাবার হত বেশি। এসবের বেশ কিছু দেখা মেলে এখনও। যেমন মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, চিনির খেলনা, মুরালি, কদমা, জিলিপি, আমিত্তি বা অমৃতি।

মুড়ি, খই তৈরি হয়ে থাকে ধান থেকে। এসব কত দিন আগে থেকে তৈরি হচ্ছে তার কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। সংস্কৃতি-সাহিত্যে জিলাপির নাম ছিল ‘কুণ্ডলিনী’। তার পরও জিলাপির বয়স সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। চিনির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ার আগে গুড়ের রসেই সিক্ত হত জিলাপি।

এখন চিনির জিলাপির জয়জয়কার হলেও গুড়ের জিলাপি হারিয়ে যায়নি।

সাহিত্যিক শংকরের মতে, ‘কলকাতার ময়রাদের হাতে পড়ে জিলাপির নিঃশব্দ প্রমোশন হল অমৃতিতে।’

জিলাপির মতো এতটা রসালো না হলেও আমিত্তি কিন্তু একেবারে রসহীন নয়। তবে জিলাপির চেয়ে দীর্ঘজীবী হয় আমিত্তি মানে বেশ কয়েকদিন সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। ফলে আমিত্তির মর্যাদা খানিকটা মিষ্টির কাছাকাছি।

অন্যান্য উৎসবের মতো পহেলা বৈশাখেও মিষ্টির প্রয়োজনীয়তা বেশ। ফলে বৈশাখের মেলায় এবং মিষ্টির দোকানে থাকে তাদের রসালো উপস্থিতি। সেই দিনটিতে বাড়িতে আগত অতিথিদের হাতে অনিবার্যভাবে থাকে মিষ্টির বাক্স। বাঙালি মাত্রই চায় মিষ্টিমুখেই শুরু হোক বছরের প্রথম দিনটি।

সাহিত্যিক অজিতকুমার গুহের বর্ণনায় প্রায় একশত বছর আগে নববর্ষের বিভিন্ন মুখরোচক খাবার-দাবার এবং মেলার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়।

তিনি লিখেছেন, “চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠত। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু, মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো।...মেলায় আর এক দিকে ডালা, কুলো, বেতের ও বাঁশের তৈরি নানা রকম সাজি, মাছধরার চাঁই, হাল ইত্যাদিও আছে।”

আরও লিখেছেন, “ওই দোকানগুলো পেরিয়ে একটু ডান দিকে গেলেই দেখা যেতো নানারূপ ফল ও তেলে ভাজার দোকান। বিন্নিধানের খৈ পাওয়া যেত এই মেলায়। আমার ঠাকুমা চাকরদের নিয়ে মেলায় যেতেন। মাঠের ধারে একটি ঘর থেকে তিনি মেলা দেখতেন। তারপর চাকরদের দিয়ে চিত্রিত করা হাঁড়িতে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা ও জিলাপি কিনে আনতেন। বাড়িতে এসে সকলের হাতে মুঠো করে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা আর জিলাপি দিতেন। আমাদের তা দিয়ে মহা আনন্দ উৎসব সমাপ্ত হত।”

সে সময়কার বৈশাখী মেলায় আরও পাওয়া যেত, তিলের নাড়ু, চিনার নাড়ু, ঢ্যাপের নাড়ু, নারকেলের নাড়-, চিড়ার নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, কদমা-খাগড়াই, হাওয়াই মিঠাইসহ মজার মজার দারুণ সব ছেলেভোলানো খাবার। ছাঁচে তৈরি মিষ্টান্নের মধ্যে ছিল গজা, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি, আম, কাঁঠাল, প্রার্থণালয় বা বসতবাড়ির আকৃতি, সন্দেশ চমচম।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' বিলুপ্তির আগে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে সব ধর্মের মানুষ অংশ নিত। ওই দিন প্রজারা ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে জমিদারের কাছারিতে যেত খাজনা-নজরানা দিতে। জমিদাররা নিজেদের প্রজাদের পান-সুপারি আর মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

অধ্যাপক মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে, ১৯২০ সাল পর্যন্ত জমিদার ও বড় বড় তালুকদারের কাছারিতে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠিত হত। এই প্রথা এখন না থাকলেও এর সমান্তরাল আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন এখনও হয়ে থাকে, আর সেটি হলো ‘হালখাতা’। এটি হচ্ছে নতুন বাংলা বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার এক আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। আর এই অনুষ্ঠানে বাংলা বছরের প্রথম দিনে গ্রামের ব্যবসায়ীরা নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আগত নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থীদের জলযোগে আপ্যায়ন করে থাকেন। তবে সেখানে থাকে মিষ্টির রসালো উপস্থিতি।

১১২ বছর আগে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের এক হালখাতা অনুষ্ঠানে অতিথিদের আপ্যায়নের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় কথাসাহিত্যিক দীনেন্দ্রনারায়ণ রায়ের ‘পল্লীচিত্র’ বইয়ে।

তাতে দেখা যায়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে আগত অতিথিদের জন্য এতটাই মিষ্টির প্রয়োজন হত যে দোকানসংলগ্ন স্থানেই চলতে থাকত মিষ্টি তৈরির কাজ।

দীনেন্দ্রবাবুর বর্ণনায়, ‘উনুন জ্বলিতেছে। তাহার উপর বৃহৎ কড়াইয়ে রসগোল্লার পাক চড়িয়াছে। একটা কুকুর অদূরে বসিয়া জিহ্বা বাহির করিয়া সন্দেশের দিকে চাহিয়া আছে।’

শুধু মিষ্টি তৈরির বর্ণনাই নয়, হালখাতার অনুষ্ঠানের জলযোগের তালিকা দিতেও ভুল করেনি তিনি, ‘রাত্রি অধিক হইলে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ চন্দ্রবাবুর দোকানে জলযোগ করিতে বসিলেন। বেলের শরবত, মুগের ডাল ভিজে, নোনা, পেঁপে, ডাব প্রভৃতি ফল-ফুলুরি হইতে লুচি, কচুরি, ছানা, ঘি কিছুই বাদ গেল না। এমনকি চন্দ্রবাবু যথেষ্ট আয়াস স্বীকারপূর্বক অল্প পরিমাণ পাকা আম-কাঁঠাল সংগ্রহ করিয়াছিলেন...।’

তবে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে হালখাতা অনুষ্ঠানে আপ্যায়নের মাত্রা কমে আসে।

পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের হালখাতা অনুষ্ঠানের এক বর্ণনা পাওয়া যায় সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহবুব আলমের এক লেখায়, ‘বর্ষবরণ নিয়ে সেই আধা-শহরে যে খুব মাতামাতি হতো, তা বলা চলে না। তবে বাজারের প্রায় সব দোকানেই বাংলা বছরের প্রথম দিনে হালখাতা হতো বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে; দোকানে অতিথি-অভ্যাগতদের মিষ্টিমুখ করানো হতো যত্ন নিয়ে। আর সেটিই ছিল আমাদের ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। অভিভাবকদের হাত ধরে আমরাও মাঝেমধ্যে সেই নিমন্ত্রণে হাজির হয়েছি; বড়দের মতো আমাদের প্লেটেও দেওয়া হয়েছে রসে ডুবডুব ধবধবে সাদা একটি বড় রাজভোগ, সঙ্গে কালিজিরা ছিটানো হালকা গেরুয়া রঙের একখানা নিমকি-মুচমুচে ভাজা, কর্পূর মেশানো ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি।’

এখন হয়তো হালখাতার অতিথিদের সেইভাবে অ্যাপায়ন করা হয় না। তবে বাঙালি ঐতিহ্যের একটা অংশ যে ধরে রাখা হয়েছে, সেটাই বা কম কিসে। তবে এটা তো সত্যি কথা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশাখের খাবারদাবারে পরিবর্তন আসছে এবং ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তন হবে। এর মধ্যেও যে বাঙালিয়ানা ধরে রাখার চেষ্টা থাকে, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

তথ্যসূত্র

# লোককৃতি বিচিত্রা, আতোয়ার রহমান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, জুন ১৯৯৯।

# বঙ্গজীবনের খন্ডচিত্র, মাহবুব আলম, কথা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭।

# হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, অবসর প্রকাশনা; ঢাকা; ২০০৬।

# ঢাকাই খাবার, সম্পাদনা: হাবিবা খাতুন ও হাফিজা খাতুন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০১০।

# বাংলা সন ও পঞ্জিকা এবং ইতিহাস চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, সম্পাদনা : শামসুজ্জামান খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১৪। # লোকসংস্কৃতি বিচেনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী, জুন ১৯৯৭। # ‘ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’, হাকীম হাবীবুর রহমান, ভাষান-র : মো. রেজাউল করিম, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৯৫। # সমতলের নৃ-গোষ্ঠীদের পহেলা বৈশাখ, সালেক খোকন, রঙিলা বৈশাখ ১৪২৩, কালের কণ্ঠ, ঢাকা।

লেখক পরিচিতি: তরুণ ইতিহাস গবেষক রিদওয়ান আক্রাম বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় পেশায় জড়িত। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন, ঢাকার কোচোয়ানরা কোথায়, ড’য়লির ঢাকা, ঘটনা সত্যি, ঢাকাই খাবার, ঢাকা কোষ (যৌথ)- বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত।