সিজুক ঝরনার প্রথম সন্ধান দেন ঝরনার কাছের গ্রামের বাসিন্দা, পাহাড়ি বন্ধু ক্লিনটন চাকমা। তখন একে নন্দরাম ঝরনা বলে চিনতাম। ক্লিনটন দা'র মুখে ঝরনার দুর্গমতা আর বিশালতার কথা শুনে ট্রেকিংয়ের নেশায় পড়ে যায়।
সিজুক ঝরনায় পৌছতে রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা হাঁটা পথে যেতে হয়। পাহাড়ের এই অঞ্চলটা তখন খুব বেশি নিরাপদ ছিল না। তবে ভরসা ছিল নন্দরামের মনোনীত ইউপি সদস্য উদয়ন চাকমা।
তখন ছিল বর্ষাকাল। আগের রাতে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে পরদিন ভোরের আলোয় রওনা সিজুক ঝরনা পথে। সকালে হালকা বৃষ্টি ছিল। কিছু সময় যেতেই আকাশ উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে।
দিঘিনালা থেকে চাঁন্দের গাড়িতে রওনা হয়ে বাঘাইহাটে সকাল সকাল পৌঁছে যাওয়া যায়। গরম চায়ে চুমক দিয়ে ক্লিনটন দার মোটরবাইকে চড়ে পা বাড়ালাম নন্দরাম পাড়ার দিকে। দ্রুতগতির মোটরবাইকে করে খুব দ্রুতই পৌঁছলাম গেলাম। পথে পেলাম কাশফুলের বন, সবুজ আঁকাবাঁকা পথ। হঠাৎ বাঁক নেওয়া খরস্রোতা নদী।
সবুজ বনানী পেরিয়ে এগিয়ে চলছি ঝরনার খোঁজে। নন্দরাম গ্রামে নেমে উদয়ন দার বাড়িতে কিছুক্ষণের বিরতি। বৌদিকে আমাদের রান্না দায়িত্ব দিয়ে যাত্রা করলাম ঝরনা পথে।
ট্রেইল থেকে দাঁড়িয়ে থেকে যতদূর দেখা যায় কেবল সবুজে ঢাকা উপত্যকার বন। বনের শিখর জুড়ের সাদা মেঘের্ আনাগোনা। বর্ষায় পাহাড়ের সাধারণ রূপের সবটুকু ছিল সিজুক ট্রেইলে।
প্রথম বিরতি দিলাম জুমঘরে। বণ্যপ্রানী থেকে জুম চাষকে রক্ষা করার জন্য পাহাড়ের মাঝখানে জুম ঘর বানান চাষীরা। জুম ঘরে বসে মনজুড়ানো হাওয়া আরর পাকাকলার স্বাদ নিলাম। কিছুক্ষণের বিরতি শেষে আবার রওনা হলাম ঝরনা পথে।
উঁচুনিচু রাস্তা, বাঁশ বনে ঘেরা ট্রেইলের পা চালানো বেশ কঠিন। খাড়া পাহাড়ে বেয়ে নামতে গিয়ে আঘাত পেয়েছে অনেকে। ট্রেইলে ছেড়ে নিচে নামতেই শুরু হয় পাহাড়ি ঝিরি, প্রায় গলা সমান পানি। বেশ কিছুটা পথ গলা পানি দিয়ে সামনে অগ্রসর হলাম। সুনসান নীরবতায় পুরো ট্রেইলে।
প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ফুট দীর্ঘ পানির স্রোত পাহাড় থেকে পাথর নেমে আসছে। ভরা বর্ষায় ঝরনার কাছে যাওয়া কঠিন ছিল। তীব্র গতির জলের স্রোতে গড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। ঝরানার বিশালতা আর জলের স্রোত আমাদের কল্পনাকেও হারিয়েছে।
চারপাশের সবুজ বনে ঘেরা লুকানোর ঝরনার অপূর্ব রূপ, যেন সবুজ বনের সাদা বুনোফুল। দুর্গমতা আর সবুজে ঘেরা সিজুক ঝরনা ছেড়ে যখন চেনা পথে ফিরছি, তখন আকাশের কালো মেঘ থেকে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির অঝোর ধারা।
বৃষ্টিতে পথ চলাটা দ্বিগুণ কঠিন হয়ে উঠল। জোক, কঠিন ট্রেইল, গলা সমান ঝিরির পানি পেরিয়ে দেখা সিজুক ঝরনা বেঁচে আছে প্রকৃতির বিশালতায়। দুর্গম বুনো পথে এমন অসংখ্যা ঝরনা, ঝিরি, চেনা-অচেনা বৃক্ষ প্রাণ যোগায় প্রকৃতিতে।
যেভাবে যাবেন: সিজুক ঝরনায় যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে যেতে হবে খাগড়াছড়ি বা দিঘীনালা পর্যন্ত। খাগড়াছড়ি বা দিঘীনালা থেকে রির্জাভ চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে সরাসরি নন্দরাম গ্রাম পর্যন্ত যাওয়া যায়। নন্দরাম থেকে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসতে পারেন সবুজে ঘেরা সিজুক ঝরনা। পুরো ট্রেইলে সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘণ্টা।
ঝরনার আশপাশটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন। সিজুক ঝরনা ভ্রমণের তথ্য বা পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৬৭১০০৪৩, ০১৮১৫৮৫৬৪৯৭।
ছবি: শোভন।