বসন্তের হাওয়ায় নাফাখুম

উত্তেজনায় ভরপুর আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদ আর পাহাড়ি ফুলের সৌরভ নিতে চাইলে এই মৌসুমে ঘুরে আসুন বান্দারবানের এই জলধারা থেকে।

সমির মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2017, 11:31 AM
Updated : 24 Feb 2017, 11:31 AM

থানচির পথ পেরোতে পেরোতে মনে হচ্ছিল এই যেন অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের হাতছানি। বাসের ছাদ সেই রোমাঞ্চ ছোঁয়ার প্রধান অবলম্বন। পাহাড় পেরিয়ে পথের দুপাশে ছড়িয়ে আছে বুনোফুলে সাজানো বাগানবাড়ি। সবুজ পাহাড় লাল-হলুদ ফুলে আচ্ছন্ন।

বাস ছুটছে উঁচু-নিচু পাহাড়ের পথ ধরে। এ যেন আকাশের পথ ধরে চলছে। দিগন্ত রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো নীলাভ রং নিয়ে জেগে আছে বহুকাল ধরে। দূরের পাহাড়গুলোর সবুজের চেয়ে নীল রংয়ে বেশি শোভা পায়। রাস্তার দুধারে চেনা গ্রাম পেরিয়ে চিম্বুক, নীলগিরি, জীবননগরের দীর্ঘ পাহাড় বেয়ে বলিপাড়া ক্যাম্পে স্বল্প চা বিরতি। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক পর্ব শেষ করে, মধ্য দুপুরে বাস পৌঁছায় থানচি বাজারে।

সাঙ্গুর স্রোত বয়ে গেছে বাজারের পাশ ঘেঁষে। নদী আর পাহাড় এখানকার একসঙ্গে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে প্রাগতৈহাসিক কালের সাক্ষী হয়ে। সাঙ্গুর তীরে গড়ে উঠেছে থানচি বাজার, জনপদ, পাড়া্ আর অরণ্যতো আছেই।

বাজারে নেমে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে চললাম থানচি বাজারের ঘাটের দিকে। এই অভিযানে সদস্য সংখ্যা ৩৪ জন।

দুপুরে থানচি বাজারে উদরপূর্তি করে, যাত্রা করলাম দেশি-বোটে করে। সাঙ্গুর পথ ধরে, প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতে ইঞ্জিনের খটখট শব্দে নিরবতা ভেঙে এগিয়ে চলেছে দেশি ইঞ্জিন নৌকা।

সাঙ্গুর দুপার ঘেঁষে সবুজ বন। আর জেগে ওঠা বালুর চরে বাদামের ক্ষেত। সবুজ মখমলে ভর করে আছে সাঙ্গুর ডানায়। স্বচ্ছ পানি আর ছোট-বড় পাথর যেন এই সাঙ্গুর প্রাণ। আর সাঙ্গু টিকিয়ে রেখেছে এই পুরো জনপদ।

নদীর পাড়ে পাহাড়ি গ্রাম। থানচি থেকে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে চোখে পড়ে তিন্দু বাজার। বাজারের ঘাটে কিছুক্ষণের বিরতি। নদী আর পাহাড়ের সঙ্গেই জীবন চলে তিন্দুর মানুষের।

ছোট ছিমছাম তিন্দু বাজার। সবুজ পাহাড় যেন আগলে রেখেছে নিস্বর্গের গ্রাম- তিন্দুকে। তিন্দুর সামনে বয়ে খরস্রোতা সাঙ্গুর বারবার আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে। তিন্দু থেকে বিকেলে দিকে যাত্রা করলাম রেমাক্রির পথে।

কিছু পথ পেরিয়ে রাজাপথ, বিশাল বিশাল পাথরখণ্ড। যুগের পর যুগ জেগে আছে সাঙ্গুর বুকে।

বর্ষা কিংবা অন্য যেকোনা সময় তীব্র স্রোতেও অবিচল থেকেছে রাজা পাথর, রানী পাথরসহ অসংখ্য ছোট-বড় পাথর খণ্ড। পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া সূর্যের আলোক-ছটা নদীর বুকে। জলের পথ ধরে নৌকা এগুতে থাকল রেমাক্রির পথে।

আঁকাবাঁকা রৌদ্রোজ্জ্বল পানিপথে কোথাও কোথাও তীব্র স্রোত। তাই বিপদ এড়াতে কিছু জায়গা হেঁটেই যেতে হচ্ছে।

পথের দুপাশে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পথ মিলছে নদীর তীরে। নদীতে ছিপ ফেলে মাছ শিকারে অপেক্ষায় পাহাড়ি তরুণ। শীত হওয়ায় স্বচ্ছ জলে অনেকেই স্থানীয় সনাতনী পদ্ধতিতে ধারালো লোহার শিক দিয়ে মাছ শিকার করে। 

এই জনপথ মিশেছে দুর্গম পাহাড়ে। পাহাড়ের অবিন্যাস্ত ঝিরি এসে মিলেছে সাঙ্গুর তীব্র স্রোতে। সাঙ্গুর পথে চলতে চলতে গোধূলি বেলায় নৌকা থামে রেমাক্রি বাজারের ঘাটে। রাতে রেমাক্রি বাজারে রাতযাপন।

পাহাড়ের উপর রেমাক্রি বাজার। রাত হতেই এই জনপদ জুড়ে নেমেছে জোছনার দল। পাহাড় পেরিয়ে চাঁদের আলো ছুঁয়েছে নদীর জল। পাহাড়ের বুকে জেগে থাকা জোছনা ক্রমশ ভরিয়ে দিচ্ছে পুরো লোকালয়। রেমাক্রি খালে বিরামহীন কলকল ধ্বনি মিশে যাচ্ছে সাঙ্গুর জলে, জলের শব্দমালা অদ্ভুত শোনাচ্ছিল নীরব-শব্দহীন অরণ্য ঘেরা জনপথে।

চাঁদের আলো দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়াকে স্পষ্ট করেছে। এই যেন গৃহত্যাগী জোছনা নেমেছে পাহাড়ের পৃথিবীতে। নদী, পাহাড় ঘেরা এই জনপদ নাগরিক জীবন থেকে মুক্ত ষোলআনা প্রকৃতির স্বাদ-গন্ধে ভরপুর। পোড়া কাঠের আগুন জ্বলছে সাঙ্গুর তীরে।

রাত পেরিয়ে ভোর চারপাশে কুয়াশার রাজত্ব। সকালে শীতল আলোয় যাত্রা হল নাফাখুমের পথে। অরণ্য পেরিয়ে কেবল সূর্যের আলো প্রবেশ করছে ভোরের পৃথিবীতে। জল-ঘাসে তখনও শিশিরে মাখামাখি। খালের পাশ ধরে এগোচ্ছো অভিযাত্রীর দল।

খালের হাঁটু সমান জলে, স্রোত পেরিয়ে, কখনও খালের পার ধরে এগুতে থাকল। সবাই মাঝপথে চা পর্ব শেষ করে আবার যাত্রা করলাম।

সবুজ-স্বচ্ছ জলরং পেরিয়ে পা ফেলছি নাফাখুমের পথে। পথের শেষে অবশেষে পাহাড়-পাথুরের খাল পেরিয়ে নেমে আসছে নাফাখুমের জলধারা। বিশাল ক্যাসকেড থেকে বিরামহীনভাবে নেমে আসছে দুধ-সাদা জলের ধারা। পাহাড়ের বহু দীর্ঘপথ পেরিয়ে এই জলের ধারা মিশেছে সাঙ্গুতে। অরণ্যের দীর্ঘপথে জেগে আছে চেনা-অচেনা বহু ঝরনা, জলপ্রপাত, ঝিরি, বুনোমাখা পথ, খরস্রোতা খাল।

সব ছাপিয়ে নাফাখুম- যেন এই অরণ্যভুমি সুন্দরতম জলস্রোত। অরণ্য ঘেরা এই জলধারা পেছনে রেখে বিকেলের শেষ্ আলোয় ফেরার পথ ধরল অভিযাত্রীর দল।

প্রয়োজনীয় তথ্য:
ঢাকা থেকে এসি/ ননএসি সরাসরি বান্দরবানে বাস যায়। শ্যামলী, এস.আলম, সৌদিয়া, ঈগল, হানিফ, ডলফিনসহ বিভিন্ন পরিহন সংস্থার বাস ঢাকা থেকে বান্দরবান যাতায়াত করে।

চট্টগ্রাম থেকে পূরবী ও পূরনী বাস প্রতি ৪০ মিনিট পর পর যাতায়াত করে। বান্দরবান থেকে রিজার্ভ চাঁন্দের গাড়ি কিংবা লোকাল বাসে করে থানচি পৌঁছাতে হবে।

থানচি থেকে বিজিবি'র অনুমতি নিয়ে নিবন্ধনকৃত গাইড নিয়ে যেতে হবে রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত। রেমাক্রি থেকে পুনরায় গাইড নিয়ে ট্রেকিং করে নাফাখুম পৌঁছাতে পারবেন।

রেমাক্রিতে রাতে থাকার জন্য পাহাড়ি কটেজে ঢালা বিছানায় থাকতে হবে।

সাবধানতা:
সাঙ্গুর তীব্র স্রোত বেয়ে নৌকায় করে রেমাক্রি পর্যন্ত যেতে হয়। নৌকার চালক দক্ষ না হলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। সম্ভব হলে নদী পথে লাইফ জ্যাকেট নিতে পারেন, থানচিতে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া পাওয়া যায়।

ট্রেকিয়ের জন্য স্বল্প দামে রাবার বা প্ল্যাস্টিকের জুতা পাওয়া যায় যা থানচি বাজার থেকে কিনে নিতে পারেন। কেডস বা সু অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন।

মশার কামড় থেকে রক্ষার জন্য কীটপতঙ্গ দূর করার ক্রিম সঙ্গে নেবেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখবেন। দুর্গম পাহাড়ে যাবেন না।

নাফাখুম যাওয়ার পথ বর্ষায় বেশ পিচ্ছিল হয়। পাহাড়ি পথে হাঁটার সময় সাবধান হবেন। নাফাখুম ভ্রমণে যে কোনো সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫-৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।

ছবি: সমির মল্লিক ও জীবন চৌধুরী।