এনাল ফিশার

এনাল ফিশার অর্থ মলদ্বার ফেটে যাওয়া বা মলদ্বারে ঘা। মলদ্বারের হর হামেশা ঘটে থাকে এরকম রোগের মধ্যে এনাল ফিশার অন্যতম।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2016, 11:39 AM
Updated : 28 Nov 2016, 11:39 AM

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সার্জারি বিশেষজ্ঞ [এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (সার্জারি) বিশেষ ট্রেইনিং বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি] ডা. মীর রাশেখ আলম অভি।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে প্রতি ১ হাজার জনে এক’দু জন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই রোগে ভোগেন।

শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সের নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

কারণ: কোষ্ঠকাঠিন্য এই রোগের প্রধান কারণ। তবে অতিরিক্ত ডায়রিয়া হলেও এনাল ফিশার হতে পারে। মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। সাধারণত মলদ্বারের পেছন দিকে ফাটা অথবা ঘা হয়ে থাকে।

তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মলদ্বার সামনের দিকে ফেটে যেতে পারে। মলদ্বারের টিবি, যৌন বাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণেও অনেক সময় মলদ্বারের পাশে ঘা দেখা দেয়।

প্রকার ও প্রকারভেদে উপসর্গ

এনাল ফিশার দুই ধরনের হয়ে থাকে।

১. বিষম বা হঠাৎ সঙ্কটজনক হয়ে ওঠা ফিশার (Acute Fissure)।

২. দীর্ঘস্থায়ী ফিশার (Chronic Fissure)।

এই রোগের প্রধান উপসর্গ ব্যাথা। এছাড়া রক্তক্ষরণ, চুলকানি, মলদ্বারে শ্লেষ্মা বা পিচ্ছিল পদার্থ যাওয়া, মলদ্বারের পাশে বাড়তি মাংস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

বিষম বা হঠাৎ সঙ্কটজনক হয়ে ওঠা ফিশার (Acute Fissure)

তীব্র ব্যথা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। মলত্যাগের পরপর এই ব্যাথা শুরু হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ব্যথা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যথার সঙ্গে জ্বালাপোড়া হতে থাকে। ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে এতটাই তীব্র হয় যে অনেক রোগী বাথরুমে যেতে ভয় পান। এই রোগে রক্তক্ষরণের পরিমাণ সাধারণত কম। বেশিরভাগ রোগী অভিযোগ করেন মলত্যাগের পর টিস্যু ব্যবহার করলে রক্ত দেখা যায়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। মলদ্বারে শ্লেষ্মা বা পিচ্ছিল পদার্থ যেতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী ফিশার (Chronic Fissure)

ছয় সপ্তাহের বেশি ফিশারকে দীর্ঘস্থায়ী ফিশার বলা হয়। দীর্ঘস্থায়ী ফিশারে ব্যথা অল্প কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা নাও হতে পারে। অধিকাংশ রোগী মলদ্বারের পাশে বাড়তি মাংস (Sentinel Piles) আছে বলে অভিযোগ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মলদ্বারের ভেতরেও বাড়তি মাংস (Hypertrophied Anal Papilla) থাকতে পারে। অনেক সময় রোগীরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর মলদ্বারে ব্যথা অথবা জ্বালা, মলদ্বার সামান্য ভেজা ভেজা অথবা মলদ্বারে চুলকানি অনুভব করেন।

দুই ধরনের ক্ষেত্রেই ফিশার সংক্রমিত হয়ে ফোঁড়া (Abscess), পুঁজ পড়া কিংবা ফিস্টুলা হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে অনেকে প্রসাবের সমস্যায় এবং নারীরা অনেকে যৌন মিলনের সময় ব্যথা অনুভব করেন।

রোগ নির্ণয়

রোগীর উপর্সগ শুনে এবং মলদ্বার পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করে থাকেন। মলদ্বার না দেখে শুধুমাত্র শুনে চিকিৎসা করা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো। কেননা মলদ্বার দেখেই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন যে রোগীর মলদ্বারের টিবি, যৌন বাহিত রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণে হওয়া ফিশার নির্ণয়ে রোগীর অন্য কোনো পরীক্ষা (সিগময়ডোস্কোপি / কোলনস্কোপি ) প্রয়োজন কিনা।

প্রতিরোধ

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। প্রতিরোধের জন্যে নিন্মোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা যেতে পারে।

• কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা।

• অতিরিক্ত চাপ দিয়ে মলত্যাগের বদভ্যাস ত্যাগ করা।

• বারে বারে মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করা।

• নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন।

• অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করা।

• ডায়রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া।

চিকিৎসা

প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানো সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় পরিমিত (Conservative) চিকিৎসায় ফিশার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। পরবর্তী সময়ে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন করে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব।

প্রাথমিক অবস্থায় অল্প ব্যথা এবং রক্তপাত হয় বিধায় অধিকাংশ মানুষ বিষয়টি অবহেলা করেন। অথচ এ সময় মল নরম করার ওষুধ, ব্যথানাশক ওষুধ এবং স্থানিক মলম ব্যবহার করে রোগটির চিকিৎসা সম্ভব।

সিজ বাথ (Stiz Bath) এবং আঁশজাতীয় খাবার বেশি করে গ্রহণ করে রোগীরা উপকার পান। এক গামলা পানিতে সামান্য লবণ বা পভিসেপ দ্রবণ মিশিয়ে মলত্যাগের পর ১০ থেকে ১৫ মিনিট নিতম্ব ডুবিয়ে বসে থেকে সিজ বাথ নেওয়া যায়।

ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ফিশারের স্বল্প মেয়াদী (৬ মাস) চিকিৎসা সম্ভব। এরপর পুনরায় ইঞ্জেকশান দেওয়ার প্রয়োজন হয়। দীর্ঘস্থায়ী ফিশার নির্মূলে অপারেশন প্রয়োজন। কেননা দীর্ঘ দিন ভোগার কারণে মলদ্বার সংকুচিত হয়ে যায় এবং মলদ্বারের পাশে মাংস বেড়ে (Sentinel Piles) যায়, যা অপারেশন ছাড়া নিরাময় সম্ভব নয়।

অপারেশনের ব্যাপারে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের ভীতি রয়েছে। উপরন্তু অপারেশনের পর সুস্থ হব কিনা কিংবা মল ধরে রাখতে কোনো অসুবিধা হবে কিনা ইত্যাদি ভয়ে রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যান না।

এমনকি অনেকে ১৫ থেকে ২০ বছর রোগ পালন করেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণায় দেখা যায় যে সঠিক নিয়মে, সঠিক সময়ে, সঠিক অপারেশন করলে এই রোগ শতকরা ৯৫ থেকে ৯৮ ভাগ পর্যন্ত ভালো হয়ে যায়।

বর্তমানে মলদ্বারের আড়াআড়িভাবে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ মাংসপেশি কেটে দেওয়া (Lateral Internal Sphincterotomy) এই অপারেশনটি স্বর্ণমান (Gold Standard) হিসেবে গৃহীত।

এই অপারেশনের সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য হল –

• অপারেশনটি করতে স্বল্প সময় লাগে।

• তুলনামূলকভাবে কম ঝুকিপূর্ণ।

• অপারেশনের জন্য কোমরের নিচ থেকে অবশ করলেই যথেষ্ট্য, সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার প্রয়োজন নেই।

• অপারেশনের চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর রোগী খাবার গ্রহণ করতে পারেন।

• মাত্র এক’দু দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রয়োজন।

• অপারেশনের পাঁচ থেকে সাত দিন পর কাজে যোগদান করা সম্ভব।

• সম্পূর্ণ ঘা শুকাতে তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগে। 

আমাদের দেশের রোগীরা এত দেরি করে চিকিৎসকের কাছে আসেন যে, রোগটি জটিল হয়ে এইসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। পরিশেষে বলা যায় যে রোগ নিয়ে অবহেলা না করে দ্রুত একজন মলদ্বারের চিকিৎসায় পারদর্শী সার্জারি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন।

ছবি: রয়টার্স।