উদ্ভট নামের পোশাক

ঈদ আসলেই বাজার ছেয়ে যায় উদ্ভট নামের পোশাকে। সেইসব পোশাকের সঙ্গে ইসলামিক বা বাংলাদেশের সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক তো পাওয়া যায়ই না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নামগুলো নারীদের জন্য অবমাননাকরও, জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 June 2016, 11:20 AM
Updated : 18 June 2016, 04:12 PM

ফারজানা ইসলাম একজন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। অফিসে শেষে একটি বিলাসবহুল বিপণি বিতানে গিয়েছেন ঈদে নিজের এবং প্রিয়জনের জন্য পোশাক কিনতে। হঠাৎ খেয়াল করলেন পাশ থেকে এক দোকানী তাকে “এই ছাম্মাক ছাল্লো” বলে ডাকছে। ফারজানার জানা মতে, হিন্দি এই শব্দের অর্থ খুব ভদ্র কিছু নয়।

ফারজানা দোকানীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলেন— তার কাছে এই নামে পোশাক আছে। তিনি সেই নাম বলে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করছিলেন। ফারজানাকে অবমাননা করার কোনো উদ্দেশ্য তার ছিল না।

গত প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশে ঈদের বাজারে পোশাকের নাম দেওয়ার একটা সংস্কৃতি চলে আসছে। শুধু নারীদের নয় পুরুষদের পোশাকেরও নামকরণ করা হয়। তবে নামকরণের প্রথায় নারীদের পোশাকই অগ্রগামী।

২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একই ধরনের বড় ঘের দেওয়া কামিজ কখনও জিপসি, কখনও আনারকলি কখনও পাখি জামা নামে বাজারে এসেছে। আদতে পোশাকের ধরণ একই ছিল সব সময়। সেই একই পোশাকের নাম এই বছর বাজিরাও মাস্তানি।

রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাশ বলেন, “ভারতীয় বাহারি নামের এই পোশাকগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একই নাম নিয়ে আপনি ভারতের বাজারে খুঁজলে এই নামের কোনো পোশাক পাওয়া যাবে না। এই নামের কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশি বিক্রেতাদের।” 

সৌমিক দের কথার প্রমাণ মেলে ঢাকার বিভিন্ন বিপণি বিতানে গিয়ে। পাশাপাশি দুই দোকানে একই নামে ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের পোশাকের সন্ধান মেলে। কোথাও হয়ত কামিজের নিচে স্কার্ট দেওয়া পোশাকের নাম ‘বাজিরাও মাস্তানি’। পাশের দোকানেই ফ্রক কামিজের নিচে চুড়িদার সালোয়ার দেওয়া পোশাকের নাম ‘বাজিরাও মাস্তানি’। দোকানীরা ক্রেতাদের অক্লান্ত ভাবে বোঝাচ্ছেন তার দোকানে থাকা পোশাকটাই প্রকৃত ‘বাজিরাও মাস্তানি’ পোশাক।

এহেন নামকরণের কারণ জানতে চাইলে পোশাক বিক্রেতারা জানান, এই ধরণের নামের সঙ্গে ক্রেতারা নিজেদের পরিচিত নাম বা চরিত্রের সাদৃশ্য খুঁজে পায়। যেহেতু আমাদের দেশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব খুব শক্তিশালী এবং ক্রেতারা সেই সংস্কৃতির ভোক্তা পোশাকেও তার মিল খুঁজে পেলে সেই পোশাকের বাজার তুলনামূলক ভালো যায়।

পোশাকের এই নামকরণ ভারত থেকে দেওয়া হয় না। ক্রেতার চাহিদা এবং বাজারের অবস্থা বুঝে তারাই এই নামকরণ করে নেন।

ঢাকার অন্যান্য মার্কেট খুঁজে বাজিরাও মাস্তানি, ছাম্মাক ছাল্লো, রাগে-অনুরাগে, প্রেমের ফাঁদে, কিরণমালা, স্টার জলসা প্রভৃতি নামে পোশাক পাওয়া যায়। প্রায় সব পোশাকের নামই ভারতীয় কোনো সিনেমা, সিরিয়াল অথবা অভিনেত্রীর নাম থেকে নেওয়া।

দেশি নামে এবং দেশে তৈরি পোশাকের শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু দেশীয় বুটিক হাউজে পাওয়া যায়। অন্যথায় মূলধারার কোনো বিপণি বিতানে এমন কোনো পোশাক পাওয়া যায়নি যা দেশে তৈরি বলে বিক্রেতারা স্বীকার করেন।

রঙ বাংলাদেশের কর্ণধার সৌমিক দাশ।

সৌমিক দাশ বলেন, “এ ধরণের ভারতীয় পোশাক, ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও তৈরি হয়। তবে পোশাক যেখানেই তৈরি হোক বিক্রেতারা তা ভারতীয় বা বিদেশি বলতেই বেশি আগ্রহী কেননা ক্রেতাদের চাহিদা ভারতীয় পোশাকেই।”

ক্রেতা বিশেষ করে নারী ক্রেতারা কেনো ভারতীয় পোশাক পরতে এত উৎসাহী এই প্রশ্নের জবাবে সৌমিক দাশ জানান, একে তো ক্রেতারা যে সংস্কৃতিতে বসবাস করে তার পুরোটাই ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত। এ ছাড়াও সেই পোশাকগুলো তুলনামূলক দামে সস্তা। একই পোশাক অনেক পরিমাণে তৈরি করার ফলে সেগুলো প্রতি এককের দাম কমে যায়। আবার একই ডিজাইনের পোশাকের অনেকগুলো মান আছে। সব শ্রেণির ক্রেতাই সেই পোশাক নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যে পাচ্ছে। তাদের কাছে মূলত মানের চেয়ে নির্দিষ্ট পোশাকটাই বেশি জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ড. সানজীদা আখতার, অন্য দেশের সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের পোশাক এতটা প্রভাবিত হওয়ার কারণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।

ড. সানজীদার মতে, আমরা যে সংস্কৃতিকে ধারণ করি, তা আমাদের ভাষা, পোশাক, উৎসব উৎযাপন ইত্যাদি মাধ্যমে প্রকাশ করি। সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অন্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিতও। এই বহিঃপ্রকাশ পোশাকের মাধ্যমেও হয়।

পোশাকে ভারতীয় সিনেমা, সিরিয়াল বা অভিনেত্রীদের স্টাইল এবং নামকরণের জন্য ড. সানজীদা আমাদের মিডিয়ার ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত করেন। আমাদের যে কয়টা চ্যানেল রয়েছে তার সব গুলোতেই একই ধরনের টক শো, খবর নয়ত এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। টিভি চ্যানেলগুলোতে নিখাঁদ বিনোদনের অভাব প্রকট। এই অভাব পূরণের জায়গায় ভিনদেশি মূলত ভারতীয় চ্যানেলগুলো দখল করে নিচ্ছে। ফলে আমাদের সংস্কৃতিতে একদমই বেমানান কিছু শব্দ, আচার, পোশাক আমরা সহসাই নিজেদের করে নিচ্ছি। এমনই মত দেন তিনি।

ড. সানজীদা আখতার।

ড. সানজীদা আরও বলেন, “অন্য দেশের অনুষ্ঠান দেখাটা আসলে বড় সমস্যা নয়। বড় সমস্যা দাঁড়ায় যখন দর্শক সেই অনুষ্ঠানের মধ্যে বসবাস করা শুরু করে এবং অন্ধভাবে কলাকুশলীদের অনুকরণ করা শুরু করে।”

এই অন্ধ অনুকরণের কারণ হিসেবে তিনি জানান, আমাদের দেশে নারীদের একটা বিশাল অংশ এখনও সেইভাবে নিজেদের পরিচয় তৈরি করার সুযোগ পায় না। যদিও বা কেউ কেউ শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেও ফেলেন তাদের সেভাবে প্রশংসা পান না। অপরদিকে যারা শুধু ঘরের কাজ করেন তাদের কাজটাকে তো আলাদা করে কেউ মূল্যায়ন করেই না। ফলে তাদের মধ্যে একটা আফসোসের জায়গা তৈরি হয়। অধিকাংশ সিরিয়াল একটা নারীকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। যে নারী খুব শক্তিশালী। পরিবারের সব সমস্যা সমাধান সে করছে, সম্ভব অসম্ভব সব বাধা পেরিয়েও সে বিজয়ী হচ্ছে। দিন শেষে হাজার অসহযোগিতা সত্ত্বেও পরিবার এবং সমাজ তাকে বাহবা দিচ্ছে, মাথায় তুলে নিচ্ছে।

আমাদের কখনই প্রশংসা না পাওয়া নারীরা সিরিয়ালের সেই নারীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। এই একাত্মতা তার নিজের পরিচয় বিলীন করে দেয়।

একইভাবে পুরুষরাও সিরিয়ালের সেই নারীদের গুণমুগ্ধ। কেননা, সেই নারীদের সমাজ মানুষ হিসেবে খুব কম সুযোগ দেয়, তারপরেও হাজার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে তারা ভালো মেয়ে, ভালো স্ত্রী এবং ভালো ছেলের বৌ হওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে সমাজে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা, নিজের স্বার্থকে বিলীন করে দেওয়া নারীদের চাহিদা আকাশ চুম্বী। তাই চরিত্রের নামের পোশাক কখনও ‘ফেইল’ করে না। এমনই মতামত ড. সানজীদার।

তিনি আরও বলেন, “যেহেতু পোশাকগুলো ভিন দেশি সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, এর সঙ্গে অনেক কুপ্রথা এবং এমন সব শব্দ চলে আসে যেগুলোর অর্থ ভালো নয়।”

ড. সানজীদার কথার প্রমাণ মিলে ‘ছাম্মাক ছাল্লো’ শব্দের অর্থ ইন্টারনেটে খুঁজতে গেলে।

‘ইয়াহু আনসার’য়ে এই শব্দের অনেকগুলো জবাব রয়েছে। শ্রেষ্ঠ জবাব হিসেবে যেটি বিবেচিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, “ছাম্মাক ছাল্লো’ একটি পাঞ্জাবি শব্দ। যার মানে চটকদার সাজ-পোশাকের নারী, যে পোশাক এবং সাজ দিয়ে পুরুষকে আকৃষ্ট করতে চায়। তার হাঁটার ভঙ্গি যৌন আবেদনময়, সে হাঁটার ফলে তার পরিহিত ধাতব গহনা ঝংকার তোলে। সাধারণত আইটেম গার্লদের জন্যই এই শব্দ ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মহিলাদের জন্য তা অবমাননাকর এবং হানি কারক।"

ড. সানজীদা বলেন, “পোশাকের নাম সাদামাটা সিরিয়ালের নায়িকার পরিচয়ে রাখা হোক অথবা ঝলমলে আইটেম নাম্বার অনুসরণে, এই নামগুলো বেশিরভাগ সময় ‘সেক্সিস্ট’। এগুলো পরিধানকারীকে নারী হিসেবে একটা পরিচয়ে আটকে দেয় এবং তার থেকে সেই রকমের ব্যবহার আশা করে। যারা এই পোশাক তৈরি করে বা যারা এই পোশাক পরিধান করে তারা হয়ত এই ব্যাপারে সচেতনও নয়। কিন্তু সামাজিকরণ প্রক্রিয়ায় এর প্রভার সুদূর প্রসারী।”

ফ্যাশন ডিজাইনার সৌমিক দাশ অবশ্য বিদেশি পোশাকের এই প্রভাব সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, অন্যদেশীয় সংস্কৃতির প্রভাবে আস্তে আস্তে আমরা আমাদের সংস্কৃতি হারাতে বসেছি। আমাদের পরিচয়ের সঙ্গে তো বটেই আমাদের ঋতু, পার্বণ, আবহাওয়া সব কিছুর সঙ্গেই অসমঞ্জস্য এবং অস্বাচ্ছন্দ্যকর পোশাক আমরা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিচয় আমাদের স্বকীয়তা।

“সংস্কৃতির আগ্রাসন ছাড়াও ভিন দেশি পোশাকের বাজারটা বিশাল। এটি আমাদের নিজস্ব বাজার তৈরিতে বাধা দিচ্ছে। এই পোশাক অথবা পোশাক তৈরির জন্য আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কাপড়, সুতা, পুঁতি, জরি, চুমকি। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা এতে খরচ হচ্ছে। অপরদিকে আমাদের দেশে যেসব স্পিনিং মিল, কাপড়ের মিল রয়েছে সেখানে তৈরি কাপড় পুরোটাই রফতানি হচ্ছে পাশ্চাত্যের বাজারে। আমাদের কাছে সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না।” যোগ করেন সৌমিক দাশ।

তিনি মনে করেন, বিদেশি পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে সরকার এবং মিডিয়া একটি জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা যদি নির্দিষ্ট সময় ধরে বিদেশি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দেশীয় পোশাক শিল্পের রক্ষণাবেক্ষণে মনযোগী হই তাহলে দেশীয় পোশাকের মান বৃদ্ধি পাবে। দাম সর্ব সাধারণের হাতের নাগালে আসবে। সর্বোপরি বিশ্ব বাজারে আমাদের দেশীয় পোশাক শিল্পটা একটা শক্তিশালী পরিচয় তৈরি করতে পারবে।

ছবি: আব্দুল মান্নান।