ফিস্টুলা বা ভগন্দর

ফিস্টুলাকে বাংলায় ভগন্দর বলা হলেও এর সহজ বাংলা হল নালি। মলদ্বারের ভেতরের সঙ্গে বাইরের নালি তৈরি হওয়াকে বলা হয় ফিস্টুলা। এটি অতি প্রাচীন রোগ।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2016, 12:28 PM
Updated : 20 Oct 2016, 12:28 PM

এর কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সার্জারি বিশেষজ্ঞ [এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (সার্জারি) বিশেষ ট্রেনিং বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি] ডা. মীর রাশেখ আলম অভি।

২০০০ বছর আগের বই-পুস্তকেও ফিস্টুলা সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া গেছে। সাধারণত মলদ্বারের পাশের গ্রন্থি (Anal gland) বন্ধ ও সংক্রমিত হয়ে বিষফোঁড়া হয় এবং বিষফোঁড়া ফেটে গিয়ে নালি তৈরি করে। মলদ্বারে বিষফোঁড়া হওয়া রোগীদের শতকরা ৫০ ভাগ রোগীর ফিস্টুলা হয়। অনেক সময় ফিস্টুলা এবং বিষফোঁড়া একই সঙ্গে প্রকাশ পায়।

এছাড়া মলদ্বারের যক্ষা, বৃহদন্ত্রের প্রদাহ এবং মলদ্বারের ক্যান্সার থেকে ফিস্টুলা হয়। শিশুদের সাধারণত ফিস্টুলা হয় না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে আট থেকে নয় জন ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত।

মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা (প্রায় দ্বিগুন) বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

রোগীর ব্যথা, মলদ্বারের পাশে ফোলা এবং নিজে থেকে ফেটে গিয়ে পুঁজ-পানি ঝরা কিংবা বিষফোঁড়ার জন্যে আগের অপারেশনের ইতিহাস নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। পুঁজ-পানি পড়লে ব্যথা কমে যায় এবং রোগী আরাম বোধ করেন এবং কিছুদিনের জন্যে রোগী ভালো হয়ে যান। রোগটি দুতিন মাস সুপ্ত থেকে আবার দেখা যায়।

সুপ্তাবস্থায় রোগী ভাবেন যে তিনি ভালো হয়ে গিয়েছে, ফলে চিকিৎসকের কাছে আসেন না। অনেক রোগী দেখা যায় ব্যথার সময় এলাকার ফার্মেসী থেকে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথার ওষুধ কিনে খান। ব্যথা ভালো হলে ভুলে যান। এভাবে চক্রাকারে বছরের পর বছর চলতে থাকে। অনেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেন। জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে আসেন।

ফিস্টুলা যেহেতু একটি নালি তাই এর দুইটি মুখ থাকে। একটি মলদ্বারের ভেতরে একটি বাহিরে। নালিটির গতিপথের উপর ভিত্তি করে আমেরিকান গ্যাস্ট্রএন্টারোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফিস্টুলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে।

সরল ফিস্টুলা: যে সকল ফিস্টুলার মুখ মলদ্বারের অল্প ভেতরে তাকে সহজ ফিস্টুলা বলে। এক্ষেত্রে মলদ্বারের মাংসপেশি অল্প সম্পৃক্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই হয় নয়া।

জটিল ফিস্টুলা: যে সকল ফিস্টুলার মুখ মলদ্বারের গভীরে, কিংবা ফিস্টুলার শাখা-প্রশাখা রয়েছে অথবা ফিস্টুলার সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গের (যেমন - মুত্রথলি, যোনিপথ) সংযোগ রয়েছে তাকে জটিল ফিস্টুলা বলে।

জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে মলদ্বারের মাংসপেশি বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত হয়। অপারেশনের পর পুনরায় হওয়া ফিস্টুলা, মলদ্বারের যক্ষা, বৃহদন্ত্রের প্রদাহ এবং মলদ্বারের ক্যান্সার থেকে হওয়া ফিস্টুলা সাধারনত জটিল ফিস্টুলা হয়ে থাকে। অনেক সময় এ ধরনের ফিস্টুলার ক্ষেত্রে বাইরে একাধিক মুখ থাকতে পারে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর সমস্যা শুনে, মলদ্বার দেখে ও মলদ্বারে আঙুল দ্বারা পরীক্ষা করে ফিস্টুলা রোগটি নির্ণয় করা যায়। মলদ্বারের যক্ষা, বৃহদন্ত্রের প্রদাহ এবং মলদ্বারের ক্যান্সার থেকে ফিস্টুলা এসব সন্দেহ করলে চিকিৎসকরা কোলনোস্কপি করে থাকেন। এছাড়া জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে এমআরআই, মলদ্বারের ভেতরের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়।

ফিস্টুলা এমন একটি রোগ যার অপারেশন ভিন্ন অন্য কোনো চিকিৎসা নেই। প্রকৃতিগত ভাবেই মানুষ অপারেশন ভয় পায়। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কিছু ‘অসাধু’ রোগীদের প্রতারিত করে থাকে। তাদের অপচিকিৎসা রোগটির জটিলতা বৃদ্ধি করে।

হিপক্রেটিস (আনুমানিক ৪৩০ খৃস্টপূর্ব) সর্বপ্রথম ফিস্টুলার সার্জিক্যাল চিকিৎসা করেন বলে বইপত্রে উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। ১৯ শতকের শেষ থেকে ২০ শতকের শুরুর দিকে গুডসেল, মাইলস, মিলিগ্যান এবং মরগ্যান, থম্পসন প্রমুখ সার্জনগন ফিস্টুলা চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৬ সালে পার্কস ফিস্টুলার যে শ্রেণিবিভাগ করেন সেটি এখনও সর্বজনবিদিত। পরে ফিস্টুলা চিকিৎসায় বহু পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে কোনটি শ্রেষ্ঠ বা যথাযথ সে বিষয়ে চিকিৎসকরা এখনও ঐক্যমতে আসতে পারেননি। 

বর্তমানে ফিস্টুলা চিকিৎসার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত অপারেশন পদ্ধতিগুলো হচ্ছে-

* ফিস্টুলোটোমি। * ফিস্টুলেকটোমি। * সিটন পদ্ধতি। * ফিস্টুলা প্লাগ। * ফিস্টুলা গ্লু। * ফ্ল্যাপ ব্যবহার। * রেডিওফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার। * লেজার ব্যবহার। * স্টেম সেল ব্যবহার। * মলদ্বারের মাংসপেশির মাঝখানের নালি বন্ধ করে দেওয়া। * এন্ডোস্কোপিক ফিস্টুলা সার্জারি।

এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি বহূল ব্যবহৃত। বাকিগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে কিংবা অতি জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পদ্ধতি যাই হোক না কেনো ফিস্টুলার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয় যেমন- সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, ফিস্টুলা নালিটি বন্ধ করা এবং মল ধরে রাখার ক্ষমতা বজায় রাখা।

ফিস্টুলা চিকিৎসার অন্যতম দিক হল অপারেশনের পর ফিস্টুলা পুনরাবৃত্তি না হওয়া এবং মল ধরে রাখার ক্ষমতা বজায় রাখার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।

সাধারণত কোমরের নিচ থেকে অবশ করে অপারেশন করা হয়। একদু দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। ফিস্টুলা অপারেশনের পর ঘা শুকাতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে সিটন পদ্ধতিতে দুতিন ধাপে অপারেশন করা হয়। প্রতিটি ধাপের মাঝে সাত থেকে ১০ দিন বিরতি দেওয়া হয়। এই সময় নিয়মিত ড্রেসিং করা প্রয়োজন। ড্রেসিং অপারেশনের পর পুনরায় ফিস্টুলা হওয়ার সম্ভাবনা কমায়।

একথা সত্য যে ফিস্টুলা অপারেশনের পর আবার হতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের মতে অপারেশনের পর ফিস্টুলা পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা তিন থেকে সাত ভাগ। জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে এটি শতকরা ৪০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। তবে এক কথায় জবাব দেওয়া সম্ভব নয় ফিস্টুলা অপারেশনের পর পুনরায় হবে কিনা। ফিস্টুলার ধরন, সার্জনের অভিজ্ঞতা এবং অপারেশনের পরের যত্নের উপর ফিস্টুলা অপারেশনের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ফিস্টুলা রোগটির চিকিৎসা সম্ভব এবং সঠিক চিকিৎসায় ফিস্টুলা ভালো হয়। রোগ নিয়ে লজ্জা না পেয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন, সুস্থ থাকুন।

প্রচ্ছদের ছবি: রয়টার্স।