এই চর ঘুরে এসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন পরিব্রাজক ও চিত্রগ্রাহক ফারুখ আহমেদ।
শীতের এক দুপুর। আমরা তিনজন অর্ধাচন্দ্রাকৃতির এক সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে। গোসলকরার জন্য আদর্শ জায়গা বটে। তবে আমরা গোসলের কথা ভাবছি না। ভাবনার জগত জুড়ে পুরোটাই দখল করে আছে সমুদ্র সৈকত ও তার চারপাশের পরিবেশ।
আরও একটু দুরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখতে পেলাম ছোট্ট একটি গ্রাম। এটা জেলে পল্লী, তবে স্থায়ী নয়। জেলেদের অস্থায়ী আবাস। সুন্দরবনের দুবলার চরের মতোই শীত মৌসুমে এখানে ছয় মাসের জন্য আবাস গড়ে ওঠে।
ছোট্ট একটি ট্রলার চেপে প্রথমে তেঁতুলিয়া নদী, তারপর বুড়াগৌরাঙ্গ এবং শেষে বঙ্গপোসাগর পাড়ি দিয়ে একটু আগে এখানে পা রেখেছি।
চার ঘণ্টার ট্রলার ভ্রমণ পুরোটাই ছিল নিখাদ আনন্দে ভরপুর। কত যে পাখি দেখলাম। নাজমূল হক স্যার দীর্ঘদিন পাখির ছবি তুলে বেড়ালেও এখানে এসে এক সময় তার মুখ থেকে বের হল, জীবনে একসঙ্গে এত পাখি এই প্রথম দেখলাম।
আর সেই পাখির চোখে চোখ রেখে রেখে তিনজনের দল চলে এলাম যেখানে তার নাম সোনার চর।
ছয় জনের দল শেষে গিয়ে ঠেকল তিনজনে। আমরা ঢাকা থেকে লঞ্চে চেপে চর ফ্যাশন ও চর কচ্ছপিয়া হয়ে স্পিডবোটে চেপে চলে আসি চর কুকরি-মুকরি। সেদিন চর কুকরি-মুকরির নারিকেল বন ও তারুয়ার দ্বীপ ঘুরে দেখি। পরদিন ভোরে বের হই সোনার চরের উদ্দেশ্যে।
কুকরির খাল পার হয়ে মেঘনার মোহনায় পড়তেই ম্যানগ্রোভ বনের পাশের ছোট্ট চর দীঘলে মহিষের পাল ও বকপাখির সঙ্গে অনেক নাম না জানা পাখি ও ঝাঁকে ঝাঁকে কাস্তেচেরা দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠতেই বোঝা হয়ে গেল দিনটা ‘আমাদের’!
চর দীঘল পেরিয়ে আরও সামনে যেতেই নিজেদের সাত সাগরের এপার মনে হল।
এরমধ্যে গড়গড় আওয়াজ আর কাশির মতো শব্দ করে ট্রলার দাঁড়িয়ে পড়ল।
তখনই চোখে পড়ল সামনেই একঝাঁক সাদা রঙা পাখির ঝলক। সূর্যের আলোতে সে পাখির ঝিলিক দেখে আমাদের চোখও চকচক করে উঠল। নাজমূল স্যার ইশারায় ট্রলারের গতি কমিয়ে ধীরে এগিয়ে যেতে বললেন। তারপর শুনলাম তার বিড়বিড় উচ্চারণ ‘পাতিচখা’।
এরমধ্যে ট্রলার চালক ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে বৈঠা হাতে নিয়ে ধীরে তার নৌকা এগিয়ে নিচ্ছিলেন পাতিচখার দিকে। শরীফ আর নাজমূল স্যার ততক্ষণ সমানে ক্যামেরা ক্লিক করে চলছিলেন। তারপর হঠাৎ কোন সে আয়াজে পাতিচখা দলের আকাশপানে উড়াল। সে দৃশ্যে মুগ্ধতা ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এভাবেই এক সময় আমাদের ট্রলার আস্তে আস্তে থিতু হল। কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের খাল ধরে চলে এলাম সোনার চরের সান বাঁধানো ঘাটে। এবার আমরা ব্যাকপ্যাকসহ নেমে এলাম।
সোনার চরে আমাদের প্রথম মুগ্ধতা ছিল ঝুনঝুনির ফুল আর ঝাউগাছ। আরও চোখে পড়ল উপকূলীয় অঞ্চলের গাছ হরগোজা ও বাবলা। এখানে পুরোটাই ইটের আঁকাবাঁকা রাস্তা। সেই পথ ধরে আর সবুজে চোখ জুড়িয়ে ঠিক ১০ মিনিটে চলে আসি সমুদ্র সৈকতে।
এরমধ্যে অনেক পাখির দেখাও পেয়েছি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চখাচখি, লালপা বা রেডস্যাঙ্ক, হলদে খঞ্জন, কমন স্নাইপ, বড় বুলিন্দা ও কাস্তেচেরা উল্লেখযোগ্য। আর বক দেখেছি অগুনিত। এভাবেই আমরা পায়ে পায়ে চলে আসি জেলে পল্লিতে।
এখানে এখন অনেকটা অলস জীবন-যাপন। সকালের মাছ ধরা এক পর্যায়ে শেষ হয়েছে। আরেকবার জেলেরা বের হবে বিকাল বেলা। চলছে মাছ শুকিয়ে শুটকি বানানোর কাজ। এসব শুটকির বেশিরভাগই মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।
আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা সোনার চর সমুদ্র সৈকত ও জেলে পল্লিতে ছিলাম। সোনার চর সমুদ্র সৈকতের সোনালি বালিতে কিলবিল করা ছোট্ট কাকড়ার দলে দারুণ মুগ্ধতা ছড়ান। সমুদ্র সৈকতের কথা শুরুতেই বলেছি। বাঁকানো সৈকতটিকে দেখতে একবারে অর্ধচন্দ্রাকৃতির। জায়গায় জায়গায় শেওলা পড়া দেখে বোঝাই যায় কালেভদ্রে এখানে লোকজন আসেন। এমন অসাধারণ সৌন্দর্যে আমরা আরও সঙ্গীসাথির প্রয়োজন বোধ করি। কি আর করা, যেহেতু রাত কাটাবো না সেহেতু বেলা থাকতেই চর কুকরিতে ফেরার প্রস্তুতি হিসেবে ঝাউবনের ভেতর হাঁটা শুরু করি।
আরও একটু
বন বিভাগের আওতাধিন সোনার চর হচ্ছে বন্য-প্রাণীর অভয়ারণ্য। সুন্দরেরবনের পর চর কুকরিমুকরি ও সোনার চরকেই ধরা হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সোনা চরের মূল সৌন্দর্য এখানকার ঝাউবন। এছাড়া এই বনে রয়েছে প্রচুর কেওড়া ও ছৈলাসহ গোলপাতা, বাবলা, করমচা, নলখাগড়া ও জাম গাছ।
শীত মৌসুমে এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে, সে অর্থে সোনার চর প্রচুর দেশি-বিদেশি পাখির বিচরন ক্ষেত্র। হরিণ থেকে শুরু করে গেছো বাঘ, বন বিড়াল, বন মুরগি ও বানরসহ অনেক প্রাণী রয়েছে এই বনে।
বনবিভাগের পটুয়াখালি রেঞ্জের আওতায় গড়ে ওঠা সোনার চর পটুয়াখালি বা গলাচিপা হয়ে যেতে সময় লাগে প্রায় আট ঘণ্টার ওপর। সেখানে চর কুকরি থেকে সোনার যেতে সময় লাগে ভালো একটি ট্রলারে সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা। সে অর্থে সোনার চর কেনো পটুয়াখালি রেঞ্জে তা কেবল সরকারের নীতি নির্ধারকরাই বলতে পারবেন।
ভাবতে ভাবতে ট্রলার ছেড়ে যেই আমরা কুকরি-মুকরি অভিমূখে ছুটতে যাব তখনই পাশের চরে দেখা মেলে ধলাবুক এক ঈগলের। ততক্ষণে ভাটা পড়ে চর জেগেছে আমাদেরও যাওয়া বন্ধ হয়েছে। এবার আমাদের ফিরতে হবে অনেকটা পথ ঘুরে, চর মন্তাজ হয়ে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
আমি মনে করি সোনার চর যেভাবে আছে সেভাবে থাকুক। অযথা প্রকৃতি বিনষ্ট করে এখানে আবাস গড়ার কাজ শুরু করলে চমৎকার এই চর ধ্বংস ডেকে আনা ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারবো না। তবে যেহেতু এখানে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে বিশেষ করে শীত মৌসুমে অনেকেই এখানে আসে সেহেতু নিরাপত্তাসহ এই চরে পর্যটক সুবিধা থাকলে পর্যটকরা সবুজ এই চরটির একদিকের বন ও অন্য দিকের নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য ও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখে বলতে পারবে অদ্ভুতদর্শন- এক সঙ্গে সুন্দরবন এবং কুয়াকাটা বা সেন্টমার্টিন!
সারা বছরই সোনার চর যাওয়া যেতে পারলেও শীত মৌসুম সোনার চর যাওয়ার উপযুক্ত সময়। শীত ও বসন্তকালে গেলে পাখি ও বন্যপ্রাণীর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সোনার চরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সারাবছরই দেখা যেতে পারে।
কীভাবে যাবেন
গলাচিপা থেকে সোনার চরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। চর কুকরি-মুকরি বা চর কচ্ছপিয়া থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের মতো।
সুতরাং সোনার চর যেতে হলে চর কচ্ছপিয়া বা চর কুকরি-মুকরি থেকেই সহজ যাত্রা।
ঢাকার সদরঘাট থেকে সরাসরি গলাচিপা বা চর ফ্যাশন চলে যান। আমি গিয়েছিলাম ভোলা জেলার চর ফ্যাশনের চর কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে চর কুকরি-মুকরি। সেখানে একরাত থেকে চরের সৌন্দর্য উপভোগ করে পরের দিন ট্রলারে সোনার চর চলে যাই।
লঞ্চে ঢাকা থেকে চর ফ্যাশন (বেতুয়া ঘাট বা ঘোসের হাঁট) ডেকের ভাড়া ২শ’ টাকা। কেবিন ১ হাজার টাকা। চর ফ্যাশন থেকে চর কচ্ছপিয়া ফেরিঘাট যেতে হবে মোটর সাইকেল অথবা বোরাকে (ইজিবাইক) চেপে।
সময় বাঁচানোর জন্য মোটর সাইকেলে চেপেই চর কচ্ছপিয়া যাওয়া ভালো। সময় লাগবে ৪৫ মিনিট, ভাড়া জনপ্রতি ১শ’ টাকা।
এছাড়া উপজেলা পরিষদ ভবনে অনুমতি সাপেক্ষে থাকা যায়। এছাড়া রাত কাটানো যাবে বনবিভাগের অফিসার’স কোয়ার্টার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ি কিংবা খোলা মাঠে তাবু পেতে।
সোনার চরে থাকার জন্য বন বিভাগের বাংলো ছাড়া ভরসা করা যায় খোলা প্রান্তর বা সমুদ্র সৈকতের কাছে তাবু পেতে। খাবার দাবারের ব্যবস্থা চর কুকরি-মুকরি থেকেই সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে!
ছবি: ফারুক আহমেদ।