ফেইসবুক পেইজগুলোর বৈশাখী আয়োজন

নামিদামি ফ্যাশনঘরগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেইসবুকের ফ্যাশন পেইজগুলোও তাদের ভিন্নধর্মী ডিজাইনের সম্ভার সাজিয়েছে ফলোয়ার বা ক্রেতাদের জন্য।

ইরা ডি. কস্তাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2017, 02:00 PM
Updated : 10 April 2017, 08:23 AM

নকশার ভিন্নতা এবং ঘরে বসেই পোশাক কেনার সুবিধার সুবাদে অনেকেই এখন কেনাকাটার জন্য ফেইসবুক পেইজগুলোকে বেছে নিচ্ছেন।

মূলত নিজস্ব সৃজনশীল মনোভাব এবং ভিন্নধর্মী নকশার সুবাদে ফেইসবুকের এসব পেইজগুলো নিজেদের জন্য আলাদা স্থান তৈরি করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারীরাই মূলত তাদের নকশা শিল্পের এই ভিন্নতা তুলে ধরার জন্য ফেইসবুককে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শাড়ি, কামিজ, টপস, স্কার্ট এমনকি অলঙ্কারেও নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভা তুলে ধরেছেন এই নারীরা।

এমনই কিছু পেইজ তাদের বৈশাখী আয়োজন দিয়ে সাজিয়েছেন।

ব্যাড হ্যাবিট: দেশীয় সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রিক্সাচিত্র। আধুনিকতার ধারায় অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। একে ধরে রাখার লক্ষ্যে ফেইসবুক পেইজ ‘ব্যাড হ্যাবিট’ নতুনভাবে অলঙ্কার এবং পোশাকে রিক্সাচিত্রকে তুলে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রধান উদ্যোক্তা খন্দকার মহিউদ্দিন বলেন, “রিক্সা পেইন্ট আমাদের গর্ব। আমি এই শিল্পীদের মনে প্রাণে সম্মান করি। আমি চাই এই শিল্প বেঁচে থাক আজীবন। এবারের বৈশাখের গয়নায় রিক্সাশিল্পীদের তুলির ছোঁয়ায় পুরাতন সেই ফুল, লতা, পাখি অলঙ্করণ করা হয়েছে।”

ব্যাড হ্যাবিটের গয়নাগুলোর অলঙ্করণ করেছেন মাইনুদ্দিন আর্টসের শিল্পীরা।

দিশা’স রোড ব্লকস-রঙের মানুষ।

দিশা’স রোড ব্লকস-রঙের মানুষ:
‘বাসা থেকে হাত খরচের টাকা নিব না’ এই মানসিকতা থেকেই কলেজে পা দেওয়ার পরই প্রথমে মেহেদী দেওয়ার কাজ শুরু করেন পেইজটির উদ্যোক্তা সায়কা সাহরিন। এরপর ২০০৩ সালে ফেইসবুকের চল এলে সেখানেই গ্রুপ খুলে মেহেদির দেওয়ার বিষয়টি প্রচার শুরু হয়।

সায়কা সাহরিন বলেন, “মেহেদি নিয়ে কাজ করার সময় বন্ধুরা আমাকে নিয়েই কেনাকাটা করতে যেত। তাদের পোশাকের নকশা বা কোন কাপড়ের সঙ্গে কোনটা ভালো লাগবে এমন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তারা সবসময়ই আমার পরামর্শ নিত। আর আমার এই কাজগুলো করতে ভালোও লাগতো। তাই এর থেকে একদিন মনে হল, এই পছন্দের জায়গাটিকে কাজে লাগানো যায়। তাই আমার পেইজের যাত্রা শুরু।”

দিশা আরও বলেন, “প্রথম দিকে নিউ মার্কেটে গিয়ে নিজস্ব ব্লকের নকশা দিয়ে কাজ করাতাম। কিন্তু সেখানে নিজস্বতা বলে কিছু থাকত না। কারণ যে কেউ চাইলেই তা অনুকরণ করতে পারত। আর সে কারণেই নিজের আলাদা ব্লক তৈরি করার তাগিদ অনুভব করি।”

২০১১ সালে প্রথম নিজস্ব ডিজাইনের ব্লক নিয়ে কাজ শুরু করেন সায়কা শাহরিন। ক্যামেরা, পেঁচা, কাক এমন সব ভিন্নধর্মী নকশাগুলো ব্লকে তুলে আনেন তিনি।

“আমি চেষ্টা করেছি ভিন্নধর্মী নকশা তুলে আনার। যখন প্রথম ব্লকগুলো তৈরি করতে দেই তখন কারিগররাও অনেক হাসাহাসি করছিলো, যে আপু এইগুলা কারা পরবে। কিন্তু আমি আশাবাদী ছিলাম।”

প্রতি তিনমাস পরপর নকশায় পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেন সায়কা সাহরিন। এবারের বৈশাখী আয়জনে দিশা’স রোড ব্লকের নকশায় স্থান করে নিয়েছে প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন। আয়োজনে প্রাধান্য পাচ্ছে দুই পার্টের র‌্যাপ। এছাড়াও আছে শাড়ি এবং ফতুয়া।

অলকানন্দা।

অলকানন্দা:
রেহনুমা রহমান এবং তানজীবা চৌধুরী নওরিন, ব্র্যাক এনজিও’র দুই গবেষক। অনেকটা নিজেদের আগ্রহ আর শখ থেকেই অলকানন্দা পেইজের কাজ শুরু করেন। তাদের এই যাত্রা নিয়ে কথা বলেন রেহনুমা রহমান।

রেহনুমা বলেন, “আমি এবং আমার সহকর্মী নওরীন আমরা দু’জনই শাড়ি পরতে খুব পছন্দ করি। আগে দুজন মিলে বিভিন্ন মেলায় যেতাম, ঘুরতাম, শাড়ি কিনতাম। এভাবেই একদিন আমাদের মনে হলো শাড়ি নিয়েই কিছু একটা করার। তাই দুইজনে সময় বের করে সিরাজগঞ্জে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে হ্যান্ডলুম, পাওয়ার লুম দুই মাধ্যমেই শাড়ি তৈরি করার পুরো পদ্ধতি দেখে আসা। তো এরপর ২০১৬ এর বৈশাখের আগে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রথমে আমরা শুধু রং নিয়ে কাজ করলাম। একরঙা শাড়ি, ভিন্ন রংয়ের পাড় এমন। প্রথমবারই আমরা ভালো সাড়া পাই, আর সেখান থেকে আমাদের কাজ করার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।”

প্রথমে শুধু রং নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরে স্ক্রিন প্রিন্টের মাধ্যমে নানান ধরনের নকশা ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন এই দুই সহকর্মী। পাওয়ার লুমের পর হ্যান্ড লুমকেও মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন তারা।

রেহনুমা বলেন, “আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে শাড়ি একটি আনুষ্ঠানিক পোশাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণে তারা কাতান, জামদানি বা এই ধরনের দামি শাড়িগুলোর প্রতিই বেশি আগ্রহী। এ কারণে তাদের কাছে আমরা সাধারণ তাঁতে তৈরি নরম শাড়িগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যেন তারা শাড়ি পরার ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই ধারায় শাড়িতে ভিন্ন ধরনের নকশা করারও একটি তাগিদ অনুভব করি। এ কারণেই প্রথমে আমরা ইতিহাসের দুটি প্রভাবশালী নারী চরিত্র নেফরতিতি এবং এরপর নূরজাহানকে শাড়িতে ফুটিয়ে তুলি।”

তিনি জানান তারা শাড়ির নকশার অনুপ্রেরণা পান তিনভাবে। একটি হল ঐতিহাসিক নারী চরিত্র, ভ্রমণ এবং অন্যটি ‘যা খুশি তাই’। অলকান্দার এবারের বৈশাখী আয়োজনে স্থান করে নিয়েছে আফ্রিকান মোটিফ, আমাদের শহর, পটচিত্র, ড্রিম ক্যাচার। পাশাপাশি নূরজাহান এবং নেফরতিতি তো থাকছেই। প্রতিটি শাড়িতেই নকশা ফুটিয়ে তোলা হয় স্ক্রিন প্রিন্টের মাধ্যমে।

অলকানন্দার শাড়ির দাম ১ হাজার ৮শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে। স্ক্রিন প্রিন্টের ওড়নাও রয়েছে এবারের আয়োজনে। দাম পাঁচশ থেকে ১ হাজার টাকা।

ওয়্যারহাউজ।

ওয়্যারহাউজ:
তাসনিম ফেরদৌস, পেশায় একজন স্থপতি। তবে ছোটবেলা থেকেই সেলাইয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল তার। এ কারণে পেশাগত কাজের পাশাপাশি শখের বসে পোশাকে মন মতো নকশাগুলো ফুটিয়ে তুলছেন ব্লকের মাধ্যমে। ফুল, লতাপাতা বা আলপোনার নকশার গণ্ডি পেরিয়ে ব্লকের ছাপে তুলে এনেছেন ডুডল আর্ট।

তাসনিম বলেন, “ওয়্যারহাউজের যাত্রার শুরুতে আমি মসলিন শাড়ি নিয়ে কাজ করেছিলাম। কিন্তু মসলিন বেশ দামি একটি শাড়ি তাই অনেকেরই নাগালের বাইরে। তাই আমি ভাবলাম এমন কিছু নিয়ে কাজ করব যা সব শ্রেণীর নারীরাই কিনতে পারবে। এরপর মনে হল এমনকিছু নকশা নিয়ে কাজ করবো যা অন্যদের থেকে আলাদা। এ কারণেই আশপাশের সাধারণ জিনিসগুলো বেছে নিলাম নকশার মাধ্যম হিসেবে। যেমন- ট্রাফিক লাইট, পেপার ক্লিপ, বেবি টেক্সি, ট্রাক, ডিম পোচ, আনারস, পেঁচা।

এবারের বৈশাখী আয়োজনে তানসিম লাল সাদার বদলে বিভিন্ন রং বেছে নিয়েছেন। কমলা, হলুদ, মেজেন্ডা, নীল ইত্যাদি রং প্রাধান্য পেয়েছে ওয়্যারহাউজের বৈশাখী আয়োজনে।

বুবুর বায়না।

বুবুর বায়না:
দীর্ঘদিন মিডিয়ায় কাজ করার পর নিজের মতো করে কিছু করার তাগিদেই ‘বুবুর বায়না’ পেইজটির যাত্রা শুরু বলে জানান নাঈমা মিতা। গত বছর মে মাসে প্রথম যাত্রা শুরু করে বুবুর বায়না।

শুরুতে টাঙ্গাইল থেকে আনানো শাড়িগুলোই মূলত পেইজে স্থান পায়। এরপর স্ক্রিন প্রিন্ট। পেঁচা, গুবরে পোকা, ট্রাইবাল মোটিফ ইত্যাদি নকশা ফুটে ওঠে নকশায়। শাড়ির পাশাপাশি গজ কাপড়ও রয়েছে।

এবারের বৈশাখী আয়োজনে উজ্জ্বল রংগুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছেন নাঈমা মিতা। নকশায় স্থান করে নিয়েছে ময়ূর, মাছ, নাচের মোটিফ ইত্যাদি। ‘বুবুর বায়না’র কাপড়ের দাম প্রতি গজ ২৭৫ টাকা এবং শাড়ির দাম ২ হাজার থেকে আড়াই হাজারের মধ্যে।

ত্রিনিত্রি: চারুকলায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে ঘরেই প্রতিভা কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছেন ফার্মাসির শিক্ষার্থী অন্বেষা দত্ত। ছবি আঁকার আগ্রহ থেকে নতুন কিছু করার কথা মাথায় আসে তার আর এভাবেই তিনিত্রি পেইজটির যাত্রা শুরু।

চট্টগ্রাম থেকে কাজ করেন অন্বেষা। তাই তাকে আগেই টাকা বিকাশ করে দিলে এরপর কুরিয়ারের মাধ্যমে পণ্য পাঠিয়ে দেন গ্রাহকের ঠিকানায়।

ত্রিনিত্রি।

মূলত অলঙ্কার নিয়েই কাজ করেন তিনি। কাঠ বা প্লাই উডের ফ্রেম তৈরি করে তাতে মনের রং ঢেলে গয়না তৈরি করেন। রয়েছে গলার লকেট, আংটি, নুপুর। পোশাকেও তার তুলির কাজ রয়েছে। তবে শুধুমাত্র চাহিদার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় বলে জানান অন্বেষা।

পছন্দের বিষয় বলে দিলে বা কেমন ছবি চান তা জানিয়ে দিলে অন্বেষা তা কাপড়ে আঁকার দায়িত্ব নেন। এক্ষেত্রে প্রথমে কাপড়ের দাম অগ্রিম বিকাশ করতে হয়।

ছবি আঁকা ছাড়াও বাইরে থেকে আনানো অনুষঙ্গের সঙ্গে কিছুটা নিজস্বতা মিশিয়ে গয়না তৈরি করেন অন্বেষা। ত্রিনিত্রি’র নিজস্ব গয়নার দাম আড়াইশ থেকে সাড়ে পাঁচশ টাকা। পোশাকে ছবি আঁকাতে চাইলে খরচ হবে ২ হাজার টাকার মতো।