বিমুগ্ধ কাপ্তাই লেক

ফুরোমনের চূড়া থেকে পাখির চোখে মতো দেখা যায় কাপ্তাই লেকের বিস্তৃত জলরাশি। বছরের এই সময়ে নীল জলরাশির কাপ্তাই লেক, স্বচ্ছ নীলাভ জল আর বিস্তৃত দেখে মনে হতে পারে পাহাড়ের মধ্যে সমুদ্রের তীরের পৌঁছে গেছি।

সমির মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2017, 12:04 PM
Updated : 17 Feb 2017, 12:04 PM

বসন্তের বাতাস ছুঁয়ে আছে লেকের নীল জল, পাহাড় পেরিয়ে কাছে-দূরে কেবল নীল জলরাশি। জলরাশির মধ্যভাগে জেগে আছে ছোট ছোট সবুজ দ্বীপ।

ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ছুটে চলছে জলের বুকে। আর দূরে যাত্রী বোঝাই করা দোতলা কাঠের লঞ্চ।

হরিনা, জুরিছড়ি, মাইনী, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি পথে ছুটছে পাহাড়ের মানুষ। ৭২৫ বর্গকিলোমিটারের কাপ্তাই ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের নানা প্রান্তে। জলযোগে যাওয়া যায় রাঙামাটি সর্বপ্রান্তে।

এমন নীল জলরাশি আর পাহাড় ছুঁয়ে থাকা জনপথ বিলাইছড়ি। কাপ্তাইয়ে জেটি ঘাট থেকে দেশি বোটে রওনা হতে পারেন বিলাইছড়ি পথে। পথের শুরুতে কাপ্তাই বাঁধ চোখে পড়বে, সামনের দিকে হাতছানি দিচ্ছে বিস্তৃতি জলাধার, দুপাশে সবুজ পাহাড় ছুঁয়ে চলছে নৌকা।

সামনে যেতে যেতে চোখে পড়বে মাছ ধরে ঘরে ফেরা মানুষ, ছোট ছোট টিলায় মানু্ষের বসতি। সাধারণত লেকের পাড়ে আদিবাসীদের বসবাস এ অঞ্চলে। পাহাড়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা জুমঘরগু্লো সাজানো চিত্রপটের মতো।

জুমঘরে ফসল তোলার সময় এখন, পথে কেঙড়াছড়ি বাজার স্বল্প সময়ের বিরতি, পাহাড়ের উপর ছোট বাজার মূলত মৎসপেশাজীবীদের আনাগোনা। চা পর্ব শেষ করে বোট চলল বিলাইছড়ি বাজারে দিকে, স্বচ্ছ জলের নীচে সবুজ বন।

বিলাইছড়ি'র পথ পেরিয়ে বসন্তের নতুন দিনের সকালে স্নিগ্ধতা প্রকৃতিজুড়ে। পাতা ঝরা সময়ের পর্ব শেষ। পাহাড়-প্রকৃতি বৃক্ষরাজিতে নতুনের আগমন। কচিপাতায় ভর করে আছে গাছের শাখা-প্রশাখা। লংগদু ঘাটে পৌঁছাতে সকাল ৮টা।

কাপ্তাই লেকের সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়ে লংগদু-কাট্টলি বিল অংশে। সারা রাত ধরে ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরে। সকালে ঘাটে বহু রকমের মাছের পসরা নিয়ে বসেছে জেলেরা।

পবদা, রুই, চিতল, বড় বোয়াল, শিং, মাগুর, চাপিলাসহ বহু রকমের তাজা মাছে সমাহার, দামও বেশ সস্তা।

লংগদু'র লঞ্চ ঘাটে গরু দুধের চা পাওয়া যায়। এর মধ্যে দূর থেকে সাইরেন বাজিয়ে সংকেত দিল রাঙামাটিগামী দিনের প্রথম লঞ্চ। বাঘাইছড়ি থেকে ছেড়ে আসা এই লঞ্চে প্রচুর যাত্রী। বেশিরভাগই স্থানীয়।

বাঘাইছড়ি-মাইনী এবং লংগদু অঞ্চলে সঙ্গে রাঙামাটির যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম হল পাকিস্তান আমলের কাঠের তৈরি দোতলা লঞ্চগুলো। লঞ্চের ছাদে নিজেদের জায়গা করে নিলাম। কিছুক্ষণের বিরতি শেষে লঞ্চ যাত্রা করল রাঙামাটির পথে।

লেকের ছোট ছোট মাছ ধরতে বসন্তের শুরুতেও এখানে পাখিদের ঝাঁক চোখে পড়ে। সারস, সাদা বক, পানকৌড়ির চলাচল পুরো লেক জুড়ে। আকাশের নীল ছায়ায় লেকের জল বেশ স্বচ্ছ। লেকের গভীর দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলছে আমাদের লঞ্চ।

লঞ্চের এবারের যাত্রামুখ রাঙামাটির রংরাং পাহাড়ের দিকে। রংরাং শব্দের অর্থ ধনেশ পাখি, একটা সময়ে কাপ্তাই লেক কেন্দ্রিক পাহাড়গুলোতে ধনেশ পাখির বিচরণ ছিল। এখনও গভীর পাহাড়ে মাঝে মধ্যে ধনেশ পাখির দেখা মেলে।

লঞ্চে লংগদু থেকে রংরাং যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। পুরোটা যাত্রা পথে প্রকৃতির সাজানো ল্যান্ডস্কেপ, অসংখ্যা ছোট ছোট দ্বীপে সাজানো কাট্টলি বিল বিস্তৃত জলরাশি।

কাট্টলি বিল বাজারের চারপাশে জলের সীমারেখা, বাজারের ঘাটে পাঁচ মিনিটের লঞ্চ বিরতি। সাপ্তাহিক বাজার হওয়ায় দূর-দূরান্তের বাসিন্দারা নৌকায় বোঝাই করে নিয়ে এসেছে নিজেদের চাষকৃত পণ্য।

দ্বীপের ছোট্ট বাজারের একপাশে শুটকি-পল্লী। কাট্টলি বাজার থেকে গরম জিলাপি কিনে আবার লঞ্চে এসে বসলাম।

রংরাং পাহাড়ে পথে ছুটে চলছে আমাদের লঞ্চ। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে জেলেরা। দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশের নিচে গভীর লেকে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকাগুলোকে বেশ অদ্ভুত লাগছিল।

ছোট-বড় দ্বীপ কোথাও কোনো লোকালয় চোখে পড়ছে না, মাঝে মাঝে কেবল বিচ্ছিন্ন বসতি।

কাপ্তাই লেকের নীল ঢেউ ছাপিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিলাম রংরাংয়ের পথে, দুপুর নাগাদ লঞ্চ নোঙর করে শুভলং বাজারে। শুভলং বাজারে কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে রাঙামাটির রংরাং পাহাড়। অনেকে একে টিএন্ডটি পাহাড় নামে চেনে। শুভলং ঘাটে নেমে দেরি না করে হাঁটা শুরু করলাম পাহাড়ের চূড়ার দিকে, পথ যেন শেষই হয় না।

সিঁড়ির পথে ছেড়ে সরু ট্রেক রুট ধরে এগুতে থাকলাম চূড়ার দিকে। সবুজে ঢাকা পথ ছুঁয়ে চলতে চলতে যেদিকে চোখ পড়ে কেবল বড় বড় বৃক্ষরাজি, পাহাড়ের সরু পথ বেয়ে উপরে উঠতেই চোখ পড়ে নিচে দিকে, রংরাং পাহাড় থেকে দেখা কাপ্তাই লেক বড়ই অন্যন্য।

প্রয়োজনীয় তথ্য:
কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ দুটো পথে করা যায়। কাপ্তাই জেটি হয়ে রাঙামাটি জেলা সদর হয়ে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য আছে দেশি বোট এবং কাঠের তৈরি লঞ্চ।

ভাড়া বোট বা নৌকা ভেদে পার্থক্য রয়েছে। ছোট-মাঝারি প্রতি ঘণ্টা ১৫০ টাকা।

রাঙামাটিতে রাতের থাকার জন্য আছে পর্যটন মোটেল, অরণ্যক রির্সোট, হোটেল প্রিন্স, হোটেল সুফিয়া। 

দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য কাপ্তাই লেকে মাঝখানে ছোট ছোট দ্বীপে কয়েকটি রেস্তোরাঁ আছে। এছাড়া বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮১৫৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।