থানচির পথ পেরোতে পেরোতে মনে হচ্ছিল এই যেন অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের হাতছানি। বাসের ছাদ সেই রোমাঞ্চ ছোঁয়ার প্রধান অবলম্বন। পাহাড় পেরিয়ে পথের দুপাশে ছড়িয়ে আছে বুনোফুলে সাজানো বাগানবাড়ি। সবুজ পাহাড় লাল-হলুদ ফুলে আচ্ছন্ন।
বাস ছুটছে উঁচু-নিচু পাহাড়ের পথ ধরে। এ যেন আকাশের পথ ধরে চলছে। দিগন্ত রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো নীলাভ রং নিয়ে জেগে আছে বহুকাল ধরে। দূরের পাহাড়গুলোর সবুজের চেয়ে নীল রংয়ে বেশি শোভা পায়। রাস্তার দুধারে চেনা গ্রাম পেরিয়ে চিম্বুক, নীলগিরি, জীবননগরের দীর্ঘ পাহাড় বেয়ে বলিপাড়া ক্যাম্পে স্বল্প চা বিরতি। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক পর্ব শেষ করে, মধ্য দুপুরে বাস পৌঁছায় থানচি বাজারে।
সাঙ্গুর স্রোত বয়ে গেছে বাজারের পাশ ঘেঁষে। নদী আর পাহাড় এখানকার একসঙ্গে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে প্রাগতৈহাসিক কালের সাক্ষী হয়ে। সাঙ্গুর তীরে গড়ে উঠেছে থানচি বাজার, জনপদ, পাড়া্ আর অরণ্যতো আছেই।
বাজারে নেমে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে চললাম থানচি বাজারের ঘাটের দিকে। এই অভিযানে সদস্য সংখ্যা ৩৪ জন।
দুপুরে থানচি বাজারে উদরপূর্তি করে, যাত্রা করলাম দেশি-বোটে করে। সাঙ্গুর পথ ধরে, প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতে ইঞ্জিনের খটখট শব্দে নিরবতা ভেঙে এগিয়ে চলেছে দেশি ইঞ্জিন নৌকা।
নদীর পাড়ে পাহাড়ি গ্রাম। থানচি থেকে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে চোখে পড়ে তিন্দু বাজার। বাজারের ঘাটে কিছুক্ষণের বিরতি। নদী আর পাহাড়ের সঙ্গেই জীবন চলে তিন্দুর মানুষের।
ছোট ছিমছাম তিন্দু বাজার। সবুজ পাহাড় যেন আগলে রেখেছে নিস্বর্গের গ্রাম- তিন্দুকে। তিন্দুর সামনে বয়ে খরস্রোতা সাঙ্গুর বারবার আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে। তিন্দু থেকে বিকেলে দিকে যাত্রা করলাম রেমাক্রির পথে।
বর্ষা কিংবা অন্য যেকোনা সময় তীব্র স্রোতেও অবিচল থেকেছে রাজা পাথর, রানী পাথরসহ অসংখ্য ছোট-বড় পাথর খণ্ড। পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া সূর্যের আলোক-ছটা নদীর বুকে। জলের পথ ধরে নৌকা এগুতে থাকল রেমাক্রির পথে।
আঁকাবাঁকা রৌদ্রোজ্জ্বল পানিপথে কোথাও কোথাও তীব্র স্রোত। তাই বিপদ এড়াতে কিছু জায়গা হেঁটেই যেতে হচ্ছে।
এই জনপথ মিশেছে দুর্গম পাহাড়ে। পাহাড়ের অবিন্যাস্ত ঝিরি এসে মিলেছে সাঙ্গুর তীব্র স্রোতে। সাঙ্গুর পথে চলতে চলতে গোধূলি বেলায় নৌকা থামে রেমাক্রি বাজারের ঘাটে। রাতে রেমাক্রি বাজারে রাতযাপন।
চাঁদের আলো দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়াকে স্পষ্ট করেছে। এই যেন গৃহত্যাগী জোছনা নেমেছে পাহাড়ের পৃথিবীতে। নদী, পাহাড় ঘেরা এই জনপদ নাগরিক জীবন থেকে মুক্ত ষোলআনা প্রকৃতির স্বাদ-গন্ধে ভরপুর। পোড়া কাঠের আগুন জ্বলছে সাঙ্গুর তীরে।
খালের হাঁটু সমান জলে, স্রোত পেরিয়ে, কখনও খালের পার ধরে এগুতে থাকল। সবাই মাঝপথে চা পর্ব শেষ করে আবার যাত্রা করলাম।
সব ছাপিয়ে নাফাখুম- যেন এই অরণ্যভুমি সুন্দরতম জলস্রোত। অরণ্য ঘেরা এই জলধারা পেছনে রেখে বিকেলের শেষ্ আলোয় ফেরার পথ ধরল অভিযাত্রীর দল।
চট্টগ্রাম থেকে পূরবী ও পূরনী বাস প্রতি ৪০ মিনিট পর পর যাতায়াত করে। বান্দরবান থেকে রিজার্ভ চাঁন্দের গাড়ি কিংবা লোকাল বাসে করে থানচি পৌঁছাতে হবে।
থানচি থেকে বিজিবি'র অনুমতি নিয়ে নিবন্ধনকৃত গাইড নিয়ে যেতে হবে রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত। রেমাক্রি থেকে পুনরায় গাইড নিয়ে ট্রেকিং করে নাফাখুম পৌঁছাতে পারবেন।
রেমাক্রিতে রাতে থাকার জন্য পাহাড়ি কটেজে ঢালা বিছানায় থাকতে হবে।
ট্রেকিয়ের জন্য স্বল্প দামে রাবার বা প্ল্যাস্টিকের জুতা পাওয়া যায় যা থানচি বাজার থেকে কিনে নিতে পারেন। কেডস বা সু অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন।
মশার কামড় থেকে রক্ষার জন্য কীটপতঙ্গ দূর করার ক্রিম সঙ্গে নেবেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। দুর্গম পাহাড়ে যাবেন না।
ছবি: সমির মল্লিক ও জীবন চৌধুরী।