গৌড়ের পথে পথে

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিশ্রামাগারের সামনেই ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ। রুমে ব্যাগপত্র রেখে দ্রুত বেড়িয়ে পড়লাম সন্ধ্যার আলোয় সোনামসজিদ দেখতে।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 May 2016, 12:16 PM
Updated : 31 May 2016, 12:16 PM

চাঁপাইনবাবগঞ্জ- সোনা মসজিদ স্থল বন্দর মহাসড়কের পূর্ব পাশে অবস্থিত প্রাচীন এ স্থাপনা সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত। কালোপাথরে নির্মিত এ মসজিদের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য খুবই আকর্ষণীয়।

প্রধান প্রবেশপথের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী- জনৈক মজলিস মনসুর ওয়ালী মোহাম্মদ বিন আলী মসজিদটি নির্মাণ করেন।

শিলালিপি থেকে নির্মাণের তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলো মুছে যাওয়ায় মসজিদটি নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে এতে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম থাকায় ধারণা করা হয় মসজিদটি তাঁর রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় নির্মিত।

মসজিদের পূর্বপাশের সমাধিক্ষেত্রের ভেতরে একটি পাথরের প্লাটফর্মের উপরে দুটি সমাধি আছে। এখানে কারা সমাহিত রয়েছেন তা সঠিক জানা যায় নি। তবে জনশ্রুতি আছে সমাধি দুটি মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ ও তার পিতা আলীর।

মসজিদ প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পূর্ব কোনে দুটি আধুনিক সমাধি রয়েছে। যার একটিতে সমাহিত আছেন বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। 

সোনা মসজিদ দেখতে দেখতে অন্ধকার ঘন হল। মসজিদের সামনে হোটেল শেরাটনে রাতের খাবার সেরে রেস্ট হাউসে ফিরলাম। পরদিন খুব ভোরে উঠে আমাদের

খনিয়া দিঘি আম বাগান।

প্রথম গন্তব্য  তাহ্‌খানা কমপ্লেক্স।

সোনা মসজিদ থেকে সামান্য সামনে মহাসড়ক থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে ছোট পিচঢালা পথ। এ পথের শেষ মাথায় বিশাল দিঘির পাড়ে পাশাপাশি তিনটি প্রাচীন স্থাপনা। এর মধ্যে দক্ষিণ পাশেরটিই তাহ্‌খানা।

ভবনটিতে বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল। এর লাগোয়া পূর্ব দিকেই দিঘি। দিঘির ভেতর থেকেই ভিত্তি গড়ে ভবনটির পূর্বাংশ তৈরি করা হয়েছিল।

এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহশুজা ১৬৫৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন, তার বসবাসের জন্য।

আবার কারও কারও মতে শাহশুজা গৌড় অঞ্চলে বসবাসকারী তার পীর শাহ নিয়ামত উল্লাহর জন্য এ ভবন নির্মাণ করেন।

তাহ্‌খানা লাগোয়া উত্তর পাশের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট শাহ নিয়ামত উল্লাহ মসজিদ। এর পূর্ব দিকে একটি খোলা আঙিনার চার পাশে আছে অনুচ্চ দেয়াল।

পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় আছে তোরণসহ প্রবেশপথ। মসজিদটির পূর্ব দেয়াল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে।

মসজিদের নির্মাতা কে ছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে জনশ্রুতি আছে সম্রাট শাহজাহান শাহ নিয়ামত উল্লাহকে বছরে পাঁচ হাজার টাকা আয়ের একটি সম্পত্তি দান করেন। তিনি ৩৩ বছর এ সম্পত্তি ভোগ দখল করেন এবং এর আয় থেকে তার খানকার ব্যয় নির্বাহ করে উদ্বৃত অংশ দিয়ে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।

ধুনিচক মসজিদ।

মসজিদের লাগোয়া উত্তর দিকের ভবনটি শাহ নিয়ামত উল্লাহর সমাধি। প্রায় তিন বিঘা জায়গা জুড়ে সমাধি এলাকার বেস্টনি। মাঝখানে মূল সৌধের চারপাশে রয়েছে পাথরে বাঁধানো বেশ কিছু কবর।

দিল্লির করনৌল প্রদেশের অধিবাসী শাহ নিয়ামত উল্লাহ ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। কথিত আছে ভ্রমণের প্রতি তার ছিল প্রবল ঝোঁক। ভ্রমণ করতে করতে একসময় তিনি এসে উপস্থিত হন গৌড় এলাকায়। শাহশুজা তখন বাংলার সুবাদার।

শাহশুজা নিয়ামত উল্লাহর সাক্ষাতে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি এ জায়গায় বসবাস শুরু করেন।

১৬৬৪ সালে এখানেই তিনি মারা যান। তবে তার কবরের উপরে সৌধটি কে নির্মাণ করেন সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না।  

তাহ্‌খানা দেখা শেষে এবার চললাম দারস-বাড়ির উদ্দেশ্যে।

প্রধান সড়কে এসে সোনামসজিদ স্থল বন্দরের দিকে সামান্য সামনে গিয়ে সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রাচীন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষ।

চারপাশে প্রায় ৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ স্থাপনাতে চল্লিশটি কক্ষ ছিল।

৪১.৫ মিটার আঙিনার চারপাশে ঘিরে ছিল তিন মিটার দৈর্ঘ্যের বর্গাকৃতির এ কক্ষগুলো। এখানে একটি ঢিবির কাছে চাষ করার সময় কৃষকরা কয়েকটি ইট নির্মিত প্রাচীর ও একটি শিলালিপির সন্ধান পান।

দারাসবাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।

শিলালিপি থেকে জানা যায় এটি ছিল একটি মাদ্রাসা। সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৫০৬ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। দরস অর্থ শিক্ষা আর দরসবাড়ি অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র। আর দরস বাড়িই কালক্রমে দারাসবাড়ি নামে রূপান্তরিত হয়েছে।

দরসবাড়ি থেকে সামান্য পশ্চিমে বড় একটি পুকুরের ওপারে অবস্থিত দরসবাড়ি মসজিদ।

কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম’য়ে সংরক্ষিত এ মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয় এই স্থাপনা।

মসজিদের ছাদ বহু আগে ভেঙে পড়েছে। আর সামনে ভেঙে পড়া বারান্দার ধ্বংসাবশেষ আছে।

বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট সম্বলিত এ মসজিদের বাইরে ও ভেতরে লাল ইটের এবং পাথরের টেরাকোটা স্থান পেয়েছে। মসজিদের দুটি অংশ, একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের স্তম্ভগুলি।

কারুকার্য খচিত মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের মিহরাবগুলো এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

দরসবাড়ির দুটি প্রাচীন স্থাপনা ঘুরে হাঁটা ধরলাম মহাসড়কের উদ্দেশ্যে। আগের রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে গাড়ি রেখে আসতে হয়েছিল। ছোট্ট এই পথের মাঝেই পেয়ে গেলাম বিশাল আম বাগান। সে বাগানে আম পাড়ছিলেন চাষীরা। সৌভাগ্যক্রমে গাছের পাকাআম খাওয়ারও সুযোগ পেলাম সেখানে।

দারাসবাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।

এবার গন্তব্য এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের সোনা মসজিদ স্থল বন্দর।

বন্দরের আগেই জামবাড়িয়া গ্রামে বালিয়া দিঘির পশ্চিম পাশে সড়ক লাগোয়া মুক্তিযুদ্ধের গণকবর। এতদূর এসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা না জানালেই নয়। তাই সেখানে একটু যাত্রা বিরতি দিয়ে তাই চললাম বন্দরের দিকে।  

সোনা মসজিদ স্থল বন্দরের বিজিবি চেকপোস্ট পর্যন্তই পর্যটকরা যেতে পারেন। এ সীমান্তেও আছে প্রাচীন গৌড়ের একটি স্থাপনা।

তবে সেটি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হল না। সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে ভারতে প্রবেশ পথে প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শনের নাম কোতওয়াল দরজা। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ ‘কোতওয়াল’য়ের অনুকরণে এর নামকরণ।

এ নগরের পুলিশ প্রাচীন গৌড় নগরীর দক্ষিণ অংশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে জানা যায়। প্রবেশ পথের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের দেয়ালে ছিদ্র আছে। এগুলো দিয়ে শক্রুর ওপরে গুলি কিংবা তীর ছোড়া হত বলে ধারণা করা হয়।

বন্দরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। একপাশে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ চোখে পড়ল। সেগুলোতে নানান পদের খাবারের মধ্যে মাশকলাই রুটি, গরুর ভুঁড়ি আর হাঁসের মাংস। এমন খাবার রেখে অপেক্ষা করা দায়। বসে পড়লাম একটিতে। নতুন এ খাবারের স্বাদ ভোলার নয়।

গৌড়ের আরও দুটি মসজিদ দেখা এখনও বাকি। তাই দ্রুত খেয়ে রওনা হলাম। বন্দর থেকে পূর্বমূখী সড়কের গোড়ায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। এ পথে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কের ডান পাশে গাড়ি রেখে আমবাগানের ভেতরে হাঁটা শুরু করলাম। একুট পরেই পেলাম বিশাল পুকুর, নাম খনিয়া দিঘি। এর পশ্চিম পাড়েই লাল ইটের তৈরি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের নাম খনিয়া দিঘি মসজিদ। রাজবিবি মসজিদ নামেও এটি পরিচিত।

বারান্দা থেকে মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মিহরাব। মাঝের মূল মিহরাবটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়।

দারাসবাড়ি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ।

পুরো মসজিদটি এক সময় টেরাকোটায় আচ্ছাদিত ছিল। যার অনেকগুলো এখনও দেখা যায়। ভ্রমণে আসার আগে মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য খুঁজে পাইনি।

তবে স্থাপত্যিক রীতির বিচারে ঐতিহাসিকগণ এটিকে পরবর্তী ইলিয়াস ইলিয়ামশাহী আমলে ১৪৮০ সালের দিকে নির্মিত বলে আখ্যা দেন।

এ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে আম বাগানের ভেতরে আছে আরও একটি মসজিদ। ইটের তৈরি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট আয়তকার এ মসজিদের নাম ধুনিচক মসজিদ।

খনিয়া দিঘির মতো এর নির্মাণকাল সম্পর্কেও সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে নির্মাণ শৈলী বিবেচনায় এটিও পনেরো শতকের শেষের দিকে ইলিয়াস শাহী আমলে নির্মিত।     

প্রয়োজনীয় তথ্য

গৌড়ের প্রাচীন স্থাপনাগুলো দেখতে ঢাকা থেকে সড়ক পথে সরাসরি যেতে হবে কানসাট।

কানসাট বাজার থেকে সোনা মসজিদের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। এছাড়া সড়কপথে রাজশাহী কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে সেখান থেকেও বাসে সোনা মসজিদ যাওয়া যায়।

ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পরিবহন, একতা ট্রান্সপোর্ট, হানিফ এন্টারপ্রাইজের নন এসি বাস যায় কানসাট। ভাড়া সাড়ে ৫শ’ টাকা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদ লোকাল ও বিরতিহীন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৫০ থেকে ৭৫ টাকা।

তাহখানা কমপ্লেক্স।

তবে এসব জায়গায় স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নিজস্ব বাহন কিংবা কয়েকজন মিলে মাইক্রোবাস কিংবা ছোট কোনো বাহন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ভালো।

প্রাচীন গৌড়ের প্রাচীন এ স্থাপনাগুলো কয়েক বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই।

সোনা মসজিদ স্থল বন্দরে পর্যটকদের থাকার উপযোগী কোনো হোটেল নেই। সোনা মসজিদের সামনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিশ্রামাগারে অনুমতি সাপেক্ষে থাকা যেতে পারে।

এছাড়া সারাদিন ঘুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে এসেও রাতে থাকা যেতে পারে।

এ শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শহরের শান্তির মোড়ে হোটেল আল নাহিদ, আরামবাগে হোটেল স্বপ্নপুরী, লাখেরাজপাড়ায় হোটেল রাজ, একই এলাকায় হোটেল রংধনু, এসব হোটেলে ২শ’ থেকে ২ হাজার টাকায় কক্ষ ভাড়া পাওয়া যাবে।