অ্যালার্জির কারণ ও করণীয়

হাঁচি থেকে শুরু করে খাবার ও ওষুধের প্রতিক্রিয়াতে এই রোগ হতে পারে। কারও ক্ষেত্রে অ্যালার্জি সামান্য অসুবিধা করে। আবার কারও ক্ষেত্রে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।

মনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2016, 11:25 AM
Updated : 31 July 2016, 09:44 AM

ঘরের ধুলাবালি পরিষ্কার করছেন। দেখা গেল হঠাৎ করে হাঁচি এবং পরে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অথবা ফুলের গন্ধ নিচ্ছেন বা গরুর মাংস, চিংড়ি, ইলিশ বা গরুর দুধ খেলেই শুরু হল শরীর চুলকানি আর চামড়ায় লাল লাল চাকা হয়ে ফুলে ওঠা।

শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কমফোর্ট ডক্টরস্‌ চেম্বার এর ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, “এগুলো হলে আপনার অ্যালার্জি আছে ধরে নিতে হবে।”

তিনি অ্যালার্জির নানা বিষয় নিয়ে জানান।

প্রত্যেক মানুষের শরীরে এক একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ইমিউন সিস্টেম’ থাকে। কোনো কারণে এই ব্যবস্থায় গোলযোগ দেখা দিলে তখনই অ্যালার্জির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

অ্যালার্জি: আমাদের শরীর সব সময়ই ক্ষতিকর বস্তুকে (পরজীবী, ছত্রাক, ভাইরাস, এবং ব্যাকটেরিয়া) প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কখনও কখনও আমাদের শরীর সাধারণত ক্ষতিকর নয় এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। সাধারণত ক্ষতিকর নয় এমন সব বস্তুর প্রতি শরীরের এ অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলা হয়।

অ্যালার্জিজনিত প্রধান সমস্যাগুলো-

অ্যালার্জি জনিত সর্দি বা ‘অ্যালার্জিক রাইনাইটিস’: এর উপসর্গ হচ্ছে অনবরত হাঁচি, নাক চুলকানো, নাক দিয়ে পানি পড়া বা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারও কারও চোখ দিয়েও পানি পড়ে এবং চোখ লাল হয়ে যায়।

‘অ্যালার্জিক রাইনাটিস’ দুই ধরনের।

সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাটিস: বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে একে সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়।

পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস: সারা বছর ধরে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে একে পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়।

লক্ষণ ও উপসর্গ

সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস: ০ ঘন ঘন হাঁচি। ০ নাক দিয়ে পানি পড়া। ০ নাসারন্ধ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া। ০ চোখ দিয়ে পানি পড়া। ০ চোখে তীব্র ব্যথা অনুভব করা।

পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস: পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের উপসর্গগুলো সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের মতো। তবে এক্ষেত্রে উপসর্গগুলোর তীব্রতা কম হয় এবং স্থায়িত্ব কাল বেশি হয়।

অ্যাজমা বা হাঁপানি: এর উপসর্গ হচ্ছে কাশি, ঘন ঘন শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো শব্দ হওয়া বা বুকে চাপ লাগা, শিশুদের ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যেই ঠাণ্ডা লাগা।

অ্যাজমার প্রধান প্রধান উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হল: ০ বুকের ভেতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই আওয়াজ। ০ শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট। ০ দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা। ০ ঘন ঘন কাশি। ০ বুকে আঁটসাঁট বা দম বন্ধ ভাব। ০ রাতে ঘুম থেকে ওঠে বসে থাকা

আর্টিকেরিয়া: এর ফলে ত্বকে লালচে ফোলা ফোলা হয় এবং ভীষণ চুলকায়। ত্বকের গভীর স্তরে হলে মুখ, হাত-পা ফুলে যেতে পারে। আর্টিকেরিয়ার ফলে সৃষ্টি খোলা অংশগুলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। তবে কখনও কখনও বার বার হয়। যে কোনো বয়সে আর্টিকেরিয়া হতে পারে। তবে স্বল্পস্থায়ী আর্টিকেরিয়া শিশুদের মধ্যে এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্টিকেরিয়া বড়দের মধ্যে দেখা যায়।

সংস্পর্শ জনিত অ্যালার্জিক ত্বক প্রদাহ বা ‘অ্যালার্জিক কনটাক্ট ডারমাটাইটিস’

চামড়ার কোথাও কোথাও শুকনা ও খসখসে হয়ে যায়। ছোট ছোট দানার মতো ওঠে। বহিস্থ উপাদান বা অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে ত্বকে প্রদাহ হলে তাকে অ্যালার্জিক কনটাক্ট ডারমাটাইটিস বলা হয়।

লক্ষণ ও উপসর্গ: ০ ত্বকে ছোট ছোট ফোঁসকা পড়া। ০ ফোঁসকাগুলো ভেঙে যাওয়া। ০ চুয়ে চুয়ে পানি পড়া ০ ত্বকের বহিরাবরণ উঠে যাওয়া। ০ ত্বক লালচে হওয়া এবং চুলকানো। ০ চামড়া ফেটে আঁশটে হওয়া।

একজিমা

বংশগত চর্মরোগ। যার ফলে ত্বক শুষ্ক হয়, চুলকায়, আঁশটে এবং লালচে হয়। খোঁচানোর ফলে ত্বক পুরু হয়। কখনও কখনও উঠে যায়। এর ফলে ত্বক জীবাণুর মাধ্যমে আক্রান্ত হয়ে সেখান থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে এবং দেখতে ব্রণ আক্রান্ত বলে মনে হয়। এটা সচরাচর শিশুদের মুখে, ঘাড়ে এবং হাত ও পায়ে বেশি দেখা যায়।

অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস: চোখে চুলকানো ও চোখ লাল হয়ে যাওয়া।

খাওয়ায় অ্যালার্জি: উপসর্গ পেটে ব্যথা, বমি বমিভাব, বমি হওয়া এবং ডায়রিয়া।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জনিত অ্যালার্জি: এটা খুবই মারাত্মক। এলারজেন শরীরের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এটা শুরু হয়ে যেতে পারে। নিম্ন উল্লিখিত উপসর্গগুলো হতে পারে।

০ চামড়া লাল হয়ে ফুলে ওঠে, চুলকায়। ০ শ্বাসকষ্ট, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো আওয়াজ। ০ মূর্ছা যেতে পারে। ০ রক্তচাপ কমে যেতে পারে।

সাধারণ অ্যালার্জি উৎপাদকগুলো: ০ মাইট। ০ মোল্ড। ০ ফুলের রেণু বা পরাগ। ০ ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়া। ০ খাদ্যদ্রব্য। ০ ঘরের ধুলাময়লা। ০ প্রাণীর পশম এবং চুল। ০ পোকা মাকড়ের কামড়। ০ ওষুধসহ কিছু রাসায়নিক দ্রব্যাদি। ০ প্রসাধন সামগ্রী। ০ উগ্র সুগন্ধি বা তীব্র দুর্গন্ধ।

প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা

রক্ত পরীক্ষা: বিশেষত রক্তে ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কি না তা দেখা।

সিরাম আইজিইর মাত্রা: সাধারণত অ্যালার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিইর মাত্রা বেশি থাকে।

স্কিন প্র্রিক টেস্ট: এ পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার ওপর বিভিন্ন এলার্জেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এ পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে রোগীর অ্যালার্জি আছে তা ধরা পড়ে।

প্যাচ টেস্ট: এই পরীক্ষাও রোগীর ত্বকের ওপর করা হয়।

বুকের এক্স-রে: হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই বুকের এক্স-রে করে দেখা দরকার যে, অন্য কোনো কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা।

স্পাইরোমেট্রি বা ফুসফুসের ক্ষমতা দেখা: এ পরীক্ষা করে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায়।

সমন্বিতভাবে অ্যালার্জির চিকিৎসা হল

এলারজেন পরিহার: যখন অ্যালার্জির সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, তখন তা পরিহার করে চললেই সহজ উপায়ে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

ওষুধ প্রয়োগ: অ্যালার্জি ভেদে ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।

অ্যালার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি: অ্যালার্জি হয় এরকম জিনিস থেকে এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিনও অ্যালার্জিজনিত রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি।

এ পদ্ধতি ব্যবহারে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার অনেক কমে যায়। ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।

আগে ধারণা ছিল অ্যালার্জি একবার হলে আর সারে না। তবে বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথম দিকে ধরা পড়লে অ্যালার্জি জনিত রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব। অবহেলা করলে এবং রোগ অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে।