বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের পাঠক লায়লা আরজুমান্দ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন শান্তিনিকেতনে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
আলতো পায়ে শীত যখন একটু একটু করে চলে যেতে শুরু করেছে তখন গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতন।
আমি গিয়েছিলাম জানুয়ারির শেষ দিকে। ঝরে পড়া শিশিরের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা, বকুলবীথি, আম্রকুঞ্জ, ঘণ্টাতলা, নতুন বাড়ি, কালোবাড়ি, সিংহ সদন, শান্তিনিকেতন ভবন, কাচের মন্দির ইত্যাদির সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিলাম অন্য এক ভুবনে। এই সময়ে শান্তিনিকেতনের হিমেল বাতাস দেয় অনাবিল এক প্রশান্তি।
এই সময়ে শান্তিনিকেতনের খোয়াই বনের ফাঁকফোকড় গলিয়ে পড়ে কুয়াশা। বিকেল হতেই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিতে শুরু করে পুরো শান্তিনিতেকন। লাল মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তখন গানটা মনে পড়ে.. ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ...’
সেখান থেকে রিকশা বা ব্যাটারি চালিত অটোয় চেপে ১০ মিনিটে শান্তিনিকেতন। হোটেলে গিয়ে ব্যাগ রেখে স্থানীয় এক গাইড নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হোটেলগুলো কাছেই।
শান্তিনিকেতন ভবন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে শান্তিনিকেতন ভবনটি তৈরি করেন। ভবনটি তৈরি করা হয় চুন সুড়কি দিয়ে।
আমাদের স্থানীয় গাইড লক্ষণ জানালেন, দেবেন্দ্রনাথ তিনটি স্ট্রাকচারে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ভবনটি একেকদিক থেকে দেখলে একেক রকম মনে হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো। একদিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছে মন্দির, অন্য দিক থেকে দেখলে মসজিদ, আরেক দিক থেকে দেখলে গির্জা। (কেউ কেউ অবশ্য বলল পাঁচটা ধর্মের স্ট্রাকচারে বাড়িটি করা।)
যে ভাস্কর্যে ফুটে উঠে মা ও শিশু
এই ভবনটির সামনে আছে একটি পাথরের মূর্তি। মজার বিষয় হচ্ছে এই মূর্তিকে যে দিক থেকেই দেখুননা কেনো, কিছুই বুঝতে পারবেন না। বুঝবেন কখন? দুপুরের যে রোদ সোজা আমাদের মাথায় পড়ে সে রোদের ছায়ায় দেখা যাবে এর কারিশমা।
ভারতীয় সাঁওতাল ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ তৈরি করেন এই মূর্তি।
কাচের মন্দির
রঙিনকাচের নকশা দিয়ে মন্দিরটি খুব সুন্দর ভাবে তৈরি। বেলজিয়ামের কাচ আর মার্বেল পাথরের এই মন্দির ১৮৯২ সালে উদ্বোধন হয়। প্রতি বুধবার সকালে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে এই মন্দিরে উপাসনা করা হয়।
গাছের নিচে যে জায়গাগুলো দেখা যাচ্ছে এইগুলো সব ক্লাশ রুম। এখানে ক্লাশ হয়। গাছের তলায় যে বেদীগুলো দেখা যাচ্ছে তাতে বসেই চলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম। এই জায়গাটা নাম হচ্ছে বকুল বীথি।
চট করে বসে পড়লাম এক মুহূর্তের জন্য। মনে হল কেনো আমি এখানে পড়তে আসলাম না। কিংবা কেনো পাঠানো হয়নি এমন জায়গায় পড়তে। যেখানে প্রকৃতি দুই হাতে ঢেলে দেয় তার সমস্ত সুধা।
এটা হচ্ছে শান্তিনিকেতনের মূল জায়গা। ছাতিম তলা। এখান থেকেই শান্তিনিকেতনের সৃষ্টি। বর্তমানে জায়গাটিতে ঘেরা রয়েছে। এখানে সবার প্রবেশ নিষেধ। বছরে মাত্র দুইবার খোলা হয় এই ছাতিম তলা।
গাইড লক্ষণ শোনাল এটার এক মজার কাহিনি।
জায়গাটির আগে নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। রায়পুরের জমিদার ভুবন মোহন সিংহের নামানুসারে ছিল এই নাম।
এক নিমন্ত্রণ রক্ষায় পালকিতে করে ভুবনডাঙ্গা যাওয়ার পথে এই ছাতিম তলায় বিশ্রাম নেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে বিশ্রাম নিয়ে তিনি পেয়েছিলেন মনের শান্তি।
জমিদার ভুবন সিংহ জানান, দুই চোখ যতটুকু যায় ততটুকু ব্রাহ্ম সমাজের জন্য দান করলেন তিনি।
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ বিনা পয়সায় জমি নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে কোলকাতার আলীপুর কোর্টে গিয়ে এক টাকায় কুড়ি বিঘে জমি রেজিস্ট্রি করেন।
পরে তিনি জমিদার বাবুকে নিয়ে দুটি লাইন লিখেছিলেন, “তিনি আমার প্রাণের আরাম মনের আনন্দ আত্মার শান্তি।” তারপর এই জায়গার নাম দিলেন শান্তিনিকেতন।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই ছাতিম তলায় পাঠদান শুরু করেন। যার নাম দেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। পরে ছাতিম গাছ দুটো মরে গেলে সেখানে আবার লাগানো হয় নতুন ছাতিম গাছ।
কালো বাড়ি
এরপরেই দেখলাম কালো বাড়ি। মাটির তৈরি, দেয়ালে রয়েছে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের বিভিন্ন কারুকাজ। রবিঠাকুরের সহজপাঠে রয়েছে দেয়ালের সেইসব চিত্র। যেমন, তিনটে শালিক ঝগড়া করে/রান্নাঘরের চালে, অমল ও দইওয়ালা ইত্যাদি।
দেখতে দেখতে হঠাৎ ডাক শুনলাম, দই, দই ভালো দই। রাবড়ি..। অমল ও দইওয়ালার চিত্র দেখতে দেখতে মাটির হাঁড়ির সেই দইও চেখে দেখলাম। শান্তিনিকেতনের শান্তির জন্যই কিনা কে জানে, বড় সুস্বাদু লাগল সেই দই।
“তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে...” সে তাল গাছও দেখা গেল মাটির এক বাড়ির মাথা ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রবি ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন, তালধ্বজ বাড়ি। এটি নতুন করে লাগানো তাল গাছ। আগের সেই তালগাছটির মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই।
এইরকম করে গল্প শুনে শুনে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখলাম শান্তিনিকেতন। দেখলাম ইন্দিরা গান্ধী কোন হোস্টেলে থাকতেন সেটাও। হোস্টেলের নাম গোয়েঙ্কালয়।
হাঁটতে হাঁটতে প্রতিমুহূর্তে যখন মনে করছিলাম এখানে এক সময় হেঁটে বেড়িয়েছেন রবিঠাকুরও। নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল।
সঙ্গীত ভবনের পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাবেন বিভিন্ন রকমের সুর ও সঙ্গীতযন্ত্রের শব্দে আপনি হবেন বিমোহিত। দেখবেন সেখানে রয়েছে রামকিঙ্কর বেইজের করা বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘কলের বাঁশি।’ দুই সাঁওতাল রমণীর কারখানায় কাজে যাওয়ার দৃশ্য। পাশে রয়েছে একটি সাঁওতাল শ্রমিক পরিবারের দেশান্তরে যাত্রা।
আশপাশে অনেক ঘোরার মতো স্পট রয়েছে। ব্যাটারি চালিত অটোতে করে খোয়াই বনের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিলাম ‘আমার কুটিরে’।
‘আমার কুটির’
শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমার কুটির। একে হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হলেও ‘আমার কুটির’ মূলত একটি আন্দোলন। ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আমার কুটিরের ভূমিকাও ছিল।
সৃজনী শিল্পগ্রাম
বোলপুরে শান্তিনিকেতনের খুব কাছে এই সৃজনী শিল্পগ্রাম আরেকটি দর্শনীয় স্থান। পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মানুষের জীবনযাত্রা, শিল্প সংস্কৃতির এক অপূর্ব সহাবস্থান রয়েছে এখানে।
রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত ছড়া ‘আমাদের ছোট নদী’ লিখেছিলেন কোপাই নদীর ধারে। বিকেল বেলাটা ঘুরতে গিয়েছিলাম সেখানেও। যদিও শীতকালে নদীতে পানি নেই খুব একটা।
চাইলে আপনারাও ঘুরে আসতে পারেন।
কখন যাবেন?
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য উৎকৃষ্ঠ সময়। কারণ এই সময়টাতে শীত শীত আমেজ থাকে। গরমে শান্তিনিকেতনে না যাওয়াই ভালো।
বোলপুরে রয়েছে বহু হোটেল আর লজ। আপনি শহরের মধ্যে শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি থাকতে পারেন। আবার শহরের বাইরে খোয়াই বনের ভিতরে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারেন। ভাড়া বিভিন্ন রকমের রয়েছে। এক হাজার টাকার মধ্যেও পাবেন। তবে দুই থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের রিসোর্টে পরিবারসহ থাকার জন্য ভালো।