বেইলি রোডে পেটপূজা

খাবারের মান, স্বাদের বৈচিত্র্য আর সুলভ মূল্য, এই তিনটিরই সমন্বয় পেতে চাইলে বেইলি রোডের ফুডকার্টগুলো আপনার কাছে স্বর্গ মনে হতে পারে।

তানভীর মাহমুদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2016, 10:36 AM
Updated : 18 Feb 2016, 01:14 PM

বেশির ভাগ ফুডকার্টই বসে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই নম্বর গেটের পাশে। জেনে নিন এরকম কিছু ফুডকার্টের খোঁজখবর।

ঢাকাইয়া কাবাব এন্ড সুপ: ফুডকার্ট বলুন কিংবা ভ্রাম্যমান খাবার দোকান, বেইলি রোডের সবচেয়ে পুরানো খাবারের দোকানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘ঢাকাইয়া কাবাব এন্ড সুপ’। হাল আমলের ফুডকার্টের মতো সাজসজ্জার চাকচিক্য নেই, দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুঝি সাধারণ চটপটির দোকান। অথচ ভিড় কিন্তু থেমে নেই চাকাওয়ালা দোকানটির চতুর্দিকে। সন্ধ্যার মুখে দেখা গেল অফিস ফেরত ব্যক্তি, স্কুল ফেরতা বালিকার দঙ্গল, বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীর আর কেউবা গাড়ি থামিয়ে জানালার ফাঁক গলে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন।

১৭ বছর ধরে এভাবেই বেইলি রোডের ধারে ভোজনরসিকদের রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন স্বত্বাধিকারী মো. কিরণ।

“আজ থেকে ১৭ বছর আগে যখন এখানে ব্যবসা শুরু করি, তখন বড় বড় দোকান ছিল না। আর গরুর চাপ বিক্রি করতাম ২৫ টাকা দামে”, বললেন তিনি। “সেই থেকে আজকে গরুর চাপের দাম দাঁড়িয়েছে ৯০ টাকায়।”

খাবারের মেন্যুতে একবার চোখ বুলিয়ে গেলে নিতান্ত স্বল্পাহারীর জিভেও জল আসবে। গরুর চাপ, বটি কাবাব, ব্রেন ফ্রাইসহ গরুর পাঁচ রকমের পদ। মুরগির সুপ, চাপসহ চার রকমের পদ; আরও আছে খাসির জালি কাবাব। সঙ্গে গরম গরম ভাজা লুচি-পরোটা। এসব খাবারের দাম ১২০ টাকার মধ্যে। চাইলে পার্সেলও নেওয়া যায়।

খাবারের রন্ধন পদ্ধতি কোথা থেকে শিখেছেন জানতে চাইলে কিরণের উত্তর, “আমি পুরান ঢাকারই বাসিন্দা আর খাবারের ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।”

তাই বলা চলে উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া।

তৃপ্তিসহকারে কিরণ আরও বলেন, “আমাদের খাবার ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ারে পাঠানো হয়। এমন কি দেশের বাইরেও আমাদের গ্রাহক আছেন, থার্টিফার্স্টের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আমাদের বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছে খাবার পাঠিয়ে দেই।”

এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যেও খাবারের অর্ডার নেওয়া হয়।

সপ্তাহে সাতদিনই বসে ‘ঢাকাইয়া কাবাব এন্ড সুপ’। খোলা থাকে বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। সামনের মাসে বেইলি রোডেই ‘ঢাকাইয়া কাবাব এন্ড সুপ’-এর প্রথম স্থায়ী দোকানটির উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সেটি খোলা হবে সকাল ৯টা থেকে। কিরণ জানান, সেখানে চা, কাচ্চি থেকে শুরু করে তাদের অন্যান্য সব পদই সেখানে পাওয়া যাবে।

এক কাপ চা: বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই নম্বর গেটের সামনেই পাওয়া যাবে ‘এক কাপ চা’। খিলগাঁয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবছরের শুরুতে বেইলি রোডে শাখা খোলে দোকানটি।

রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব হল এর ৪২টি স্বাদের চা। প্রতি কাপের দাম ১০ টাকা থেকে ২০ টাকার মধ্যে। দোকানের সাজসজ্জায়ও আছে ভিন্নতার স্বাদ।

দোকানের তিনজন কর্ণধারের একজন কেএইচ আফজাল তমাল দাবি করেন, “বাংলাদেশে আমরাই প্রথম এতগুলো স্বাদের চা পরিবেশন করছি। এগুলোর প্রত্যেকটির রেসিপিই আমাদের নিজেদের উদ্ভাবিত। আরও নতুন স্বাদের চা উদ্ভাবনের জন্যেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

দোকানের বিশেষ নকশার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, “আমাদের ফুডকার্টের নকশাটি মূলত ইতালীয় একটি প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ির নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা হয়েছে।”

প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই দোকান।

তমাল বলেন, “আমাদের দোকানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি চা হচ্ছে, টক-মিষ্টি-ঝাল স্বাদের ‘টনিক চা’ এবং ‘বাদাম চা’। বাদাম চা’য়ের বিশেষত্ব হল এতে প্রচুর চীনাবাদাম-গুঁড়া করে দেওয়া হয়। এছাড়াও অন্যান্য স্বাদের মধ্যে আছে কমলা চা, মাল্টা চা, আমলকি চা, কফি চা, এলাচি দুধ চা ইত্যাদি।”

চায়ের পাশাপাশি বার্গার, পিৎজা ইত্যাদি ফাস্টফুড পাওয়া যায়। এ মাসেই বাসাবো বৌদ্ধমন্দিরে ‘এক কাপ চা’য়ের একটি শাখা খোলা হচ্ছে।

গায়ে হলুদ, বৌভাতসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘এক কাপ চা’ এর অর্ডার নেওয়া হয়।

স্পাইস স্টেশন: মসলাদার ও ঝাল ফাস্টফুড খেতে চাইলে যেতে পারেন স্পাইস স্টেশনে। এখানে পাবেন বিভিন্ন রকমের বার্গার, রোল এবং পিৎজা। গ্রাহকের সামনেই খাবার প্রস্তুত করে পরিবেশন করা হয়।

স্পাইস স্টেশনের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি পদের নাম মার্শিয়ান বার্গার এবং রোডি পিৎজা। অন্যান্য খাবারের মধ্যে আছে- মারশিয়ান রোল, হট পটেটো ফ্ল্যাক্স ইত্যাদি। সবগুলো পদের দাম ৩৫ টাকা থেকে ৭০ টাকার মধ্যে।

স্পাইস স্টেশনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর সস। প্রচুর মরিচ, ধনেপাতা আর মসলা দিয়ে তৈরি এই সসের ঝাঁঝ ও স্বাদ ভোজন রসিকদের আকর্ষণের বস্তু। সপ্তাহে সাতদিনই খোলা থাকে, বিকেল ৫টা থেকে।

রেড ওভেন লাইভ কিচেন: ইতালীয় খাবারপ্রেমী অর্থাৎ পিৎজা ও পাস্তার প্রতি যাদের ভালোবাসা অপরিসীম, তারা যেতে পারেন রেড ওভেন লাইভ কিচেন। স্বত্বাধিকারী ও রাঁধুনী দুই-ই মোহাম্মদ আবদুর রহিম।

তিনি জানালেন তার নিজের দোকান খোলার গল্প।

“এর আগে অন্য কোথাও কাজ শিখিনি। এখান থেকেই সবকিছু শুরু। আমার এক আত্মীয় অনেক বছর ধরে ইতালি প্রবাসী। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি দিকে তার কাছ থেকেই শিখে নিয়েছিলাম পিৎজা আর পাস্তা বানানোর রেসিপি। তারপর নিজের জমানো অর্থ দিয়ে নিজেই ফুডকার্ট খুলে বসি। পিৎজা আর পাস্তা এ দুটিই আমার ফুডকার্টের বিশেষত্ব।”

বিভিন্ন মাপের পিৎজার দাম ১শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকার মধ্যে। পাস্তা ১শ’ টাকা।

খোলা থাকে সপ্তাহের সাত দিনই। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত।

গ্রাহকের চাপ কখন থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শুক্রবারে একটু বেশিই চাপ থাকে। আর প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টার দিকে গ্রাহকের চাপ খুব বেড়ে যায়। তারপর ঘণ্টাখানেক পরে একটু কমে আসে। এরপর আবার বাড়ে সাড়ে নয়টার পর থেকে।”

নানার বাড়ি: মুড়ি নিয়ে নানানরকম নিরীক্ষায় আগ্রহী যারা, সেইসব মুড়ি বিলাসীদের জন্য একটি স্বর্গ হতে পারে ‘নানার বাড়ি।’

এই ফুডকার্ট একটু আলাদাভাবে নজর কাড়বে। কার্টের ভেতরে নানা-নানীর আমলের পাত্রে রাখা বিভিন্ন উপাদান। সম্ভবত এখানেই কার্টটির নামকরণের সার্থকতা বিশ্লেষন করা হয়েছে। মেন্যুতে খাবারের নামগুলো আরও অদ্ভুত, যেমন- নুর-এ-সাদু, ইন্নি মুড়ি, পিংপিং মুড়ি।

এমন মজার মজার নামের কারণ কী?

কার্টের স্বত্বাধিকারী জাহিদুল ইসলাম অকপটে স্বীকার করলেন ব্যবসায় জগতের বেদনাদায়ক সত্যটির কথা- “মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। এই যে অ্যান্টিক বাসনকোসন দেখছেন, সেগুলোও কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এ ছাড়া উপায় নেই।”

তবে নিজের শৌখিনতা আর নিরীক্ষা প্রিয় মনকে একেবারে ছেড়েও দেন নি, তিনি জানালেন কিছু আইটেমের নামকরণের ইতিহাস।

“হয়তো বন্ধুরা মিলে কোনো সিনেমা দেখলাম, সেখানে একটা চরিত্রের নাম ‘পিংপিং’। ব্যস, আমাদের নতুন স্বাদের চিকেন দিয়ে মাখানো মুড়িটার নাম হয়ে গেল পিংপিং মুড়ি।”

হরেক রকমের মাখানো মুড়ি ‘নানার বাড়ি’র মূল আকর্ষণ। এছাড়াও অন্যান্য জনপ্রিয় দুটি পদ হল হালিম আর দইফুচকা।

জাহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা বৈচিত্র্যময় স্বাদের ঝালমুড়ি বানিয়ে থাকি, কোনোটায় ডিম, কোনোটায় চিকেন, কোনোটায় হয়ত বিফ বা কোয়েল। কিন্তু গুণগত মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেই না। এখানেই সাধারণ ঝালমুড়িওয়ালাদের থেকে আমাদের তফাত।”

তিনি আরও বললেন, “সাধারণ হোটেলে হয়ত ৫০ টাকায় এক বাটি হালিম খেতে পারবেন। আমরা হালিম বিক্রি করি ৬০ টাকায়। কিন্তু তবুও মানুষ আমাদের হালিম পছন্দ করছে। কারণ একটাই, আমাদের খাবারের মান নিয়ে কোনো খুঁত রাখি না। ফুডকার্টের ব্যবসায়ে সাফল্যের এটাই কারণ।”

নানার বাড়ি’র বিভিন্ন স্বাদের মুড়িমাখানোর দাম ২৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। নানার বাড়ি স্পেশাল-এর দাম ৩শ’ টাকা। এছাড়াও দইফুচকাসহ অন্যান্য ভারতীয় খাবারের দাম ৬০ থেকে ১শ’ টাকার মধ্যে।

কফিলিশিয়াস কফি: এখানে ১১ রকমের কফি পাওয়া যাবে, যার দাম ২০ টাকা থেকে ১শ’ টাকার মধ্যে। বনশ্রী ও বেইলি রোডের পাশাপাশি সম্প্রতি এর শাখা খোলা হয়েছে উত্তরায়। এছাড়া বেইলি রোডে আরেকটি স্থায়ী দোকানে কফিশপ খোলা হচ্ছে।

স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নাহিম রেজা বলেন, “আমাদের স্থায়ী দোকানের সঙ্গে কার্টের কফির মান বা স্বাদে কোনো পার্থক্য হবে না। স্থায়ী দোকানে শুধু কার্টের চেয়ে বেশি আইটেমের কফি পরিবেশন করা হবে।”

এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফিটির নাম চকোলিশিয়াস। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও অর্ডার নেওয়া যায়।

বেইলি কফি হাউজ:
কফিপ্রেমীদের জন্য আরেকটি আকর্ষণীয় কার্ট বেইলি কফি হাউজ। ১৫ রকমের কফি পাওয়া যায় এখানে, যার দাম ৫০ থেকে ১শ টাকার মধ্যে।

বেইলি কফি হাউজের স্বত্বাধিকারী বেইলি মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, “চকলেট কফি আমার এখানে সবচেয়ে বেশি চললেও অন্য দুটি বিশেষ আইটেমের কারণে আমার আলাদা সুনাম তৈরি হয়েছে। একটি হচ্ছে- ওরিও চকলেট মিল্ক শেইক এবং ওরিও চকলেট কোল্ড কফি।”

আরও জানালেন, ওরিও চকলেট মিল্ক শেইক ও কোল্ড কফি তৈরিতে তিনি আসল ওরিও বিস্কুট ব্যবহার করেন। এছাড়াও ব্যবহার করেন ‘আড়ং’য়ের দুধ, হার্শিস’য়ের চকলেট সিরাপ। আলাদা কোনো বরফ বা পানি ব্যবহার করেন না যেন দূষিত পানি মিশ্রিত হতে না পারে।

“আমার এই ছোট দোকানের সফলতার মূল কারণ হল স্বচ্ছতা। কোনো বাইরের বরফ বা পানি ব্যবহার করি না এবং কফি তৈরির পুরো ব্যাপারটাই করি গ্রাহকের চোখের সামনে।”

বেইলি কফি হাউজটি বসে শান্তিনগর মোড়ে বেইলি রোডের মাথায়।

ছবি: দিপ্ত।